Saturday, May 18, 2024
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

অসাধারণ অম্বর ফোর্ট

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। রাজস্থান ডায়েরি লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

রাজকীয় সজ্জায় সুসজ্জিত অভিজাত বিলাসবহুল ট্রেন ‘প্যালেস অন হুইলস’-এর উল্লেখ দিয়ে শেষ করেছিলাম ডায়েরির প্রথম পর্ব। এবার বিস্তারে যাব। তার আগে কিছু জরুরি তথ্য। দু-বার রাজস্থান ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে আমার। প্রথমবার ১৯৮৯ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০৩ সালে। হাওড়া এবং শিয়ালদা থেকে নানান বাজেটের প্রচুর ট্রেন দিল্লী যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থান ভ্রমণের জন্য দিল্লী হয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক। এছাড়া বাসে বা গাড়িতে সরাসরি পৌঁছনোর উপায় তো আছেই। কলকাতা থেকে ভায়া আমেদাবাদ বা দিল্লীর সঙ্গে জয়পুর, উদয়পুর, যোধপুরের উড়ান যোগাযোগ আছে।

এবার আসা যাক ভ্রমণ ডায়েরিতে–

১ম দিন

সে বছর দুর্গাপুজোর আগে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হাওড়া স্টেশন থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পরদিন সকালে দিল্লী পৌঁছলাম আমরা। একরাত দিল্লিতে কাটিয়ে পরদিন সকালে পুরনো দিল্লি স্টেশন থেকে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যমন্ডিত ট্রেন পিঙ্ক সিটি এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম রাজস্থানের রাজধানী পিঙ্ক সিটি জয়পুরের উদ্দেশে। ঐতিহাসিক, কারণ, পিঙ্ক সিটি এক্সপ্রেস ভারতের প্রথম মিটার-গেজ ট্রেন! এখন অবশ্য আর এই ট্রেনের অস্তিত্ব নেই। মিটার-গেজ রেলে স্পিড কম হওয়ায় দিল্লী থেকে জয়পুর ৩০৮ কিমি রেলপথ অতিক্রম করতে সেবার প্রায় ছ’ঘন্টা সময় লেগে গেল আমাদের।

এবারের গন্তব্য ছিল জয়পুর, উদয়পুর, মাউন্ট আবু, যোধপুর, জয়সলমির। জয়পুর, উদয়পুরে থাকার জন্য আমরা রাজস্থান ট্যুরিজম-এর লজ বুক করেছিলাম। বাকি জায়গাগুলোর জন্য প্রাইভেট হোটেল। জয়পুর স্টেশনে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে লজে যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে। সবাই ক্ষুধার্ত। দ্রুত স্নান সেরে তৈরি হয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। রিসেপশনে আগেই গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখা ছিল। দুপুর তিনটে নাগাদ জয়পুর থেকে ১১ কিমি দূরে পুরনো রাজধানী অম্বর প্যালেস (ফোর্ট)-এর দিকে রওনা দিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়লো সাজানো ছবির মতো দৃশ্যমান অসাধারণ অম্বর ফোর্ট । বুঝলাম কেন জয়পুর পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ  অম্বর ফোর্ট !

আরাবল্লী পাহাড়ের ওপরে প্রায় দেড়হাজার ফুট উচ্চতায় অম্বর ফোর্টে ওঠার জন্য জিপ বা শক্তপোক্ত গাড়ি প্রয়োজন। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে পাথরের তৈরি রাস্তা ধরে পদব্রজেও অনেকে যান। এছাড়া হাতির পিঠে চেপে ওপরে যাবার ব্যবস্থাও আছে। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমরা হাতির পিঠে সাজানো রঙিন হাওদায় বসে চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পাঁচটা সিংহদুয়ার পেরিয়ে পৌঁছলাম রাজপ্রাসাদের দরজায়। রাজপুত স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন মাওটা লেকের কোলে নির্মিত অম্বর ফোর্ট। ১৭২৭ সালে জয়পুরে স্থানান্তরের আগে পর্যন্ত অম্বর ছিল কাছাওয়া রাজপূতদের রাজধানী। ১৫৫২ সালে মহারাজ মান সিং এই দুর্গের কাজ শুরু করেন। কাজ সমাপ্ত হয় মহারাজ সওযাই জয় সিংহের আমলে। জয় সিংহের নাম অনুসারেই জয়পুর শহরের নামকরণ হয়েছে।

নিরাপত্তার কারণে কত ভাবনাচিন্তা, পরিকল্পনা করে ফোর্ট নির্মাণ করা হয়, অম্বর ফোর্টে ঘুরতে ঘুরতে সেইকথাই মনে হচ্ছিল। দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস (জয় মন্দির) ছাড়াও রয়েছে জেনানা মহল, শিশমহল, সোহাগ মন্দির ইত্যাদি। সবকিছুই সুসজ্জিত এবং সুপরিকল্পিত। শিশমহল অর্থাৎ কাঁচের মহলের অভিনবত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চারপাশের দেওয়াল, ছাদ, মেঝে, ওপরে, নিচে লাল-সবুজ-কমলা রঙের আয়না এমনভাবে লাগানো আছে, যাতে একটা বাতিতে লক্ষ রঙের বাতি প্রতিফলিত হয়। সত্যি কথা বলতে কী, অম্বর ফোর্টে এত কিছু দেখার আছে, যে, সবকিছু ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আছে কৃষ্ণ মন্দির ও গড়ুর মন্দির।

তবে, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যশোরেশ্বরী মাতা শিলাদেবীর মন্দির–একটি শিলায় খোদিত শক্তির প্রতিমূর্তি অষ্টভূজা দেবী দুর্গা (মা কালী)। এই দেবীমূর্তিকে ঘিরে কিছু প্রচলিত পৌরাণিক ঘটনা এবং কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা জুড়ে আছে। পুরাণ অনুযায়ী মথুরার কারাগারে কংসরাজ ভগিনী দেবকীর সন্তানদের যে শিলায় আছাড় মেরে হত্যা করে, এটা সেই শিলা। সবশেষে যোগমায়াকে বধ করার সময় শিলা থেকে অষ্টভূজা দেবীর আবির্ভাব হয়। এরপরে মথুরাতেই শিলারূপে দেবীর অধিষ্ঠান ছিল। পরে  যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য মথুরা থেকে ওই শিলাখন্ড যশোরে নিয়ে এসে দেবীমূর্তি গড়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন যশোরেশ্বরী মন্দিরে। সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাধ্যক্ষ মহারাজ মান সিং বাংলা অভিযানে গিয়ে জয়লাভ করে যশোর থেকে দেবী যশোরেশ্বরীকে নিয়ে এসে অম্বর রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করেন। নির্মাণ করেন মার্বেল পাথরের ওপরে সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত দৃষ্টিনন্দন মাতা শিলাদেবী মন্দির, যিনি শক্তি সাধনার প্রতীক।

(চলবে)

# ছবি : লেখক