বন্দিশ ব্যান্ডিটস – সিজন ২-এর অপেক্ষায় সকলেই
একদিকে নাসিরুদ্দিন শাহের মতো কিংবদন্তী অভিনেতা, অন্যদিকে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতো প্রতিভাবানরা এবং সইফ আলি খান, মাধবন, অভিষেক বচ্চনের মতো তারকা ! এঁরা সকলেই এখন ওয়েব দুনিয়ায়। ভারতীয় বিনোদনে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মের রমরমার চিত্রটি মোটামুটি এখান থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ক্রাইম আর সেক্স ছাড়া ওটিটি-তে আর কিছু নেই, নিন্দুকেরা একথা যতই বলুক, বিনোদনের এই নতুন মাধ্যম যে বেশ ধাক্কা দিয়েছে সিনেমা ও টিভির বাণিজ্যে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আদতে অতিমারী-সময়ে বেশ কিছু ছবি তো মুক্তিই পেল এই প্ল্যাটফর্মে। টিভির অনুষ্ঠানগুলিও দেখানো হচ্ছে এখানে। প্রত্যেক চ্যানেলের রয়েছে নিজস্ব স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম।
প্রসঙ্গত, এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে প্রথমেই যে নাসিরুদ্দিন শাহের নামটা মনে এল, তার কারণ একজন বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে আমি প্রথম যে ভারতীয় ওয়েব সিরিজ দেখে একেবারে আপ্লুত হয়ে যাই, সেটা প্রাইম ভিডিওতে প্রদর্শিত ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ এবং সেখানে নাসিরুদ্দিনের অভিনয়। প্রেক্ষিত একেবারে আলাদা হলেও এই সিরিজ দেখতে দেখতে একদা দূরদর্শনে প্রদর্শিত ‘মির্জা গালিব’ ধারাবাহিকের কথা মনে পড়ছিল। এরই সঙ্গে বলবো, ১৯৮৮’র গুলজার পরিচালিত ‘মির্জা গালিব-কে ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ প্রসঙ্গে স্মরণে আনার জন্য নিশ্চয়ই বাহবা জানাতে হয় পরিচালক আনন্দ তেওয়ারিকেও। থিয়েটার ও সিনেমার এই প্রতিভাবান তরুণ অভিনেতা কাজ করেছেন বিক্রমাদিত্য মোতোয়ানির ‘উড়ান’, রাকেশ রোশনের ‘কাইটস’ ও আরও বেশ কিছু ছবিতে। ১০ পর্বের এই ওয়েব সিরিজে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন চিরাচরিত প্রাচীন ও নবীনের যে সংঘাত, তাকেও কত সংযত, সৃষ্টিশীল এবং ইতিবাচক আঙ্গিকে দেখানো যেতে পারে। সচরাচর এসব ক্ষেত্রে সস্তা মেলোড্রামার প্রয়োগই বেশি চোখে পড়ে আমাদের ।
প্রাইম ভিডিওতে প্রদর্শিত এই সিরিজে প্রজন্মগত পার্থক্য ছাড়াও রয়েছে সংগীতের দুটি ঘরানার লড়াই, যার মধ্যে আবার প্রচ্ছন্ন সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সেই সূত্রেই মান-অভিমানের রসায়ন। মান-অভিমান থেকেই চ্যালেঞ্জ, শত্রুতা, ভুল বোঝাবুঝি। অসাধারণ চিত্রনাট্যে বিষয়টিকে স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে যান পরিচালক। কাহিনী অমৃতপাল সিং বিন্দ্রা, লারা চাঁদনি ও পরিচালক স্বয়ং। স্ক্রিনপ্লে অমৃতপাল সিং বিন্দ্রা। শুরু থেকেই সিরিজের লেখক টিমের কাছে খুব পরিষ্কার ছিল, দর্শককে কি তাঁরা বলতে চান, সেই বার্তা। এছাড়াও অসাধারণ লোকেশন, প্রতিটি দৃশ্য রচনার ক্ষেত্রে ডিটেলিং, ঝকঝকে ক্যামেরা, স্মার্ট এডিটিং― মনে হবে হলে বসে সিনেমা দেখছেন।
শুধু গান শোনার জন্যই ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ দেখা যায়। শঙ্কর-এহসান-লয়ের অসাধারণ এক-একটি কম্পোজিশন, সঙ্গে কিছু প্রচলিত প্রাচীন গানের ব্যবহারও আছে। অন্যদিকে পপ মিউজিক ! সেখানেও চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব। গানগুলি গেয়েছেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, ফরিদ হাসান, মহম্মদ আমন, মামে খান, রবি মিশ্র, শঙ্কর মহাদেবন, জাভেদ আলি, শিভম মহাদেবন, জোনিতা গান্ধী, প্রতিভা সিং বাঘেল ও অরমান মালিক। শিল্পী নির্বাচনে এতটুকু ত্রুটি রাখেননি শঙ্কর মহাদেবন টিম। প্রত্যেকে তাঁদের গানের প্রতি সুবিচার করেছেন। গান লিখেছেন দিব্যাংশু মালহোত্রা, তানিষ্ক এস নবর ও সমীর সামন্ত। সংগীতনির্ভর সিনেমা বা মেগা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আগেও হয়েছে। কিন্তু তার সবগুলি উত্তরণে পৌঁছয় না। আসলে বিষয়টা এখানে মূল নাটকের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি দৃশ্যপট রচনায় গান অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে।
নাতি রাধের (ঋত্বিক ভৌমিক) ওপরেই পন্ডিত রাধেমোহন রাঠোরের ভরসা। তাঁর সৃষ্ট ঘরানাকে পরম্পরায় এগিয়ে নিয়ে যাবে রাধে। দিবারাত্র তাই নিয়েই চলছে সাধনা। রাধে জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও দাদুর আদর্শ অনুসারী। তার সংগীত ভাবনা সেই সূত্রেই কিছুটা ঐতিহ্যবাহী, প্রথাগত, প্রাচীন ও রক্ষণশীল। এহেন রাধের সঙ্গে পপ সেনসেশন তমান্না শর্মার (শ্রেয়া চৌধুরী) পরিচয় হওয়ার পর কী কী ঘটে, তাই নিয়ে এই সিরিজের মূল কাহিনী আবর্তিত। তবে, তারও আগে কিছু ঘটনা-পরম্পরা আছে, যা মূল কাহিনীর গতিপ্রকৃতিকে বার বার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে পন্ডিত রাধেমোহনের অতীত এসে হানা দেয়।
স্ত্রী ও প্রথম সন্তানকে ছেড়ে স্থান পরিবর্তন করে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেছিলেন তিনি একদা। দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ এবং সেই সূত্রে প্রাপ্ত সন্তানদের নিয়েই এখন দিনযাপন তাঁর। সময় এগিয়েছে। রাধেমোহনের সম্মান, প্রতিপত্তি বেড়েছে। প্রথম পক্ষের ছেলে দিগ্বিজয় (অতুল কুলকার্নি ) কিন্তু ভোলেনি মায়ের অসম্মান এবং তার প্রতিও বাবার অবহেলা। দিগ্বিজয় নিজেও একজন প্রথিতযশা শাস্ত্রীয়সংগীত শিল্পী। মায়ের হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার ও তার পাশাপাশি পন্ডিত রাধেমোহনের ঘরানাকে প্রতিহত করা দিগ্বিজয়ের লক্ষ্য। রাধেমোহনের অতীতের আরও কিছু ভুল পদক্ষেপও আছে কাহিনীর আবর্তে ! এক আসরে তাঁর থেকেও ভালো গেয়ে উপস্থিত শ্রোতার নজর কেড়ে নেওয়া মোহিনীকে (শিবা চাড্ডা) পুত্রবধূ করে ঘরে আনেন রাধেমোহন। উদ্দেশ্য মোহিনীর গান চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। কারণ ঈর্ষা, যার থেকে রাধেমোহনের মতো শিল্পীও মুক্ত নন।
অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের কন্যা মোহিনী ছিল দিগ্বিজয়ের প্রেমিকা। সেই বাবদও রাধেমোহনের প্রতি যথেষ্ট শত্রুতা পোষণ করে দিগ্বিজয়। কিন্তু শুধুই কি শত্রুভাব ? দিগ্বিজয় যে তার বাবার কাছে স্নেহের স্বীকৃতিটাও চায়। এই সংকটের জায়গাগুলিতে নাসিরুদ্দিন ও অতুল দু’জনেই হৃদয়স্পর্শী। রাধেমোহনের এ পক্ষের দুই ছেলে রাজেন্দ্র ও দেবেন্দ্র নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুণী হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে বাবার বিরাগভাজন। রাধেমোহনের সব প্রত্যাশা এখন নাতি রাধেকে ঘিরে ! এটাই কোথাও এক বাড়তি চাপ যেন রাধের। এরই সঙ্গে সাংসারিক কারণে আর্থিক টানাপোড়েনেও জর্জরিত এই তরুণ।
এবার তমান্নার কথা। তার মা পরিবারের বাইরে অন্যত্র থাকে পেশাগত কারণে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মায়ের সঙ্গে তমান্নার মানসিক দূরত্ব, এর থেকেই কোথাও সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বাবাই তার আশ্রয় ও প্রশ্রয়। রাধের সঙ্গে তমান্নার পরিচয় হয় বিচিত্র পরিস্থিতিতে। সাংগীতিক প্রেক্ষিতে দুজনের একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান। তবু একে অপরের গুনগ্রাহী হয়ে ওঠে ও পরে হৃদয় বিনিময়। একটা বিষয় উল্লেখ্য, এই যে সংগীতের বিপরীতমুখী চলন, অথচ পারস্পরিক শ্রদ্ধা, এই দিকটি বড় সুন্দরভাবে চিত্রনাট্যে অভিব্যক্ত। গানের ব্যান্ড ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ রাধে-তমান্নার স্বপ্ন, যা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায়।
আইএমডিবি রেটিংয়ে ৮.৭ পায় সিরিজের প্রথম সিজন। সেদিক থেকে প্রযোজক ও আমাজন প্রাইম উভয়ের পক্ষেই সিজন ২ নিয়ে না ভাবার কোনও কারণ নেই। সে বিষয়ে খুব নিশ্চিত খবর অবশ্য এখনও সেভাবে জানা যায়নি। শোনা যাচ্ছে, চিত্রনাট্য নাকি অনেক আগেই প্রস্তুত। একটা সময় এমন খবরও বাতাসে উড়ছিল, ২০২১-এই স্ট্রিমিং হবে ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ সিজন ২-এর। কিন্তু হলো না। বস্তুত, শুটিংয়ের খবরও সেভাবে নেই বাজারে। অতিমারী এর একটা কারণ হলেও হতে পারে। হয়তো ২০২২-এ স্ট্রিমিং হবে। তবে, তার আগে প্রথম সিজন এখনও যাঁরা দেখেননি, তাঁদের খুব তাড়াতাড়ি দেখে নেওয়ার পালা ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ সিজন ১।
অভিনয়ে আরও আছেন, রাজেশ তাইলাং, অমিত মিস্ত্রি, কুনাল রায় কাপুর, রাহুল কুমার, ত্রিধা চৌধুরী, ঋতুরাজ সিং ও মেঘনা মালিক। প্রত্যেকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। অভিনয়ও এই সিরিজের সম্পদ। নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন অতুল কুলকার্নি ও শিবা চাড্ডা। মুখ্য দুই চরিত্রে নবাগত ঋত্বিক ও শ্রেয়াও বেশ পরিণত অভিনয় করেছেন। প্রসঙ্গত, প্রত্যেক অভিনেতা, যাঁদের লিপে গান আছে বা যাঁরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে এর অভ্যাস করেছেন। অর্থাৎ কর্মশালায় অংশ নেওয়ার মতোই এক প্রক্রিয়া। ‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ সব অর্থেই এক ব্যতিক্রম ওয়েব দুনিয়ায়। আপাতত তীব্র অপেক্ষা পরের সিজনের।
♦️ ছবি সৌজন্যে গুগল