পরম্পরায় জন্মায় উত্তরাধিকার
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ শেষ পর্ব। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
শুরু আর শেষের মাঝে কয়েকটি সপ্তাহ অতিক্রান্ত। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুধাবন প্রসঙ্গে মূল্যবান মতামত জানিয়েছেন এই সময়ের স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীবৃন্দ। তাঁদের প্রত্যেকের রচনার মাধ্যমে উঠে এসেছে ভাবনার নতুন নতুন অভিমুখ। অনুধাবন না করে একটি গানের সঠিক পরিবেশন সম্ভব নয়, সেটা যথার্থ বিশ্লেষিত ওঁদের আলোচনায়। এই সিরিজ শুরুর মতোই শেষ করার ভারও নিজেকেই নিতে হলো। সেটা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবেই হোক বা নিজের দীর্ঘদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার খাতিরে !
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার গানের গুরুদের কথা। আমার সৌভাগ্য আমি অসাধারণ গুণী ও মননশীল গুরুদের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছি। দুর্ভাগ্য, যতখানি পেয়েছি, ততখানি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। উপায় থাকলে তাঁদের পায়ের কাছে বসে আজীবন সঙ্গীত সাধনা করতাম। পারিনি–এ আক্ষেপ যাওয়ার নয়। তা সত্ত্বেও আজও যতটুকু গাইতে পারি, তাঁদেরই আশীর্বাদে।
আমার প্রথম গুরু অমিয় বন্দোপাধ্যায়। উনি নিজে সুবিনয় রায়ের ছাত্র ছিলেন। ঠিক সেই মাত্রায় পারফেকশনিস্ট। আমার সারা জীবনে আর কোনও গুরুর কাছে আমি অত বকা খাইনি। তখন আমি বালিতে থাকি। বিবাহিত ও এক সন্তানের জননী। সাংসারিক দিক থেকে খুবই বিপর্যস্ত থাকতাম। সবদিক সামলে মাস্টারমশাইয়ের চাহিদা মতো অনুশীলন করা সব সময় সম্ভব হতো না। কিন্তু মাষ্টারমশাইয়ের কাছে আমার সব সমস্যাই অজুহাত বলে মনে হতো। বকে চোখের জল বের করে দিতেন। আর একটা কথা বলতেন, যা আজও ভুলতে পারিনি–’খাওয়া, ঘুম সব করার সময় পেয়েছো, রেওয়াজের সময় হয়নি ?’
আমার গান গাওয়া নিয়ে মাষ্টারমশাইয়ের প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল। আমি সেই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হইনি, এ আক্ষেপ যাবার নয়। কিন্তু তাঁর বকুনি, অপার স্নেহ আর অসাধারণ শেখানোর পদ্ধতি কোনও দিন ভোলার নয়। স্পর্শস্বর আর মীড় কোন নিখুঁত বিন্দুতে কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব, শুনতাম মাষ্টারমশাইয়ের কাছে। আর সেই সাঙ্গীতিক নিপুণতা একটি গানকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, তা আজও কানে বাজে। একটি হাইস্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন মাষ্টারমশাই। গানের বাইরে পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। প্রচারবিমুখ ছিলেন। আজকের প্রচারসর্বস্ব যুগে চূড়ান্ত ব্যতিক্রম মাষ্টারমশাই। চলে গেছেন বহুদিন। ওঁকে ভুলিনি, ভুলবো না–রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুধাবনের প্রথম দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন উনিই।
বালি থেকে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা চলে আসার পর বাস্তব কারণেই কোনও একটা সময় মাষ্টারমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আজও সেকথা ভেবে আক্ষেপ, যন্ত্রনায় জর্জরিত হই। তারপর তো জীবনের অনেক কিছুই পাল্টে গেল। এটা ঠিক, গান শেখা বন্ধ হলো না। কলকাতায় আসার পর প্রথম প্রশিক্ষণ সুবীর ভট্টাচার্যের কাছে–উনি একেবারে মাষ্টারমশাইয়ের বিপরীত স্বভাবের। সুবীরদা বন্ধুর মতো হই হই করে গান শেখাতেন। বকা খাইনি তেমন। তবে, উনিও অনেকটা সময় দিতেন। চাইতেন আমিও সংসার থেকে আর একটু সময় চুরি করে গানকে দিই। বলা বাহুল্য, সে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ তখন! এম মিউজ (ডিপ্লোমা কোর্স) পর্যন্ত সুবীরদার কাছে শিখেছিলাম। তারপর উনিই আমাকে প্রসাদ সেনের কাছে শেখার পরামর্শ দিলেন।
গুরু হিসেবে প্রসাদদা ভীষন স্নেহপ্রবণ একজন মানুষ। আর টপ্পা অঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত যে ওঁর পরিবেশনে এক অনন্য রূপ পেত, সেকথা সকলেরই জানা। এসরাজ বাজিয়ে গান শেখাতেন প্রসাদদা। সেও আজকের হিসেবে এক বিরল অভিজ্ঞতা। আমার থাকা তখন কলকাতার পাটুলি অঞ্চলে, প্রসাদদা থাকেন গলফগ্রিন। আসাযাওয়ার সমস্যায় শেখা বন্ধ হয়ে গেল একটা সময়। তারপর কিছদিন পূর্বা দামের কাছে শিখলাম। খোলা গলায় কী অসাধারণ ভঙ্গিতে নিজেকে উজাড় করে দিতেন পূর্বাদি এক একটা গানে, ওঁর প্রশিক্ষণে সেই অনন্যতার ছোঁয়া পেয়েছি। শেখার আগে গান পড়া, এই পদ্ধতিও ওঁর কাছেই পাওয়া। এতে যে গানটির প্রতি আরও বেশি অন্তর থেকে মনোযোগী হওয়া যায়, যেটা দেখে গাইলে হয় না, এটা অনুধাবন করতে শিখিয়েছিলেন পূর্বাদি। প্রসাদদা বা পূর্বাদি–দুজনেই স্বনামখ্যাত। ওঁদের নিজস্ব কিছু গায়কী বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রশিক্ষক হিসেবেও তুলনাহীন। দুজনেরই অকৃত্তিম স্নেহ পেয়েছি। গানের ক্ষেত্রে যতটুকু পেরেছি, আহরণ করেছি দুজনের কাছ থেকেই।
এরপর ব্যাক্তিগত কারণে বছর পাঁচেক গানের সঙ্গে সম্পর্কহীন কাটাতে হয়। তারপর আবার যখন গান শেখার সুযোগ এলো জীবনে, তখন যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ শুরু বন্দনা সিংহের কাছে। বন্দনাদির কাছে আমি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গান শিখি। তার অনেক কারণ। সেসব বলার ক্ষেত্র এটা নয়। এটুকু বলার, অমন অবলীলায় রবীন্দ্রনাথের কঠিনতম গানগুলি গাইতে আমি আর কারোর ক্ষেত্রে শুনিনি। গানের কথার ভাবার্থ বোঝার ক্ষেত্রেও খুব জোর দিতেন। ছাত্রছাত্রীদের পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে ওঠার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে একজন গুরুর যা যা করণীয়, বন্দনাদি হৃদয় দিয়ে সেটা করতেন। শুধু যথাযথ প্রশিক্ষণ নয়, মঞ্চে গান গাইবার ক্ষেত্রে যে আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন, তার জন্য জরুরি গুরুর আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা আর ঐকান্তিক উৎসাহ। বন্দনাদির দিক থেকে এই ব্যাপারে কখনও কোনও কার্পণ্য দেখিনি।
সবশেষে শেখা অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। বন্দনাদির মতোই ওঁর কাছেও আমি প্রবলভাবে ব্যাক্তিগত স্তরে ঋণী। ভাবাবেগ প্রকাশের কী কোনও ব্যাকরণ হয় ? রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি প্রসঙ্গে, একদিন আমাদের মধ্যে এই প্রেক্ষিতেই আলোচনা হচ্ছিল। আমার সৌভাগ্য, এমন আলোচনা করার সুযোগ দিতেন তিনি আমা হেন নগন্যকে। বলেছিলেন, সুর, তাল, কথা আর আবেগ একেবারে পরিপূরক হয়েছে এই গানের স্বরলিপি নির্মাণে। শিল্পীকে শুধু সেটা অনুধাবন করতে হবে। গাইবার পদ্ধতিতেও আমার যা কিছু জড়তা কাটিয়ে দেন অভিজিৎদা। দেখেছি, যত বড় মাপের মানুষ, ততটাই মাটির কাছাকাছি রাখতেন নিজেকে। অপার সৃজনশীলতায় গুণী, অসীম জ্ঞানভান্ডার তাঁর। একটি গানকে সম্পূর্ণতা প্রদানে কথা-সুর-তালের বাইরে আরও কত কিছু যে বোঝার আছে, পরতে পরতে সেই জানা ও বোঝার দরজা আমার সামনে খুলে দিয়েছিলেন অভিজিৎদা।
আর একজন মানুষের কথা এই উল্লেখে না থাকলে প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়। আমি সরাসরি ওঁর ছাত্রী ছিলাম না। স্মৃতিদির প্রতিষ্ঠিত ‘স্বরবিতান’-এর অনুষ্ঠানে তিনি আমায় গাইবার সুযোগ দিয়ে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন। অসাধারণ ভাবনাযুক্ত সেইসব অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণ ও রিহার্সালে উপস্থিত থাকার সুবাদে কত কিছু যে শিখেছি !
আমি ছাত্রী হিসেবে যেমনই হই, পৃথকভাবে প্রত্যেকের আশীর্বাদের হাত আমার মাথার ওপরে আজও আছে। এ আমার বিনয় নয়। এ আমার বিশ্বাস। আজও যে দু-এককলি গাইতে পারি, সেটা এই বিশ্বাসের জোরেই। আর নিজের এই প্রশিক্ষণ পর্ব, রেওয়াজ করতে পারার সুফল, অনুশীলন থেকে দূরে থাকার কারণে গানের ক্ষতি–এই বোধ ও চেতনাই অনুধাবনের পথে নিয়ে গেছে আমায়। সঙ্গীত সম্পূর্ণভাবেই গুরুমুখী বিদ্যা। আর সাধনা বা অনুশীলন বিহীন গুরুর প্রশিক্ষণও যে ব্যর্থ হয়ে যায়, তা আমি নিজে উপলব্ধি করেছি। করেছি বলেই এই ঋণ স্বীকার ও ঋণী হয়ে থাকা।
এ যাবৎ, এই সিরিজে যাঁরা যাঁরা লিখেছেন তাঁরা সকলেই দক্ষ, প্রতিভাবান, প্রথিতযশা, একনিষ্ঠ এক একজন শিল্পী। যাঁদের কথা ভেবে অভিজ্ঞজনের এই কলম ধরা, এবার তাঁদের ভাববার পালা। শুধু সঙ্গীত নয়, যে কোনও শিল্পেরই শর্ত এক–নিজেকে উজার করে দিলে, তবেই প্রতিদানে কিছু প্রাপ্তি সম্ভব। চালাকির দ্বারা খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। যাঁরা এখানে মতামত দিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের জীবনের সবটাই সঙ্গীতকে দিয়েছেন। আমি নিজের কথা সবার শেষে এই কারণেই বললাম, আমি এঁদের মতো নিবেদিত হতে পারিনি। পারিনি যে, সে দায় সম্পূর্ণ আমার। কিন্তু চালাকিও করিনি। করিনি বলেই, সঙ্গীতের ঈশ্বর কন্ঠ থেকে সুর কেড়ে নেননি এখনও। শুধু তাই নয়, আমার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আমি আমার সঙ্গীত প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে পেরেছি। জ্ঞান বা বিদ্যা কখনও ফেলা যায় না। পরের প্রজন্মের যাঁরা পেশাদারিভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে অবলম্বন করতে চাইছেন, তাঁরা আশা করি অনুধাবনের সঠিক সংজ্ঞা কী, সেটা অনুভব করবেন।
সবশেষে একটা কথা–কিছুটা ব্যাক্তিগত আলাপচারিতা করে ফেলেছি, তার জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে, তাঁরা নিশ্চয়ই অনুভব করবেন, এ কথন নিজের কথা বলার জন্য নয়। এ হলো পরম্পরার বৃত্তান্ত। পরম্পরা ছাড়া শিল্পের উত্তরাধিকার জন্মায় না। রিয়ালিটি শো থেকে সোস্যাল মিডিয়া–আজকাল প্ল্যাটফর্মের অভাব নেই। কিন্তু সেটা দৃশ্যত ! সত্যিটা একেবারেই এত সরল নয়। রিয়ালিটি শো থেকে উঠে আসা আর হারিয়ে যাওয়ার অঙ্কটা কষলেই কঠিন সত্যটা উপলব্ধ হবে। আর সোস্যাল মিডিয়ায় তো রোজ শিল্পীর জন্ম, রোজ হারিয়ে যাওয়া ! আজও কিন্তু শেষ পর্যন্ত লম্বা রেসে তারাই টিকে থাকছে, যারা ওই অনুধাবন নিয়ে এগিয়েছে। বাকি আসা ও যাওয়া–বাণিজ্য করছে কিছু উটকো লোক, দূর দূর পর্যন্ত সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের কোনও সম্পর্কই নেই।