পথভোলা অভিষেক
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
একটা মানুষ চলে যাওয়ার পরেই কেন টনক নড়ে আমাদের, প্রশ্নটা আশৈশব কুরে কুরে খেয়েছে আমায়। বেঁচে থাকা অবস্থায় হয়তো ফিরেও তাকায়নি। খবর রাখেনি কেমন আছে মানুষটা ! এটাও দেখেছি, বেঁচে থাকা অবস্থায় হাত ধুয়ে শত্রুতা করে গেছে। মারা যেতেই মরাকান্না ! বলতে পারি, তখন থেকেই সমাজের ভন্ড, রিক্ত ও ফাঁপা চেহারাটার অবলোকন শুরু। সাম্প্রতিক কালে অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানকে কেন্দ্র করে আর একবার যেন এই ভণ্ডামি, মিথ্যাচারের ছবিটা দেখতে পেলাম। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা সংবাদমাধ্যম–এ ব্যাপারে কেউ কম যায় না। তবে, সবটাই আসলে সমাজ। ইন্ডাস্ট্রি বা মিডিয়া সমাজের বাইরে নয়।
সময়ে হোক বা সময়ের আগে, মানুষের মৃত্যু আমাদের হাতে নেই। আমাদের হাতে এটুকুই আছে, বেঁচে থাকাকালীন যথাসম্ভব মানুষটাকে ভালো রাখা। সবসময় অবশ্য সেটাও আমাদের হাতে থাকে না। অবুঝ, অসহযোগী হলে, তাঁদের ভালো চেয়েও অনেকক্ষেত্রে অসহায় দর্শক হয়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়াটা দেখতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অভিষেকের ক্ষেত্রে দুটোই ঘটেছে। একদিকে পেশার ক্ষেত্রে যে অবধারিত ঘটনাক্রম, তিনি তার মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে, তাঁর অন্তরের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, ব্যক্তিগত স্তরে ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা না থাকাটাও একটা দিক। কেরিয়ারের ক্ষেত্রে তিনি শুরুটা যেভাবে করেছিলেন, সেটা কেন পরে ধারাবাহিকতা হারালো, সেটার জন্য অনেককে বা অনেক কিছুকেই দায়ী করা যায়। কিন্তু সবটাই তো আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া। একাজটা গসিপ কলাম লিখিয়েদের প্র্যাকটিস হতে পারে। কিন্তু দায়িত্বপূর্ণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কী এটা করা যায় ? অনেকেই বলছেন, ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা ছিল না তাঁর। হতে পারে, সেখানেই হয়তো খেলায় পিছিয়ে পড়তে হয়েছে অভিষেককে।
পাঠক মাফ করবেন, অভিযোগ বা অনুযোগ এ প্রতিবেদনের বিষয় নয়। কাঠগড়ায় আমরা সবাই দাঁড়িয়ে। আবার সকলেই বিচারকের ভূমিকায়। এটা অনস্বীকার্য, অভিষেকের যা বয়স, চলে যাওয়ার সময় হয়নি তাঁর, সে বাবদ একটা দুঃখবোধ সকলের মধ্যেই তীব্রভাবে কাজ করছে এখন। আদতে যে কোনও মৃত্যুই যেহেতু চিরবিচ্ছেদ ডেকে আনে, সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবেই এ এক পরিবেশগত বিষণ্নতার বাতাবরণ সৃষ্টি করে। এটা সম্পূর্ণভাবেই মানবধর্মের একটি চিরায়ত ব্যকরণ। কিন্তু সেই বাতাবরণ থেকে যখন ঘনীভূত বেদনার বাষ্প বিলীন হয়ে যেতে থাকে, তখন প্রকৃত ছবিটা দেখতে পাই আমরা। যে ছবির একান্তে বসে দুটি মানুষ–অভিষেকের স্ত্রী আর কন্যা। আমাদের ভুলে যেতে এক সপ্তাহও লাগবে না। এই মানুষদুটির ভুলতে সারাটা জীবন কেটে যাবে।
এবার একটু সংবাদমাধ্যমের কথায় আসি। গত কয়েকদিন যাবৎ প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যম ফলাও করে অভিষেকের মৃত্যু ও তার আগে-পরের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণের অজুহাতে (বা শোক প্রকাশের) প্রচুর কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেছে। অভিষেকের প্রতি কত অন্যায় হয়েছে, তাই নিয়েও সোচ্চার হয়েছে কেউ কেউ। দেখে বার বার মনে হচ্ছিল, অভিষেকের প্রতি যদি সত্যিই এই অন্যায়গুলি ঘটে থাকে, তবে, সেই ঘটমান সময়ে এইসব সংবাদমাধ্যম কোথায় ছিল? কোনও একটি সংবাদপত্রে একবারের জন্যও তো তাঁর আক্ষেপ, অভিমান, ক্ষোভের কথা পড়েছি বলে মনে পড়ে না। কেরিয়ারের শেষের দিকে এসে তো বলতে পারলেন তিনি, কী পরিমাণ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন সেই সময়, যখন তাঁর কেরিয়ার আক্ষরিক অর্থেই সুবর্ণ লগ্নে পৌঁছনোর পথে !
দাদা-দিদি বলতে কাদের বুঝিয়েছেন অভিষেক, কারা তাঁর বিরুদ্ধে রাজনীতি করেছেন, সেটা আজ মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। কিন্তু দেখুন–না তখন, না এখন, কোনও সংবাদমাধ্যমই সরাসরি এই দাদা-দিদির নাম উচ্চারণ করছে না সেই অর্থে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছে। আমি নিজেও কিন্তু আভাসেই বললাম। আসলে এটাই খেলার নিয়ম। মুখোশ পরেই এই খেলাটা খেলতে হয়। আমি বা আমার সংবাদমাধ্যম সেটা স্বীকার করার সাহস রাখি। ভণ্ডামি বা আত্মপ্রবঞ্চনা কোনওটাই করি না। বাকিরা খবর বিকোবার তাড়নায় নাটক তৈরি করে। এটাও অবশ্য খেলার একটা অলিখিত নিয়ম। ক্ষমতা ও প্রভাবশালী লোককে কেউ চটায় না–সে রাজনৈতিক নেতা হোক বা সিনেমার নায়ক ! কথাটা স্বীকার করে না, এই যা।
তরুণ মজুমদারের ‘পথভোলা’-র মতো বাণিজ্য-সফল ও সমালোচক-প্রশংসিত ছবি দিয়ে অভিষেকের অভিনয় জীবন শুরু। টলিউডে আনকোরা মুখের এই তরুণকে তাঁর ছবির চরিত্রের মতো করে গড়ে নেওয়ার পিছনে তরুণবাবু যে যত্ন, শ্রম ও ভাবনা ব্যয় করেন, সেটা নিঃসন্দেহে অভিষেকের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের একটি অতুলনীয় পর্ব ছিল। তারপর বহু ছবিতে কাজের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় ‘পথভোলা’। পরিসংখ্যান বলছে, তারপর প্রচুর ছবিতে কাজ করেছেন অভিষেক–যার মধ্যে ‘পাপী’, ‘লাঠি’, ‘দহন’, ‘তুফান’, ‘সুজন সখি’, ‘আলো’, ‘বাড়িওয়ালী’, ‘খেলাঘর’, ‘গজমুক্তা’-র মতো ছবি উল্লেখযোগ্য। বাকি বেশিরভাগ ছবি আসে-যায়-ছাপ রাখে না গোছের। এসবের মধ্যে বহু বক্স অফিস কাঁপানো ছবিও আছে। আবার এমন বেশকিছু ছবি আছে, যেখানে অভিষেক কাজ করেছেন পার্শ্ব নায়কের চরিত্রে। এই যে তথ্যগুলি, এর কোনওটাই প্রমান করে না, তিনি ইন্ডাস্ট্রি থেকে একেবারে আউট হয়ে গেছিলেন। আশানুরূপ রোল পাননি বা ভালো কাজ এসেও হাত থেকে চলে গেছে, এটা হতে পারে।
যেটা লক্ষ্যনীয়, এই পেশায় একবার চলে আসার পর, কারোই ফেরার পথ বা মানসিকতা কোনওটাই থাকে না। অভিষেক নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন শুনেছি–তাঁদের ব্যবসায়ী পরিবার। কিন্তু একবার রুপোলি পর্দার স্বাদ পাওয়ার পর ফেরার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। ফেরেননি তিনি। বাবার ব্যবসায় যোগ দেননি, সে রাস্তা খোলা থাকলেও। পর্দায় যেমন যেমন সুযোগ পেয়েছেন, কাজ করেছেন। এর মাঝে যাত্রাও করেছেন। এইসবের মধ্যে না পাওয়ার ক্ষোভটা ঠিক কোন প্রেক্ষিত থেকে জমছিল তার মধ্যে, সেটা গত কয়েকদিনের যাবতীয় সংবাদসূত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও খুব একটা পরিষ্কার হয়নি আমার কাছে। শেষ যে দুটি কাজ টিভিতে করছিলেন, সেখানেও তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেই ছিলেন অভিষেক। মোদ্দা কথা, তিনি দু-একটি বছর বাদ দিলে, একেবারে টানা বসে ছিলেন, কাজ ছাড়া কাটিয়েছেন, এমনটা কিন্তু পরিসংখ্যান বলে না।
দু-তিনটি লিভ-ইন সম্পর্কের পর বিয়ে করেন অভিষেক। অভিষেকের স্ত্রী সংযুক্তা একেবারে ইন্ডাস্ট্রির বাইরের একজন মহিলা। তিনিও চাকরিরত। মিষ্টি একটি কন্যাও আছে তাঁদের। দাম্পত্যের ক্ষেত্রে অভিষেক সুখী, এমন কথাই তো খবরের সূত্রে জানা যাচ্ছে। তাহলে, সমস্যাটা কোথায় ? খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই নাকি অসংযমী ছিলেন অভিষেক। একদা ফুটবলার, প্রথম ডিভিশনে খেলেছেন পর্যন্ত। অর্থাৎ শরীরচর্চার অভ্যাস ছিল অভিষেকের। ইদানীং নাকি সেটাও ছেড়ে দেন। শারীরিক সমস্যা হলে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়া বা বিশ্রাম, তাতেও অনীহা ছিল। এ যেন, ইচ্ছে করে এমন এক পরিণতির দিকে নিজেকে ঠেলে দেওয়া ! তবে, এটাও একটা কার্যকারণ হিসেবে অনুমান। ঠিক কী তাঁর মনে ছিল, সেকথা অভিষেকের স্ত্রী বা অন্য ঘনিষ্ঠজনের পক্ষে ছাড়া বোঝা মুশকিল। ইন্ডাস্ট্রিতে তো আজ অনেকেই তাঁর জন্য আকুল হয়ে কাঁদছেন। তাঁরা তো তাঁর বন্ধু-স্বজনই হবেন তাহলে। তবু, কোথা থেকে এত হতাশার জন্ম ?
কোথাও কী বহু বছরের ক্ষোভ, অভিযোগ, অভিমানটাকে পুষে রেখেছিলেন তিনি ? শেষদিকের সাক্ষাৎকারগুলি তারই ইঙ্গিত দেয়। কার ওপর ক্ষোভ ? সেই বহু আলোচিত ‘দাদা’ ? এটা তো সত্যি বড্ড অপরিণত ও অপেশাদার শোনাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে এতবছর থাকার পরও যদি তিনি এটা না শেখেন যে, কেউই খুশি মনে নিজের জমি ছাড়ে না, তাহলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। শীর্ষে ওঠার পরেও জমি হারাবার ভয়ে আগেই আঘাত হানবেন এহেন দাদারা, এটাই তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ নিয়ম সব খেলায়। বলা ভালো সব পেশায়। অভিষেক জীবনে কী পাননি, তাঁর থেকেও আমার বেশি জরুরি মনে হয় এই আলোচনাটা, যে বেঁচে থাকলে আরও কত দিতে পারতেন তিনি। তাঁর পরিবারেরও তাঁকে প্রয়োজন ছিল। বলা উচিত, সবচেয়ে বেশি। সেটা হলো না, আক্ষেপ এটাই।
**ছবি সৌজন্যেঃ গুগল