ভুলব না অটল টানেলের সেই যাত্রাপথ
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। নদী,পাহাড় আর অরণ্য মিলিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম হিমাচল প্রদেশ। তারই ঝলক এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব। লিখছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
কাসল ও মণিকরণের সৌন্দর্য মনের মণিকোঠায় ভরে চললাম মানালির উদ্দেশ্যে। এই যাত্রাপথও ভীষণ সুন্দর। যাকে বলে পিকচার পোস্টকার্ড ! প্রথমেই থামতে হল কুলু শাল ফ্যাক্টরিতে। এতদিন কুলুর শালের কথা খুব শুনেছি, কলকাতায় দেখেওছি। তাই আগ্রহ একটু বেশিই ছিল। কিন্তু গিয়ে হতাশ হলাম। জিনিসের যা দাম, তার সঙ্গে কোয়ালিটি একেবারেই মানানসই ছিল না। তা সত্ত্বেও উপহারের জন্য দু একটা স্টোল, চাদর নিলাম। রাস্তায় কিছু ড্রাই ফ্রুটের দোকানও ছিল। কিন্তু আর দরদাম করার সাহস হলো না। রাস্তার দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলার মাঝেই গাড়ির চালক দেখালেন প্যারাগ্লাইডিং, রিভার র্যাফটিং-এর মতো স্পোর্টস স্পট। যদিও আমরা তাতে একেবারেই আগ্রহী ছিলাম না বলে সোজা চলে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ মানালি মলে ঘোরাঘুরি করার জন্য গেলাম। কিন্তু তীব্র ঠান্ডায় কাঁপুনি দিচ্ছিল। গুগলে দেখলাম, তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি। তাই বেশিক্ষণ বাইরে না থেকে ফিরলাম হোটেলেই।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম স্থানীয় কিছু আকর্ষণীয় জায়গা দেখার জন্য। প্রথমেই গেলাম বশিষ্ঠ মন্দিরে। কাঠের কারুকাজ করা খুবই সুন্দর মন্দির। পুরাণ মতে, বশিষ্ঠ মুনি হলেন রঘুবংশের কূল পুরোহিত। তিনি মানালি থেকে কিছুটা দূরের যে গ্রামে তপস্যা করেছিলেন, তার নাম বশিষ্ঠ গ্রাম। সেখানেই গড়ে উঠেছে বশিষ্ঠ আশ্রম। আশ্রমে আছে বশিষ্ঠ মুনির কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি। এখানেও আছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা স্নানের ব্যবস্থাও আছে। বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমের পাশ দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে একটু ওপরে আছে রামচন্দ্রের মন্দির। সেই মন্দিরে রামচন্দ্র ছাড়াও আছেন সীতা ও লক্ষণ।
পরবর্তী গন্তব্য ছিল হিরিম্বা দেবীর মন্দির। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে পৌঁছলাম সেখানে। মন্দিরে যাওয়ার পথটা সত্যিই খুব সুন্দর। বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলে বড় বড় পাইন ও দেবদারু গাছে ঘেরা জায়গায় গড়ে উঠেছে প্যাগোডার আদলে তৈরি কাঠের এই মন্দির। হিরিম্বা রাক্ষসী হলেও স্থানীয় লোকেদের কাছে তিনি দেবী হিসেবেই পূজিত হন। কারণ তিনি ছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব ভীমের স্ত্রী। মহাভারতের কাহিনি বলছে, ভীম তাঁর শর্তমতো সন্তান হওয়ার পর হিরিম্বাকে ছেড়ে চলে গেলে, একা হাতে হিরিম্বা তাদের সন্তান ঘটোৎকচকে বড় করেন। তাকেও বাবা ভীমের মতো যোদ্ধা রূপে গড়ে তোলেন। মহিলা হিসেবে তাঁর এই কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে তামাম মহাভারত পাঠক, থুড়ি, হিন্দু পুরানভক্ত অগণিত মানুষ।
বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর মন্দির দর্শন করলাম। ভিতরে আছে হিরিম্বার পিতলের মূর্তি আর পাথরের ওপর বিষ্ণুর পায়ের ছাপ। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর ঘটোৎকচের মন্দিরে যাওয়া হলো না। তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। এরপর গেলাম টিবেটান মনাস্ট্রিতে। এটি মানালি মলের খুব কাছেই এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। কুলু ও মানালিতে প্রচুর তিব্বতীদের বাস। সেই কারণেই গড়ে উঠেছে একাধিক মনাস্ট্রি। তার মধ্যে এটি হলো অন্যতম। মনাস্ট্রি ঘুরে দেখলাম। শান্ত পরিবেশ। সঙ্গে তিব্বতী কারুকার্যের নিদর্শন দেখার অনন্য অভিজ্ঞতা। আশপাশে কিছু দোকানও আছে। সেখান থেকে হাঁটা পথে মানালি মলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, দু চারটে জিনিস কিনে হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন সকালে রওনা দিলাম সোলাং ভ্যালি ও শিশু ভ্যালির উদ্দেশ্যে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর, ড্রাইভার এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালেন। সেখান থেকে ভাড়া করা পোশাক, জুতো, গ্লাভস পরে নিলাম। হেতু ঠান্ডা প্রতিরোধ–এরপর অনেকটা উঁচুতে ওঠার পালা রয়েছে। মানালি থেকে শিশু ভ্যালি যাওয়ার সময় আরেকটা কারণে খুব এক্সাইটেড ছিলাম। যাওয়ার পথে পড়বে অটল টানেল। ১০ হাজার ফুট ওপরে পাথর কেটে প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল যাঁরা বানিয়েছেন, সেই সব ইঞ্জিনিয়ার বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মীদের কুর্নিশ জানাতেই হয়। টানেলে ঢোকার পর মনে হলো, এ যেন এক স্বপ্নপুরী ! সাউথ পোর্টাল থেকে নর্থ পোর্টাল–মনে হবে দুই ভিন্ন রাজ্য।
এই প্রেক্ষিতে অটল টানেল সম্পর্কে কিছু তথ্য জানাই। হিমাচল প্রদেশের জাতীয় সড়ক ৩-এ হিমালয়ের পূর্ব পীরপাঞ্জাল রেঞ্জে তৈরি হয় অটল টানেল। ২০০০ সালের জুন মাসে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এই টানেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ২০০২ সালে তিনি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রাথমিকভাবে এই টানেলের নাম করা হয়েছিল রোহটাং টানেল। তারপর নানা কারণে টানেলের কাজের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য, এই কাজে গতি আনার ওপর জোর দেন। কাজ শেষ হওয়ার পরে ২০১৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মোদিজি টানেলের উদ্বোধন করে, তার নাম দেন অটল টানেল। প্রসঙ্গত বলা যায়, ২৫শে ডিসেম্বর অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিন। তাঁকে সম্মান জানাতেই এই নামকরণ।
অটল টানেল থেকে বেরিয়েই দেখলাম বরফ জমা চন্দ্রভাগা। চারপাশে এত বরফ দেখে ড্রাইভারকে বললাম কিছু ছবি তুলে দিতে। ছবি তুলে দিয়ে তিনি বললেন, এর চেয়েও বেশি বরফ দেখবেন শিশু ভ্যালিতে। অটল টানেল থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরলে পৌছনো যায় রোটাং পাস। কিন্তু সে সময় রোটাং পাস বন্ধ থাকার কারণে আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরলাম। মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌছে গেলাম শিশু ভ্যালি। সত্যি বরফ দেখে চোখ সার্থক হলো। বয়স যেন কমে গেল অনেকটা। শিশু ভ্যালিতে শিশুদের মতো কিছুক্ষণ বরফে মাতামাতি করলাম। মোবাইলে তোলা ছবিতে মন ভরল না। স্থানীয় এক ফোটোগ্রাফারকে দিয়েও ছবি তোলালাম। পাশেই আছে শিশু লেক। সেখানে স্পোর্টসের ব্যবস্থাও আছে।
এতক্ষণ প্রকৃতি দেবী খুবই সদয় ছিলেন। সকাল থেকেই ভাল রোদ ছিল। বরফে ঘোরাঘুরি করার পর একটা দোকানে কফি খাওয়ার জন্য বসতেই দেখি বেশ মেঘ করে এসেছে। কফি শেষ হওয়ার আগেই শুরু হলো স্নো ফল। যদিও ভাড়া করা জাবদা পোশাকের জন্য শীত তেমন কাবু করতে পারল না। একরাশ ভালো লাগা সঙ্গী করে ফের অটল টানেল হয়ে ফিরলাম সোলাং ভ্যালিতে। যদিও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ার জন্য আর নামা হলো না, গাড়ি থেকেই দেখলাম। ফেরার পথে ভাড়ার পোশাক ফেরত দিয়ে হোটেলে এলাম।
হিমাচলে সেদিনই ছিল শেষ রজনী। রাতে গোছগাছ করে নিলাম। পরদিন প্রায় ৯ ঘন্টা জার্নি করে পৌঁছলাম চণ্ডীগড়। একরাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন ফের বিমানে করে কলকাতায় ফিরলাম।
◆ কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে বিমানে গেলে দিল্লি কিংবা চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে নামতে হবে। দিল্লি থেকে ট্রেনে কালকা যেতে হবে। সেখান থেকে শিবালিক এক্সপ্রেস কিংবা গাড়িতে সিমলা পৌঁছতে পারেন। এছাড়া দিল্লি থেকে সিমলা ও মানালি যাওয়ার বাস ছাড়ে। আবার চন্ডীগড় থেকেও বাস ছাড়ে সিমলা যাওয়ার। সাড়ে তিন ঘন্টার মতো সময় লাগে। কলকাতা থেকে কলকাতা-দুরন্ত কিংবা রাজধানী এক্সপ্রেস অথবা কালকা মেল–যে কোনও ট্রেনে সুবিধামতো যেতে পারেন। কালকা মেলে প্রায় দু রাত কাটাতে হয়। আর রাজধানী এক্সপ্রেসে ১৭ ঘন্টা মতো লাগে দিল্লি যেতে।
◆ কোথায় থাকবেন?
প্রতিটি জায়গার জন্য আলাদা হোটেল বুক করতে হবে। খরচ নির্ভর করবে, হোটেলের সুবিধার ওপরে। বেশি দামের হোটেল যেমন আছে, তেমনি, কম খরচের হোটেলও আছে। কোথাও ২৪ ঘন্টা গরম জল, ব্রেকফাস্ট, ডিনার কমপ্লিমেন্টারি থাকে। আবার কোথাও শুধু থাকা যায়। সেখানে সব খাবার কিনে খেতে হয়। কাজেই আপনার প্রয়োজন/পছন্দের ওপর নির্ভর করবে খরচ। বেড়ানোর অ্যাপ ডাউনলোড করে যদি বুকিং করেন, তাহলে ‘Pay at Hotel’ অপশন চয়েজ করবেন। হোটেলে পৌঁছে আগে নরমাল বুকিং করলে কী সুবিধা পাবেন, জেনে নেবেন। সুবিধা পেলে অ্যাপ থেকে বুকিং ক্যান্সেল করে দেবেন। অন্যথায় সাধারণ নিয়মের বুকিংয়ের পথ তো আছেই।
◆ খরচখরচা
পাহাড়ে বেড়াতে গেলে বাজেটের ক্ষেত্রে থাকা-খাওয়া, ট্রেন, ফ্লাইট, হোটেলের খরচ ছাড়াও গাড়ি ভাড়ার কথা বিশেষভাবে মাথায় রাখা দরকার। নিজেদের মতো করে সাইট সিয়িং করতে চাইলে আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সেক্ষেত্রে সিমলা থেকে মানালি যাওয়ার খরচ কমপক্ষে ছ’হাজার টাকা। তেমনি মানালি থেকে শিশু কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। মোটের ওপর গাড়ি ভাড়া ১৫ হাজার ধরে রাখতে হবে। তার কিছু বেশিও হতে পারে।
ছবি : লেখক