সংগীতে উদযাপনে বর্ণময় জীবন
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। প্রতি মাসে এক একজন এমন মানুষকে নিয়ে এই কলম প্রকাশিত হয়। প্রয়াত বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী নির্মলা মিশ্রকে নিয়ে বলেছেন দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়। অনুলিখন সোমনাথ লাহা। তিনটি পর্বে লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব।
আদতে নির্মলামাসির গল্প বলতে গেলে আস্ত একটা মহাভারত হয়ে যায়। স্বল্প পরিসরে তাকে ব্যক্ত করা কঠিন। তার মধ্যেই যতটুকু সম্ভব বলছি। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, তাঁর পাগলামির যে গল্পগুলো আমি বলছি, সেগুলো একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, কতটা শিশুসুলভ মন ছিল নির্মলামাসির। এই মন বড়ই বিরল। এই সারল্যই যেন তাঁর শিল্পী মনের ছবি, তাঁর গানের পরিপূরক। এই স্মৃতিচারণার পথ ধরে আমি যেন পৌঁছে যাচ্ছি সেই দিনগুলিতে, যেখানে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে এই বিরল মনের শিল্পীকে দেখেছি। দেখেছি একেবারে আপন পরিবারের বৃত্তে।
একবার কলকাতার বাইরে এক মেলায় গেছি অনুষ্ঠান উপলক্ষে। মাসি বাথরুমে ঢুকেছেন। এদিকে বৃষ্টি পড়ে এমন কাদা হয়েছে যে বাথরুমের দরজাটা কাদায় আটকে গেছে এবং মাসি আর বেরোতে পারছেন না। আমাকে বলছেন দরজাটা বাইরে থেকে ধাক্কা মারতে। আমি ধাক্কা মেরেও দরজাটা খুলতে পারছি না। নির্মলামাসি বাথরুমের ভিতরে, ওদিকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে নির্মলা মিশ্রের সংগীতানুষ্ঠান শুরু হবে। আমি বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বললাম, দেখুন উনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। আর আপনাদের এই বাথরুমের দরজাটা আটকে গেছে। তারপর সেই দরজা তুলে টেনে নির্মলামাসিকে বের করা হল। বেরিয়েই বললেন, “এ কেমন দরজা আপনাদের ! আমাকে বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে নাম অ্যানাউন্স করছেন। দেখবেন তো যে আমি আমি আটকে গেছি বাথরুমে!” আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, তোমার হাতে-পায়ে ধরছি। খবরদার তুমি এসব কথা স্টেজে বলবে না। “না না বলব না”–মাসির উত্তর।
কোথায় কী ! স্টেজে উঠেই নির্মলা মাসির সিটি। তারপর বললেন “আরেব্বাস কত লোক ! আমি তো কানাইবাবু করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। আপনাদের দরজাটা ঠিক করুন (উদ্যোক্তাদের প্রতি)। আর সব মহিলাদের বলছি, কিছু মনে করবেন না, একদম হিসু করতে যাবেন না।” তারপর আবার সিটি ! সবাই হেসে মরে যাচ্ছে। ঠিক তখনই নির্মলামাসি বসে গান শুরু করলেন এবং তৎক্ষণাৎ গানের মধ্যে এমন ঢুকে গেলেন, একেবারে অন্য মানুষ। একটা অদ্ভুত involvement ছিল ওঁর গানের মধ্যে। যে কোনও গানের কথা, এমনভাবে বলতেন মঞ্চে–মাইকে শুনে মনে হতো, ভিতর থেকে কথা বলে উঠছেন। তখন আর গান নয়, মনে হত কথা বলছেন। গানের সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যেতেন। গানের অর্থটাকে এমন সুন্দর ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, অভিব্যক্তিটা এত অসাধারণ ছিল, যে বোঝা যেত, সেটা ভেতর থেকে আসছে। কিন্তু এই পাগলামোগুলোও সমান তালে করতেন।
২০১৩ সালের কথা। সেই সময় আমার মায়ের কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়েছে। একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি। নির্মলামাসি দেখতে গিয়েছেন মাকে। আমি কেবিন নাম্বার বলে দিয়েছিলাম। তারপরেও নার্সদের সঙ্গে ঝগড়া করে মাসি একটা ভুল ঘরে ঢুকে গেছেন। তাঁরা বারণ করছেন, দিদি এটা নয়, তিনতলায় চলুন। কিন্তু মাসি নাছোড়বান্দা–না দেবমাল্য বলেছে এইটা–বলেই ঘরে ঢুকে পড়েছেন। ঢুকে দেখেন, সেখানে স্ট্রেচারে চাদর চাপা দিয়ে শোয়ানো রয়েছে কয়েকজনকে। সেই দেখে মাসি রেগে বললেন “হ্যাঁ, আপনারা ওকে এখানে রেখেছেন ! এতবড় আস্পর্ধা কার হলো ?” হাসপাতালের নার্সরা তখন বললেন, দিদি, উনি তিনতলায় আছেন। এটা মর্গ। আপনি শুনছেন না বলে আপনাকে ভিতরে এনে দেখলাম। “হ্যাঁ মর্গ…? কি সর্বনাশ !! তাহলে তিন তলায় নিয়ে চলুন”–শেষে তাঁদের বললেন মাসি।
এরপর নির্মলামাসি আসতে আমি বললাম, “তুমি কি পাগল ? তুমি মর্গে ঢুকেছ কেন!” ওদিকে হাসপাতালের নার্সরা বলছেন, ‘দেখুন না, উনি শুনছেনই না। বলছি পেশেন্ট তিনতলায় আছেন’। এরপর আমাকে মাসি দক্ষিণেশ্বর নিয়ে গেলেন। বললেন, “চল তো ! আমার ভাল লাগছে না।” মাকে মাসি ‘বুজু’ বলে ডাকতেন। Bossom friend–সেই থেকে বুজু। আমায় বললেন, “বুজুর জন্য প্রার্থনা করতে যাব।” আমি বললাম, চলো। সেখানে গিয়ে দেখি ছেলেমেয়েরা সব বসে প্রেম করছে ঘনিষ্টভাবে বসে, কাঁধে হাত রেখে। মাসি দেখেই বললেন, “এত বড় বজ্জাত ছেলেমেয়েগুলো ! এদের বাবা-মায়েরা কোনও শিক্ষা দেয়নি। একটা দেবস্থানে এসে বদমাইশি করছে!” তারপরই–”আমিও তোর সঙ্গে এভাবে ছবি তুলব।” আমি বললাম, তুমি কি আমার গার্লফ্রেন্ড যে, তুমি আমার সঙ্গে এরকম ছবি তুলবে! “তাতে কী ? মা-ছেলেও তো গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড হতে পারে।” বলেই আমার গাল ধরলেন আর ছবি তোলার জন্য ফোনটা দিলেন দক্ষিণেশ্বরের মহারাজকে। মহারাজেরু সে কি দুরবস্থা ! এদিকে নির্মলামাসি সমানে তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন–এদিক দিয়ে তুলুন। ওদিক দিয়ে তুলুন একটা…এইসব !
তারপর সেইদিনই কিনা, আজ আর মনে নেই। ভবাপাগলা সন্মেলনে গান করতে গিয়েছি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম নির্মলামাসির জুতো আগলে। নির্মলা মাসি উপরে দর্শন করতে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, “তুই এবার যা।” আমি বললাম, না গো। আমার ভবতারিণী তুমি। তুমি আমার জুতো আগলে দাঁড়াবে, আর আমি উপরে যাব দর্শন করতে ? এটা আমি পারবো না। তুমিই আমার ভবতারিণী, তুমিই মা। মায়ের চেয়ে বড় কেউ না, ভগবানও নয়। তুমি চলো, একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমরা বরং নাটমন্দিরে গিয়ে বসি। মাসি অবাক হয়ে বললেন, “তুই আমায় ভবতারিণী বললি ?” তো আমরা গিয়ে বসেছি। মাসি আবারও বলল, “তুই দর্শনটা করে আসলেই পারতিস।” আমি বললাম, যাঁর দর্শন দেওয়ার, তিনি নিজে থেকেই দেবেন। আমি তো বললাম তুমিই আমার ভবতারিণী।
এরপর অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। প্রচুর ভিড় নাটমন্দিরে। আমরা গান করতে করতে মায়ের মূর্তি দেখতে পাচ্ছি না। ভীষণই ভিড়। নির্মলামাসির গান শেষ হয়েছে। আমি গান শুরু করেছি। আমি তো চোখ বন্ধ করেই গাইছি। আর নির্মলামাসি সমানে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। মাসি আমার গান ভাল লাগলে, মঞ্চেই পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতেন। কিছুক্ষণ পর ফোঁস ফোঁস শব্দ। তারপর পিঠে খোঁচা। আমি তাকালাম মাসির দিকে। দেখি মাসি প্রচন্ড কাঁদছেন আর ইশারা করছেন, ওদিকে তাকা। তাকিয়ে দেখলাম ভবতারিণীর যে গর্ভগৃহ, মানুষ ঢুকছেন দেখবেন বলে–সেই জায়গায় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন লাইন করে। কিন্তু, কোনও ভাবে সেই লাইন থেকে কেউ সরে যাওয়ায়, একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে মায়ের মূর্তি সোজাসুজি দেখা যাচ্ছে। আমি ওই যে মাসিকে বলেছিলাম, ওনার যদি ইচ্ছা হয় উনিই আমায় দেখা দেবেন। আমি যাব না দেখা করতে। তুমিই আমার ভবতারিণী, এই যথেষ্ট–এটা নির্মলামাসি মাইকে বললেন সবাইকে। উল্লেখ করলেন, “ও আমায় এই কথা বলেছিল। দেখুন আপনারা তাকিয়ে, মা কিরকম ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। ওর গান শুনছেন!”
আরেকটা মজার বিষয় ছিল নির্মলামাসি আর বনশ্রী মাসির মধ্যে সম্পর্ক। ওঁদের মধ্যে প্রায়ই ভাব আর ঝগড়া হতো। একবার রবীন্দ্রসদনে একটি অনুষ্ঠানে নির্মলামাসি স্টেজে ঢুকে বলছেন, “এই যে দেখুন, আমি পূর্ণিমার চাঁদ আর পিছনে অমাবস্যার চাঁদ আসছে।” অমাবস্যার চাঁদ মানে বনশ্রীমাসি। নির্মলামাসির মুখে এই কথা শুনে বনশ্রীমাসির সে কী কান্না ! বনশ্রীমাসি বললেন,”আমি কালো বলে আমায় এরকম করে বলল পাগলীটা। বদমাইশ, পাগলীটা এরকম বলতে পারল ?” তারপর তো যথারীতি মাকে আর আমাকে ফোন করে বনশ্রীমাসির নালিশ করা হয়ে গেল। প্রায় এক মাস নির্মলামাসি আর বনশ্রীমাসির মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আমি তো এই পুরো বিষয়টা দেখে হাসছি। কারণ ওদের মুখ দেখাদেখি বন্ধের কারণ তো জানি আমি।
কিছুদিন পরেই বনশ্রী মাসি ফোন করলেন নির্মলা মাসিকে–”দিদি আমি একটা ব্লাউজ কিনেছি। তোমাকে এটা পরে ভীষণ সুন্দর লাগবে। আমি নিয়ে আসছি।” নির্মলা মাসি তো যথারীতি, “হ্যাঁ আয়.. আয়..”। এবার আমিও পৌঁছেছি নির্মলামাসির বাড়ি। আমাকে দেখে মাসি বললেন, “ফরেস্ট (বনশ্রীমাসিকে আদর করে ওই নামেই ডাকতেন) কি ভাল মেয়ে বল ! কি সুন্দর ব্লাউজ দিয়েছে আমাকে।” আমি বললাম, এই যে তুমি বললে অমাবস্যার চাঁদ, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেছ দুজনে। নির্মলামাসি বললেন, “আহা রে মেয়েটা বড্ড ভালো।” বুঝুন! এই ছিল নির্মলামাসি আর বনশ্রীমাসির ঝগড়া আর ভাব। ঠিক আবহাওয়ার মতোই। সকালে-বিকালে পাল্টে যেত দুজনের সম্পর্কের আদানপ্রদান। অন্তে যা ছিল শুধুই মাধুর্যে ভরা।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। মেসোর (বিখ্যাত গীতিকার ও সুরকার প্রদীপ দাশগুপ্ত) সঙ্গে যখনই নির্মলামাসির ঝগড়া হতো, মাসি তখনই নাইটির উপর হাউসকোট পরে আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। আর মা মাসিকে প্রচন্ড বকে বলতেন, “তোমার দোষ। প্রদীপবাবুর কোনও দোষ নেই। তুমি নিশ্চয়ই কিছু করেছ। তুমি খুব দুষ্টু মেয়ে !” সেই কথা শুনে মাসি বলতেন, “ও বাবা আমাকেই বকছ !” এসব চলতেই থাকতো। আমাদের দুই পরিবার কত বছর এভাবেই একান্ত আত্মীয়সম হয়ে কাটিয়েছি, এখন ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
নির্মলামাসি খেতে বসলেই হয় আলু সেদ্ধ ভাত, কখনও গোবিন্দভোগ চালে একটু মাখন বা ঘি দিয়ে সঙ্গে ডিমসিদ্ধ। এই খাবারগুলো খেতে ভীষণ ভালবাসতেন। আমি মাঝে মাঝে বলতাম, “অমৃতি, জিলিপি আনিয়ে দেব, খাবে ?” একগাল হেসে ‘হ্যাঁ’ বলতেন নির্মলামাসি। আসলে কিছু নির্দিষ্ট খাবার ছিল। সেগুলোই খেতে ভালবাসতেন। তার বাইরে কিছু খেতে চাইতেন না। মাছের মধ্যে ইলিশ মাছ, ইলিশ মাছের ডিম, চিংড়ি মাছ খেতে পছন্দ করতেন। কন্টিনেন্টাল খাবারের নাম নির্মলামাসি বুঝতেই পারতেন না। তবে, আমি সমস্ত ভেজিটেবল, চিকেন, চিজ দিয়ে একটা বেকড আইটেম করতাম। অনেকটা অগ্র্যাটিন টাইপের। নির্মলামাসি সেটা খেতে ভীষণই ভালবাসতেন। শেষের দিকে আমাকে বলেছিলেন, “আমাকে একটু খাওয়াবি…?” তখন মাসি খুবই অসুস্থ। ডাক্তারের বারণ থাকায় আমি নির্মলামাসিকে সেটা করে খাওয়াতে পারিনি। এই আফসোসটা আমার থেকেই যাবে।
** ছবি সৌজন্যে : গুগল ও দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়