বিতর্কের মাঝেই মুক্ত ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড এক ভিন্নমাত্রায় অবলোকন। সেই ভিন্ন ভাবনা নিয়েই পরিচালক রাজকুমার সন্তোষী নির্মাণ করেছেন ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
মহাত্মা গান্ধী নামটাই এদেশের মানুষের ক্ষেত্রে এমন স্পর্শকাতর যে, যতবার এই নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে, বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এটাও ঠিক তাঁর যাপন ও রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল সেই বিতর্কের বীজ। এটাও ঠিক, শুধু ভারতবর্ষ নয় বা শুধু রাজনীতির জগৎ নয়, সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে মহাত্মা গান্ধী একটি নাম। আর সবকিছুর পর ওঁর জীবনের পরিণতি ! জাতির জনক গান্ধীজির খ্যাতির সঙ্গে চিরকাল জড়িয়ে রইলো একজন আম ভারতবাসীর নাম। গান্ধীজিকে হত্যার অপরাধে কুখ্যাত হয়ে রইলেন নাথুরাম গডসে। চরম নাটকীয় সেই ঘটনাকে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের অধ্যায় বলে অভিহিত করা হয়েছে সংগত কারণেই।
সেই ঘটনারই এক অন্য অভিমুখ নিয়ে পরিচালক রাজকুমার সন্তোষীর ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’ মুক্তি পেয়েছে গতকাল, ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসে। ছবিতে বিষয়টি এসেছে এইভাবে, গডসের আক্রমণে মৃত্যু হবে না মহাত্মার। তিনি বেঁচে যাবেন। এদিকে ধরা পড়ে যাবে গডসে। এরপর কারাগারে বন্দি গডসের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন মহাত্মা। সেখানে দুজনের মধ্যে যে কথোপকথন বা তর্ক, তার ওপরেই বিন্যস্ত ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’ ছবির চলন। একজন সিনেমা নির্মাতা তাঁর নিজস্ব ভাবনার প্রেক্ষিতে কোনও একটি ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা, আঙ্গিক, পরিভাষা নিয়ে আসতেই পারেন পর্দায়। তবে, গান্ধীজির মতো মানুষ, তাঁর হত্যার ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরি এই নতুন অবলোকন দর্শক কতটা গ্রহণ করেন, সেটাই দেখার।
অভিনয়ে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকায় আছেন দীপক এন্টনি। দীপক একজন ভার্সাটাইল অভিনেতা ও পরিচালক। শোনা যায়, চেহারার সাদৃশ্য হেতু, মহাত্মার ওপর তৈরি অজস্র স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, টিভি সিরিয়াল এবং তথ্যচিত্রে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন এই সংক্রান্ত একাধিক নাটকেও। বিষয়টা উল্লেখযোগ্য নিঃসন্দেহে। তবে, শুধু চেহারায় সাদৃশ্য থাকলেই তো চলে না ! অভিব্যক্তি, শরীরী অভিনয়–সবক্ষেত্রেই দীপক নিজেকে অপরিহার্য প্রতিপন্ন করেছেন বলেই বারবার নির্মাতারা তাঁকে এই চরিত্রে ভেবেছেন।
মারাঠি বিনোদন দুনিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম চিন্ময় মন্ডলেকর। তাঁর অভিনয়ে নাথুরাম গডসে যে সঠিক মাত্রা পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চিন্ময় অভিনয়ের পাশাপাশি একজন লেখক, পরিচালকও বটে। থিয়েটারের সঙ্গে তাঁরও নিবিড় সম্পর্ক। মারাঠা সিনেমায় নিজের কাজের স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি তিনি হিন্দি টিভির হিট ক্রাইম সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’-এও অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি পর্বে। দীপক ও চিন্ময় ছাড়া ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’-এ অভিনয় করেছেন পবন চোপড়া (নেহরু), আরিফ জাকারিয়া (আচার্য কৃপালনি) প্রমুখ। ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন এ আর রহমান। যথেষ্ট যত্ন ও যথাযথ মর্যাদায় যে ছবিটি বানিয়েছেন রাজকুমার সন্তোষী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এক শ্রেণীর ট্রেড বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এ ছবি বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে। আবার এর বিরুদ্ধ কথাও উঠছে।
লাভক্ষতির বিষয় বোঝা যাবে, দুয়েকদিনের মধ্যেই। আগে দেখা যাক, কী পরিমাণ আলোচনা-বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই ছবিকে ঘিরে ! প্রযোজনা মানিলা সন্তোষী। আসঘর ওয়ার্সি ও রাজকুমার সন্তোষী–দুজনে মিলে লিখেছেন ছবির চিত্রনাট্য। প্রশ্ন হলো ‘দামিনী’, ‘ঘায়েল’, ‘আন্দাজ আপনা আপনা’, ‘ঘাতক’, ‘খাকি’ ইত্যাদির মতো সুপারহিট কমার্শিয়াল ছবির পরিচালক প্রায় এক দশক (৯ বছর) পরে ফিরলেন, তাও এমন এক বিষয় নিয়ে ? এটা ঠিক, তিনি ‘লেজেন্ড অফ ভগৎ সিং’-এর মতো বায়োপিকও বানিয়েছেন, বেশ সাফল্যের সঙ্গেই। তবে, সেখানে বিষয়টা এতখানি স্পর্শকাতর ছিল না।
‘গান্ধী গডসে এক যুধ’ নির্মাণের পিছনে সন্তোষী মূল যে কারণ বলেছেন, সেটা হলো, গান্ধীকে হত্যার পিছনে নাথুরাম গডসের যে মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল সেদিন, সেটাই দর্শকের সামনে নিয়ে আসা। ছবি ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধবার পরই একটি টিভি সাক্ষাৎকারে পরিচালক বলেন, “একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে আমার স্বতন্ত্র ভাবনা থাকতেই পারে। আমি নাথুরামের দৃষ্টিভঙ্গিটাও বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। যে কাজ তাঁকে সারা দেশের কাছে নিন্দনীয় করে তুলবে, সে কাজ জেনেশুনে কেন করেছিলেন এই মানুষটি, আমি সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এই ছবিতে।” এরই সঙ্গে সন্তোষী উল্লেখ করেছেন, নাথুরাম গডসের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা মানেই তাঁকে সমর্থন নয়, এটাও যাঁরা বিতর্ক সৃষ্টি করছে, তাঁদের বোঝা দরকার।
বিতর্ক ছড়ানো শুধু নয়। চলছে হুমকি, শাসানির মতো ঘটনাও। ছবির প্রচার উপলক্ষে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন ছবির প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে অভিনেতা, সেখানে সভা চলাকালীন একদল মানুষ এসে সভা পন্ড করে দেবার চেষ্টা করে। এটা ঘটেছে একাধিকবার। থিয়েটার হলগুলিতে অজানা লোকজনের কাছ থেকে ফোন আসছে, ছবি যেন সেখানে রিলিজ না করে। ছবির প্রচারে ব্যবহৃত হল বা অডিটোরিয়ামের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এই ঘটনা। সংবাদ মাধ্যমকে সন্তোষী জানিয়েছেন, “আমি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। আমি ও আমার পরিবার এবং ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন আক্রান্ত হতে পারেন যে কোনও সময়!” কংগ্রেস দল শুরু থেকেই এ ছবির বিপক্ষে। তারা ‘গান্ধী গডসে এক যুধ’-কে ব্যান করার দাবিতে সরব। সন্তোষীর আশা, এতকিছুর পরেও খোলা মনে দর্শক দেখবেন এই ছবি। আমরাও সেটাই আশা করবো। স্বাধীন দেশে সৃজনশীল মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাটুকু অন্তত থাকুক। নাহলে, সিনেমা বা অন্য যে কোনও শিল্পে নতুন ভাবনার জোয়ার আসবে কী করে ?