Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। প্রতি মাসে একবার এই কলম প্রকাশিত হয়। এবারে প্রয়াত বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী নির্মলা মিশ্রকে নিয়ে বলেছেন দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায় । অনুলিখন সোমনাথ লাহা । তিনটি পর্বে লেখাটি প্রকাশিত হবে। আজ প্রথম পর্ব।

নির্মলা মিশ্র এমন একজন মানুষ, এমন একজন শিল্পী যাঁর বিপুল অবদান রয়েছে আমাদের বাংলা গানের জগতে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে, যাঁরা ভাল গান করেন, কোথাও তাঁদের গান শুনতে পেলে, নির্মলা মাসি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার পাশাপাশি উৎসাহ দেওয়া, সম্ভব হলে তাঁদের নিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানে গান গাওয়ানো–এগুলো সারাজীবন করেছেন। আমার ক্ষেত্রে তো বটেই, আমি তো তাঁকে একেবারে শৈশব থেকেই মাসি বলেই জানি, অন্যান্য নতুন শিল্পীদের পাশাপাশি পুরোনো দিনের শিল্পী, যাঁদের পরবর্তীকালে তেমন অনুষ্ঠান ছিল না, প্রচার ছিল না, তাঁদের নিয়ে এসেও গান গাওয়াতেন। অনুষ্ঠানের শেষে তাঁদের হাতে জোর করে টাকা গুঁজে দিতেন এবং তার পরিমাণ না দেখেই। নিজের ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যা টাকা পেতেন, সেটাই দিয়ে দিতেন। এতে নিজের কোন‌ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে কিনা, কখন‌ও ভাবতেন না।

Images 2 5 2
সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন 8

সত্যি কথা বলতে কী, এমন দরাজ কন্ঠে অন্য শিল্পীদের প্রশংসা করা একটা বিশাল গুণ। এটাই তো প্রকৃত শিল্পীমনের পরিচয়। সেটা সকলের থাকে না। নির্মলা মাসি খুব‌ই শিশুসুলভ একজন মানুষ ছিলেন। সিটি মারা, মজা করা, স্টেজে বসে কান ধরা। নিজের গান গাইতে গিয়ে হয়তো ভুলে গিয়েছেন। তখন নিজেই নিজের কান ধরতেন ভুল গাওয়ার জন্য। এত অসংখ্য গান গেয়েছেন–তাই ভুল হ‌ওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্য কেউ হলে হয়তো প্রতিক্রিয়াটা অন্যরকম হতো। কিন্তু নির্মলা মাসির মধ্যে কোনও ভাণ ছিল না। একবার তো মঞ্চের মধ্যেই জিভ কেটে আমায় বললেন, ”এই রে! পরের অন্তরাটা আগে গেয়ে ফেলেছি। কি হবে ?” আমি বললাম, “কিছুই না। এবার আগেরটা গেয়ে দাও।” নির্মলা মাসির সঙ্গে আমি অসংখ্য অনুষ্ঠানে মঞ্চ শেয়ার করেছি। স্বাভাবিকভাবেই পাশে বসে থাকার জন্য আমি এগুলো দেখতে পেতাম।

Img 20220731 Wa0059 2
সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন 9

ভুলটা সকলের সামনে স্বীকার করতে পারাও তো একটা বড় গুণ। মানুষ তো বড় হয় এই গুণগুলো নিয়েই। এগুলো মাসির থেকেই শিখেছি আমি। ‘৮০তে আসিও না’ ছবির ‘তুমি যদি ময়দা হতে জলখাবারে লুচি বেলতাম’ গানটি নির্মলা মাসির সঙ্গে আমার মঞ্চে গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে অসংখ্যবার–কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে। প্রত্যেকবার গানটা আমরা ভিন্নরকম ভাবে গাইতাম। তার কারণ, নির্মলা মাসি আর আমার গানটার টিউন মনে থাকত না। যেহেতু আমার আর নির্মলা মাসির wave length আর tuning সাংঘাতিক ভালো, তাই আমরা মাঝে নানারকম মজার dialogue বলতে বলতে গানটা গাইতাম। সেটা একটা বিশাল entertainment value হয়ে যেত। শ্রোতারা খুব মজা পেতেন।

Fb Img 1659238141345 2
সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন 10

আমার সংগীত জীবনে আমি আর কারও সঙ্গে মঞ্চে এরকম করেছি বলে মনে পড়ে না। সংগীত জীবনে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি আমি।  নির্মলা মাসি চিরকাল দু’হাত দিয়ে আমাকে protect করতেন। সেটা এখন খুব মিস করি। শেষ সাতবছর বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আর এখন তো সব শেষ। তবে আমার মনে হয়, নির্মলা মিশ্রর মতো শিল্পীর মৃত্যু হতে পারে না। এই মাপের শিল্পীরা তাঁদের গানের মধ্যে থেকে যান আজীবন। আর আমরা যাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী, এঁদের গান শুনে বড় হয়েছি, শিখেছি, আমাদের গানে তো সবসময় ওঁদের প্রভাব পড়ে। নির্মলা মিশ্রর মতো শিল্পীরা তাই এক অর্থে আমাদের ‘গুরু’। ওঁদের গায়কীর প্রভাব, গানকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি–এই সবই ঘুরেফিরে আমাদের ভাবায়, উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

Img 20221103 Wa0044 2
সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন 11

গানের কোন কথাটা কীভাবে বলা, সুরটা কীভাবে লাগানো এবং কোন‌ও হরকত কাজ থাকলে কীভাবে করা এবং কোন‌ও মীড় থাকলে সেটা কীভাবে লাগালে,  সুন্দর লাগবে–গানের এইসব টেকনিক্যাল কারিকুরিগুলো চমৎকার উঠে আসে নির্মলা মাসির গানে। আর সবটাই শিক্ষণীয়। হৃদয় নিংড়ানো ওঁর এক একটি গান–যার গুণমুগ্ধ আমরা প্রত্যেকেই। তাই আমার মনে হয় আমাদের শিল্পীদের প্রত্যেকের মধ্যেই উনি বেঁচে থাকবেন। নির্মলা মাসির গান গাওয়ার ভঙ্গি, ধাপ থেকে ধাপে শিক্ষা নিয়েছি। সেগুলোই আমরা প্রয়োগ করি। আমি তো সবসময়ই চেষ্টা করি। আমার মনে হয় সকলের‌ই সেই প্রবণতা রয়েছে। এভাবেই নির্মলা মাসিও বেঁচে থাকবেন চিরকাল সকলের মধ্যে। আর আপামর বাঙালি শ্রোতা, যাঁরা বাংলা গান ভালবাসেন, তাদের কাছে তো এরকম একজন শিল্পীর কোন‌ওদিন মৃত্যু হতে পারে না। তাঁরা ওঁকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবেন। That way she will live on…!

আমার সঙ্গে নির্মলা মাসির সম্পর্ক–সত্যি কথা বলতে, স্বল্প পরিসরে বলা বা বোঝানো একটু মুশকিল। মানুষটা মজার ছিল। এখন তাঁর শরীরটা নেই, এটা হয়তো দুঃখের। কিন্তু আমি বেশি করে দেখার চেষ্টা করি তাঁর জীবনটা। অত্যন্ত সফল ও বর্ণময় সংগীত জীবন। পূর্ণতা তো পেয়েছেন‌ই। অসাধারণ সব গান গেয়েছেন। অতুলনীয় একজন শিল্পী। সাঙ্গীতিক পারদর্শিতার কোনও সীমা ছিল না। সেই নিরিখেই পেয়েছেন নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি।  সুতরাং তাঁর জীবন পরিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ করে আমাদের সকলকে। তাই আমি মনে করি এমন জীবনের সেলিব্রেশন বা জয়গান করাটা দরকার। নিছক শোকপালন নয়। আর এই প্রেক্ষিতেই কাছ থেকে দেখা ওঁর কিছু ঘটনার কথা বলবো, যাতে মানুষ নির্মলা মিশ্রের মনের অমলিন ছবিটা পরিষ্কার ফুটে উঠবে পাঠকের কাছে। (চলবে)

** ছবি সৌজন্যে : গুগল ও দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়