সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। প্রতি মাসে একবার এই কলম প্রকাশিত হয়। প্রয়াত বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী নির্মলা মিশ্রকে নিয়ে বলেছেন দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়। অনুলিখন সোমনাথ লাহা। তিনটি পর্বে লেখাটি প্রকাশিত হবে। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
গত সপ্তাহেই বলেছি, আমি মনে করি নির্মলা মাসি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর জীবনের সেলিব্রেশন বা জয়গান করাটা দরকার, শোকপালন নয়। আর এই প্রেক্ষিতেই কাছ থেকে দেখা ওঁর কিছু ঘটনার কথা এবার বলবো, যাতে মানুষ নির্মলা মিশ্রের মনের অমলিন ছবিটা পরিষ্কার ফুটে উঠবে পাঠকের কাছে। নির্মলা মাসির এই বাচ্চাদের মতো হাব-ভাব করা, পাগলামো করা, মজা করা এগুলো কিন্তু দেখানো নয়, একেবারে জেনুইন ! ভেতর থেকেই বিষয়টা আসতো ওঁর ক্ষেত্রে। উনি বুঝতেও পারতেন না, এগুলো বলছেন বা করছেন। আমার মনে আছে একবার কলকাতার বাইরে একটা অনুষ্ঠানে, সম্ভবত কোনও বইমেলা ছিল।
সেখানে একজন সঙ্গীতশিল্পী ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না…’ গাইছে। আমরা পৌঁছেছি। গানটা শুনে নির্মলা মাসি বললেন, “কে গাইছে রে?” আমি স্টেজের পাশে গিয়ে দেখে এলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক গাইছেন, চিনতে পারলাম না। নির্মলা মাসিকে সেকথা জানাতে, বললেন, “দাঁড়া, নামুক একবার স্টেজ থেকে। এমন বলবো না আমি ! এসব কাজ কি মান্নাদা করতে পারতেন না ? এত ঢং করার কি আছে। গানের মধ্যে এত কাজ করার কি আছে!” আমি বললাম, তুমি কিন্তু এভাবে বলো না। খুব খারাপ লাগে শুনতে। এভাবে বলতে নেই। “ও বলতে নেই ? আচ্ছা ঠিক আছে। আর বলবো না”–মাসি বলল। আমার কথা মতো প্রতিজ্ঞা ইত্যাদিও করলো।
ভদ্রলোক স্টেজ থেকে নেমে যেই দেখলেন নির্মলা মিশ্র বসে আছেন, তিনি সোজা এসে প্রণাম। নির্মলা মাসি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, “আরে করছেন কি ? আপনার মাথায় টাক পড়ে গেছে। আপনি আমার থেকে বয়স্ক লোক। আপনি আমায় প্রণাম করছেন!” ভদ্রলোক বললেন, “দিদি আমার মাথায় টাক পড়েছে বটে ! তবে আমার অত বয়স নয়। আপনার থেকে আমি ছোট। নির্মলা মাসি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, “তখন আপনি ওটা কি গাইলেন?” “আমার গান ভালো হয়নি ?”–ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন। মাসি বললেন, “অত্যান্ত খারাপ হয়েছে।” নির্মলা মাসি ‘অত্যান্ত’ বলতেন। আমি এদিকে মাসিকে চিমটি কাটছি আর বলছি ‘চুপ করো’। ”তুই চিমটি কাটলেও আমি থামবো না। আমি বলবোই”। ভদ্রলোক তখন বললেন, “আসলে দিদি আমার তো শরীর-মন ভাল নেই। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন কয়েকদিন আগেই। নির্মলা মাসির সটান জবাব, “তা হবে না ? আপনার গান শুনেই গত হয়েছেন নিশ্চয়ই।” এইরকম ছিলেন নির্মলা মাসি।
আর একবার কলকাতার বাইরে এক অনুষ্ঠানে নির্মলা মাসির সম্বর্ধনা ছিল। মঞ্চে গান করতে করতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলছে “ওই দেখ.. ঘুগনিওয়ালা যাচ্ছে। ওটাকে আটকা।” আমার তো দুরবস্থার একশেষ। আমি মঞ্চ থেকে ঘুগনিওয়ালাকে কিভাবে আটকাবো! যেখানে নির্মলা মাসি গান গাইছে, ‘কাগজের ফুল বলে আজও ঝরেনি।’ আমি তার মাঝে চিৎকার করবো, ঘুগনিওয়ালা আপনি যাবেন না বলে? আমি প্রীতিদাকে (তবলা বাজাতেন প্রীতিময় গোস্বামী) বললাম, দেখো তো ইশারা করে কাউকে–প্রীতিদার অবস্থাও আমার মতোই করুণ। তাও প্রীতিদা একজনকে ডেকে বললেন, ঘুগনিওয়ালাকে আটকানোর জন্য। দিদি খেতে চাইছেন। অনুষ্ঠানের পরে সেই ঘুগনিওয়ালার কাছ থেকে ঘুগনি নিয়ে খাওয়া হল।
এমনই মজার মানুষ ছিলেন নির্মলা মাসি। একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি–রাস্তায় দেখি কোন এক আইসক্রিম, কোম্পানির নাম জন্মে শুনিনি। মাসি সেই আইসক্রিমই খাবে। সেটা নাকি বেশি ভাল খেতে। মাসির পছন্দ, তাদের কটকটে সবুজ রঙের গ্রিন ম্যাঙ্গো আইসক্রিম। সেই আইসক্রিম খেয়ে আমি আর নির্মলা মাসি যখন গাড়ি থেকে নামলাম অনুষ্ঠানে, দু’জনেরই ঠোঁট সবুজ, জিভ সবুজ। ফাংশানের উদ্যোক্তারা আমাদের দেখে ভাবছেন এ আবার কি দৃশ্য! তারপর স্টেজের পিছনে দোলনাতে দুজনে মিলে দুলছি। আর সেটা দেখে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা ভাবছে সর্বনাশ করেছে ! এ তো দুই পাগল শিল্পী ! এরা কি গান করবে ? এদের দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান করব কি করে ? এইগুলো আমাদের চলতেই থাকতো সারাক্ষণ।
নিউমার্কেটের একটা ঘটনার কথা আমি অনেক জায়গাতেই বলেছি। বনশ্রী মাসি (বনশ্রী সেনগুপ্ত) আর নির্মলা মাসিকে নিয়ে আমি প্রায়ই নিউমার্কেট যেতাম। আমার মা-ও যেত কখনও কখনও। এদিকে দু’জনের মধ্যে সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকতো। বনশ্রী মাসি বলতেন, “এই দেখ তোকে কতজন চিনতে পারছে। এই পাগলি, আমাকে কেউ চিনতে পারছে না। আমার কান্না পাচ্ছে।” এই চলতো দু’জনের মধ্যে। নিউমার্কেটের পরচুলার দোকানগুলোতে যেখানে খোঁপা, চুল সব পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে একবার এক কাণ্ড হলো। টানাটানি করতে গিয়ে নির্মলা মাসি একজন ভদ্রমহিলার মাথার খোঁপা ধরেই টান মেরেছেন। তিনি অবাঙালি। তিনি তো আর নির্মলা মিশ্রকে চেনেন না। তিনি ভীষণই রেগে গেছেন। তাকে শান্ত করতে গিয়ে আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। ভদ্রমহিলার মাথা খারাপ তো, তাই এরকম করে ফেলেছেন। কিছু মনে করবেন না। এতে কাজ হলো।
এদিকে নির্মলা মাসি সেটা শুনে বললেন, “বদমাইশ ছেলে। থাপ্পর মারবো ! তুই আমাকে পাগল বললি?” আমি বললাম, না বললে, আমি তো মার খেতাম। তোমরা তো মহিলা। তোমাদের তো মারবে না। আমি মার খাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবো না ? তাই তোমাকে পাগল বলেছি। ভুল তো কিছু বলিনি। নির্মলা মাসি বলল, “অসভ্য ছেলে, বদমাইশ। এক্ষুনি আমাকে আইসক্রিম কিনে দে। আমার মাথা গরম হয়ে গেছে।” আবার নিউমার্কেট থেকে বেরিয়ে আমরা আইসক্রিম খেলাম। বনশ্রী মাসি আবার আইসক্রিম খাবে না। তাঁর গলা নষ্ট হয়ে যাবে। এমন সব মজার স্মৃতি জড়িয়ে নির্মলা মাসির সঙ্গে !
বেহালাতে নির্মলা মাসির সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। মাসি আমাকে বলল, “আমার কানাইবাবু পেয়েছে।” কী কাণ্ড ! রাস্তার অনুষ্ঠান, রাস্তায় স্টেজ। এখানে বলে রাখি, নির্মলা মাসির হিসি পেলে সেটা ‘কানাইবাবু’ আর পটি পেলে ‘বলাইবাবু’। আমি বললাম, তুমি এরকম করলে কি করে হবে ! একটু চেপে থাকো। বাড়ি চলে যাব। মাসি বললেন, তাঁর এক্ষুনি হয়ে যাবে। মহা মুশকিলে পড়লাম। অগত্যা একজন ভদ্রমহিলাকে বললাম, দিদি একটুখানি দেখুন না–কোথাও যদি–তিনি বললেন, আচ্ছা আমি নিয়ে যাচ্ছি। আধঘন্টা হয়ে গেল, নির্মলা মাসি ফেরত আসেন না। আমি চিন্তা করছি। এদিকে অনুষ্ঠান শেষ। এবার তো চলে যাব।
তারপর দেখি ৪-৫টা প্যাকেট হাতে লাফাতে লাফাতে নির্মলা মাসি আসছেন ।কোমরে আঁচলটা গোঁজা। শাড়ি অনেকটা ওপরে তুলে, হেঁটে আসছেন। আমি দেখে বললাম, এটা কি দৃশ্য ! শাড়ি নামাও। মাসি বলল, “না ওখানে কাদা ছিল।” আমি বললাম, তুমি কোথায় বাথরুমে গিয়েছিলে ? কোথায় কাদা ছিল ? মাসি বলল, “না রে কানাইবাবু করে তো আমি ফুটপাতে ব্লাউজ, সায়া কিনছিলাম। ডিঙ্কু, এক ব্যাগ ব্লাউজ ১৫ টাকায় পেয়েছি।” দেখলাম ৬-৭টা ব্লাউজ আর ৪-৫টা সায়া কিনেছে। আমায় বলল “একটু পয়সা দিয়ে দে। তোকে বাড়িতে গিয়ে পয়সা দিচ্ছি।” এমনই মানুষ ছিলেন নির্মলা মাসি। পুরো মাথা খারাপ ! (চলবে)
** ছবি সৌজন্যে : গুগল ও দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়