যোধপুরে দেখতেই হবে মেহরানগড় ফোর্ট প্যালেস আর উমেদভবন প্যালেস
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। রাজস্থান ডায়েরি লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ ষষ্ঠ পর্ব।
● ৬ষ্ঠ দিন
রাজস্থানের মরু অঞ্চলের শুরু যোধপুর থেকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে মহম্মদ ঘোরীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ ছেড়ে রাঠোর রাজপুতরা ‘ল্যান্ড অফ দ্য ডেড’ বা মাড়বারে চলে আসেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাঠোর রাজপুত যোধা রাওয়ের হাতে রাজধানী যোধপুরের গোড়াপত্তন হয়। যোধপুর রাজস্থানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। মরুভূমির গ্রাস থেকে বাঁচাতে বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় যোধপুর শহর। এখানে আছে আটটি প্রবেশদ্বার। যোধপুরে প্রচুর মন্দির ও দীঘি আছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও সগর্বে দাঁড়িয়ে বহু টুরিস্ট-স্পট। তবে, পর্যটক আকর্ষণের অবশ্য দ্রষ্টব্য তালিকায় মেহরানগড় ফোর্ট প্যালেস এবং উমেদভবন প্যালেস।
মেহরানগড় ফোর্ট তৈরি করেছিলেন রাঠোর যোধা রাও। গোদাগিরি হিলস-এর ওপরে ১২১ মিটার উচ্চতায় ১২০০ একর এলাকা জুড়ে বেলেপাথরের পাহাড়ে তৈরি এই দুর্গে রাজপ্রাসাদ, আমলাদের বাড়িঘর, সেনা নিবাস, দোকানপাট, মন্দির–সবকিছু রয়েছে। সুরক্ষার কারণে সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা অসাধারণ পরিকল্পনা ও স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই দুর্গ দেখেছিলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। নজরদারির জন্য প্রাচীরের বিভিন্ন কোণে স্তম্ভের ওপরে গোল এবং চৌকো গম্বুজ আছে। পাকদন্ডি পথে সাতটি গেট (পোল) পেরিয়ে ফোর্টের প্রবেশদ্বার। গগনস্পর্শী দুর্ভেদ্য মেহরানগড় দুর্গ দেখে অদ্ভুত শিহরণ জাগে। একসময়ের জমজমাট মেহরানগড় ফোর্ট এখন সমৃদ্ধ মিউজিয়ামে রূপান্তরিত। রাজপরিবারের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-আশাক, মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট ইত্যাদি নানান উল্লেখযোগ্য জিনিসে সুসজ্জিত মিউজিয়াম। অসাধারণ নান্দনিকতায় রাজকীয় বৈভবে আকর্ষণীয় মহারাজার দেওয়ান-ই-আম বা মোতিমহলে রক্ষিত ৮০ কেজি সোনায় অলংকৃত পাথরের করোনেশন থ্রোন। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, অলংকরণ, বৈভবে অনবদ্য এই প্রাসাদদুর্গ। রাজপ্রাসাদের কারুকার্য শোভিত শিসমহল, ফুলমহলে ঘুরতে ঘুরতে মন চলে যায় ইতিহাসের অলিন্দে। গড়ের ওপর থেকে দৃশ্যমান পুরো যোধপুর শহর। দুর্গের পাদদেশে শিল্প সৌকর্যে অনুপম মহারাজা যশোবন্ত সিং ২-এর থাডা বা ছত্তিশ। প্রসঙ্গত, মেহারনগড় ফোর্টে বহু বলিউডি এবং হলিউডি সিনেমার শুটিং হয়েছে।
যোধপুরের আর এক মূল আকর্ষণ শহরপ্রান্তে ছাত্তার হিলে ইতালিয়ান প্রযুক্তি এবং ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচারে নির্মিত পৃথিবীর বৃহত্তম রাজপ্রাসাদগুলির অন্যতম উমেদভবন প্যালেস। মহারাজা উমেদ সিংয়ের নামাঙ্কিত এই প্রাসাদ তিনটি ভাগে বিভক্ত। একটা অংশে রাঠোর রাজপরিবারের বসবাস। আরেক অংশে তাজ গ্রুপের বিলাসবহুল হোটেল, তাজ প্যালেস হোটেল। বাকি অংশে সমৃদ্ধ মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে সুরক্ষিত জিনিসগুলির অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন সময়ে রাজাদের ব্যবহৃত নানান মডেলের গাড়ি। মহারাজা উমেদ সিং এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রাসাদ শুরু করেন ১৯২৯ সালে। পর পর কয়েক বছর প্রচন্ড খরায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছিল যোধপুর অঞ্চলের গরীব চাষীদের জীবন। তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্যে এই প্রোজেক্ট শুরু করে দুঃস্থ কৃষকদের লেবারের কাজে নিযুক্ত করেন মহারাজা উমেদ সিং। এই বিশাল রাজপ্রাসাদের কাজ শেষ হয় ১৯৪৩ সালে। সযত্ন পরিকল্পনা এবং স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত উমেদভবন প্যালেস হয়ে ওঠে পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ।
‘টাই এন্ড ডাই’ বা বাঁধনি এবং পাথর-সেটিং যোধপুরী জুতোর জন্য বিখ্যাত যোধপুর। স্মৃতি-উপহার হিসেবে দুটোই বেশ ভালো আইটেম। মেহরানগড় ফোর্ট থেকে বেরিয়ে আমরা লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। লাঞ্চের পরে উমেদভবন প্যালেস ঘুরতে ঘুরতে সূর্যদেব পশ্চিমে ঢলে পড়লেন। যোধপুর মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে এলাম আমরা । পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দেব যোধপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। আমাদের ফেরার টিকিট ছিল যোধপুর ভায়া দিল্লী হয়ে কলকাতা।
আগেই বলেছি, সেবার জয়সলমীর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সে সাধ পূর্ণ হলো বছর চারেক পরে রাজস্থানের রাজকীয় আভিজাত্য ও বৈভবে সাজানো ‘প্যালেস অন হুইলস’-এ ভ্রমণ করে। সেটা ছিল, সাত রাত-আট দিনের এক স্মরণীয় ট্রিপ। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রতি বুধবার সন্ধে সাড়ে ছ-টায় এই ট্রেন ছাড়ে দিল্লীর সফদরজং রেলস্টেশন থেকে। ফিরে আসে পরের বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায়। ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ এবং রাজস্থান টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের জয়েন্ট প্রোজেক্ট ‘প্যালেস অন হুইলস’। মূলত বিদেশী পর্যটক আকর্ষণের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রথম যাত্রা শুরু করে প্যালেস অন হুইলস এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিদেশী পর্যটকদের কাছে। আমাদের ট্রিপেও পঁচানব্বই শতাংশ ট্যুরিস্টই বিদেশী ছিলেন। রাজস্থানের রাজাদের বিলাসবহুল জীবন যাপন, খাওয়াদাওয়া, রুচি, সংস্কৃতি, বিনোদন–সবকিছুর ঢালাও আয়োজন সুসজ্জিত রেলের কামরাগুলিতে। প্যালেস অন হুইলস এর যাত্রাপথ–দিল্লী থেকে ছেড়ে জয়পুর, চিতোরগড়, উদয়পুর, জয়সলমীর, যোধপুর, ভরতপুর, আগ্রা হয়ে আবার দিল্লী। পরের সপ্তাহে থাকবে জয়সলমীরের কথা। সেও কম রোমাঞ্চকর নয় ! (চলবে)
ছবি : লেখক