প্রিয় চিনার পাতা…
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ তথ্যচিত্র নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ কুমার চৌধুরী । ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব আজ। দ্বিতীয়পর্ব আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি। সাক্ষাৎকার অজন্তা সিনহা ।
তোমার সিনেমা তৈরির চিন্তাভাবনার শুরুটা কিভাবে হলো ?
◆ ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় পাড়ার এক কাকা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই বড় হয়ে কি হতে চাস’ ? উত্তরে বলেছিলাম, সিনেমা পরিচালক। আমাদের মফস্বলে তখন তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হতো। আর স্মৃতি সিনেমাহলে রবিবার সকাল নটা থেকে একটা film club ছবি দেখাতো। সেখানেই ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘বেনহার’, ‘ দ্য কিড’, ‘সফেদ হাতি’ ইত্যাদি সিনেমা দেখি। আঠেরো বছর বয়সে প্রথম চিত্রনাট্য লিখি। তারপর পড়াশোনা, অভিনয় পাশাপাশি চললেও কোনও ঘটনা মনে স্ট্রাইক করলে ( মফস্বলে অদ্ভুত সব ঘটনাও ঘটত। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারেও প্রচুর গল্প উড়ে বেড়াতো।) বা কাগজে কোনও interesting বিষয় পড়লে, সেটা ডায়েরিতে নোট করে রাখতাম। কলকাতা এসে Universityতে পড়তে গিয়ে প্রচুর ছবি দেখা শুরু হলো। এরপর অভিনেতা হিসেবে পেশাদারি জীবন শুরু করলাম। তখন থেকেই সিনেমা বানাবার ইচ্ছেটা ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। তারপর একদিন তারা মিউজিক চ্যানেলে টেলিফিল্ম বানাবার সুযোগ পাই। সেইসময় প্রতিদিনই মনে হতো এবার বড়পর্দার জন্য ছবি করি।
নিজের কাজ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানাও।
◆ মাননীয় উৎপল দত্ত মহাশয়ের PLT-তে অভিনয় শুরু করি ১৯৯১ সালে। তার আগে গোবরডাঙায়
‘সপ্তডিঙা আসর’ ও ‘নকশা’ তে অভিনয় করতাম।
ছোটপর্দায় পেশাদারি অভিনয় শুরু করি কলকাতা দূরদর্শনে। তারপর পরিচালনায় আসি সেই টিভি অর্থাৎ ছোট পর্দাতেই। তারা মিউজিক চ্যানেলে টেলিফিল্ম বানাতে শুরু করি। দশটা টেলিফিল্ম পরিচালনা করেছি। এরপর শর্টফিল্ম বানাতে শুরু করি। তারপর সিনেমা। ‘ প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’ আমার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র।
এই কাজগুলো করতে গিয়ে যে ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছ, তার কিছু জানাও।
◆ প্রথম টেলিফিল্ম ‘মিডফিল্ডার’ পরিচালনা করতে গিয়ে একদিন তুমুল বৃষ্টির কবলে পড়ি। এত বৃষ্টি হয় যে সেদিনের শুটিংই ভেস্তে যায়। এরপর আবার অভিনেতা ও কলাকুশলীদের একত্রিত করে সেই শুটিং করতে গিয়ে তিনমাস চলে যায়। সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ছবিতে ডিসেম্বর ঢুকে পড়ে। ফ্রেমের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়ে শোয়েটার, মাফলার। সঙ্গে সঙ্গে কাট কাট…! এবং রি-টেক। প্রথম শর্ট ফিল্ম ‘A Small Incident’-এ আবার চিত্রনাট্য অনুযায়ী বৃষ্টির প্রয়োজন। বর্ষাকালেই শুটিংয়ের ডেট ফেলা হল। এদিকে বৃষ্টির দেখা নেই। অন্যান্য শট নেওয়া চলছে। বৃষ্টির শট আর নেওয়া হলো না। ভাবতে ভাবতে একসময় লাঞ্চ ব্রেক ঘোষণা করে দিলাম। আর তার দশ মিনিট পরে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। পড়ি মড়ি করে ছুটলাম। সিনেমাটোগ্রাফার মৃণ্ময় আর ওর ছেলেরা খাওয়া ফেলে আগে বৃষ্টিকে ক্যামেরাবন্দী করলো। আর আমার প্রথম সিনেমা ‘ প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’এ বৃষ্টিও প্রয়োজন, আবার কাশ্মীরও চাই। মূল শুটিং শেষ করার প্রায় দুমাস পরে বৃষ্টি এল। আমি আর শুভ বৃষ্টি ধরতে ছুটছি। শেষ অব্দি বৃষ্টি ক্যামেরায় ধরা দিল। এছাড়াও কাশ্মীরে শুট করতে যাবার ক’দিন আগে ৩৭০ ধারা রদ হল। সে কী কাণ্ড ! শ্রীনগরে ঢুকতে পারা গেল না। তখন অমৃতসর থেকে গাড়িতে জম্মু হয়ে কাশ্মীরে পৌঁছালাম এবং শট নিলাম।
ইনডিপেনডেন্ট ছবি নির্মাণের প্রচলন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রসারিত। এই রাজ্যে কতটা হয়েছে ?
◆ ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম সাধারণত মেজর ফিল্ম-স্টুডিও সিস্টেমের বাইরে গিয়ে হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এটা আজ অনেকটাই প্রসারিত। আমাদের এখানেও কিছু কাজ হচ্ছে। তবে, এটাও দেখতে হবে সেগুলো কতটা সত্যিই ইনডিপেনডেন্ট ! মানে আমি বলতে চাইছি, প্রযোজক, স্টুডিও সিস্টেম, মার্কেটিং, ডিস্ট্রিবিউশন–সবকিছুর সুবিধে নিয়ে
তৈরি হওয়া অনেক ছবিকেও আজকাল ইনডিপেনডেন্ট বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। এতে সত্যিকারের ইনডিপেনডেন্ট ছবির নির্মাতারা অসুবিধেয় পড়ছেন। আবার অনেক সময় একজন ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকার প্রথম ছবি বানালেন স্বাধীনভাবে–পরের ছবিতেই তিনি সমস্ত সুযোগ সুবিধে পেয়ে গেলেন। মানে সেটা পুরোপুরি কোনও স্টুডিও বা বড় হাউসের মেনস্ট্রিম ফিল্ম। অথচ তিনি সেটাকেও ইনডিপেনডেন্ট ছবি বলে চালালেন। এটাই দুঃখের। তবে আমাদের এখানে স্বাধীনভাবে অনেক ছোটছবি এবং তথ্যচিত্র এখন তৈরি হচ্ছে।
এক্ষেত্রে বিষয় ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে একজন পরিচালককে কিভাবে অগ্রসর হতে হয় ?
◆ সত্যি কথা বলতে গেলে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের কাছে অনেক সময়ই কোনও বাজেট থাকে না। কিন্ত বাজেট ছাড়া কোনও শুটিং করাও সম্ভব নয়। কম হলেও বাজেট একটা থাকতেই হবে। তাই বিষয় নির্বাচন এবং তার execution খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুর কাছ থেকে একটা ক্যামেরা জোগাড় হলো আর বিনা পয়সায় কিছু অভিনেতা, অভিনেত্রী পাওয়া গেল। তাই দিয়ে যা খুশি শুটিং করে নিলাম। বললাম, পুরোটাই improvise–ওভাবে ভাল কিছু হয় না। হয়তো একবার হলো। কিন্ত দ্বিতীয়বার হবে না। আর ওটা কোনও মডেল হতেও পারে না। ছবি পরিচালকের কাছে craft-টাই আসল। সিনেমাটা লো বাজেটের না কোটি কোটি টাকার–দিনের শেষে সেটার বিচার হয় না। বিচার হয় সিনেমাটা কেমন ? ভাল না খারাপ? তাই বিষয় ভাবনা থেকে শুরু করে ফিল্মের প্রতিটি শাখায় পরিচালকের পাণ্ডিত্য না থাকলেও জ্ঞান থাকা জরুরি। তবেই অল্প বাজেটেও ভাল ছবি করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে অভিনেতা ও টেকনিশিয়ানদের সহযোগিতা কতটা মেলে ?
◆ কিছু কিছু অভিনেতা আছেন যাঁরা ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের ছবিতে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এঁরা বাজেট কম থাকলেও ভাল ছবির স্বার্থে প্রফেশনালি সহযোগিতা করেন। তবে, এঁদের সংখ্যা খুবই কম। একই কথা টেকনিশিয়ানদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে, এ ব্যাপারে Guild-এর আরও উদার হয়ে restrictions-এ ছাড় দেওয়া উচিত। ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মের ক্ষেত্রে Guild-এর উচিত আরও মানবিকতার সঙ্গে বিষয়টাকে handle করা।
(চলবে)