Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

সতীর্থদের কাছ থেকে পাওয়া উৎসাহটা বেশি ভালো লাগে

বাংলা সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য তিনি, একথা বহু আগেই প্রমাণিত। তাঁর অভিনয়ের উৎকর্ষতা কোনও পুরস্কারের মাপকাঠিতে বিচার্য হতে পারে না। তবু অভিনেতা চন্দন সেনের রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবে সেরা অভিনেতা নির্বাচিত হওয়ার খবরে আমাদের প্রাণে খুশির তুফান ওঠে। চন্দন সেনকে নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত সিনেমা সাংবাদিক নির্মল ধর

বাংলা নাটকের অতি জনপ্রিয় মুখ এবং বাংলা  সিনেমার কিছু চরিত্রে অপরিহার্য, অথচ, অনেকটাই  অবহেলিত অভিনেতা চন্দন সেন। প্রায় আচমকাই রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবে সেরা অভিনেতা নির্বাচিত হওয়ার কারণে এক ‘ডিপ্লোমা’ পেয়ে তিনি যেন চমকে গেছেন ! পাশাপাশি অদ্ভুতভাবে এরপরও তাঁকে ঘিরে এক অসম্মানজনক নীরবতা ছেয়ে আছে বাংলা নাটক ও সিনেমা জগতে ! না, তার জন্য স্বয়ং চন্দনের কোনও খেদ নেই। তাঁর কাছে এমন ব্যবহার নতুন কিছু নয়! এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের দেশগুলোর ছবি নিয়ে প্রতিযোগিতার আসর বসে ফি’বছর বিশ্বের উত্তরতম এই শহরটিতে। সেখান থেকেই চন্দন জিতে নিয়েছেন ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার! সেটা কি আর সহজে কলকাতার পরশ্রীকাতর শিল্পীমহল মেনে নিতে পারে ?

Image 2 1
সতীর্থদের কাছ থেকে পাওয়া উৎসাহটা বেশি ভালো লাগে 15

তখন সবে নান্দীকার দলে যোগ দিয়েছেন তিনি। বয়সে ছটফটে এক তরুণ। নাটকের পাশাপাশি প্রিয় খেলা ক্রিকেট নিয়েও তখন মত্ত তিনি। নাটকের শো-র অল্প কিছু সময় আগে তিনি ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প থেকে হাজির মঞ্চে। ফলে অভিনয়ে সেই সন্ধ্যায় একেবারে ল্যাজেগোবরে! তৎক্ষণাৎ দলের নেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মন্তব্য, “Don’t think you are a genius! ক্রিকেট না নাটক, কোনটা করবে ঠিক করে নাও!” বলা বাহুল্য, সেদিন থেকেই চন্দন সেনের ভবিষ্যত চিন্তায় এলো বদল। নাটককেই বেছে নিলেন তিনি।

ভালো করে ঠিক মনে পড়ে না। মা-বাবার সঙ্গে গণনাট্য সংঘের প্রাঙ্গনে তাঁর টলমলানো পায়ে মঞ্চ পরিক্রমা। ষাট ছুঁয়ে এখনও সেই পরিক্রমা চলছে পুরোদমে। তিনি থামেননি। এমনকি শরীরে বাসা-বেঁধে থাকা মারণ রোগও তাঁর স্পিরিটকে দমাতে পারেনি এক বিন্দু ! হাতেখড়ির পর নাটকের অভিনয় শেখায় রুদ্রপ্রসাদের দল থেকে সরে গিয়ে প্রথম পাঁচ বছর রমাপ্রসাদ বনিকের কাছে, পরের চার বছর খোদ উৎপল দত্তর দলে থেকে অন্তত দশটি নাটকে অভিনয় করেছেন। কল্লোল, লালদূর্গ, জনতার আফিম বা ক্রুশবিদ্ধ কুবা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন চন্দনের অভিনয়ের দৌড় কতদূর পর্যন্ত ! তারপর গত তিরিশ বছর ধরে ‘নাট্য আনন’ দলের প্রধান তিনি। শুরুর দিকে ছিলেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী, লাবনী সরকার। এখন শান্তিলালের সঙ্গে ছেলে ঋতব্রতও যোগ দিয়েছে।

আজন্ম বামপন্থী চন্দন কখনও মত বা পথ বদল করেছেন, এমন অভিযোগ শোনা যায় না। রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সিনেমা ও সংস্কৃতি জগতের অনেকেই জার্সি বদলে প্রাপ্ত সুযোগের মাত্রা বাড়িয়ে ফেলেছেন। চন্দন নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসে অটল। তার জন্য তাঁর কাজে কোনও সমস্যা ঘটাতে পারেনি কেউ, এতটাই অপরিহার্য তিনি ! ‘মানিকবাবুর মেঘ’ পরিচালক অভিনন্দন বন্দোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। আর এই প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েই চন্দন বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর জাত ও চরিত্র। সাম্প্রতিককালে অরিন্দম সিলের ‘তীরন্দাজ শবর’ ছবিতেও এক সিরিয়াল কিলারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের নজর কেড়েছিলেন চন্দন। তবে, মানিকবাবুর চরিত্রটি একেবারেই অন্যধারার।

ক’দিন আগে কফি হাউসে বসে কথা হচ্ছিল চন্দনের সঙ্গে। একান্তে বসা যায়নি, চেনা মুখের সঙ্গে তরুণীদের ছবি তোলায় সে যে কী আগ্রহ! গ্ল্যামারহীন চেহারাও যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলা বিনোদন দুনিয়ার এই চন্দন। অভিনয়, একমাত্র অভিনয় দিয়েই তিনি আপামর গণদর্শকের কাছে এই মুহূর্তে প্রিয়জন। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ এখনও মুক্তি পায়নি। যাঁরা দেখেছেন, সব্বাই এক সুরে বলেছেন, এমন একটি গল্পহীন ছবির পরিকল্পনা যাঁর (অভিনন্দন) মস্তিষ্কপ্রসূত, তাঁর সৃজনশীলতাকে কুর্নিশ! চন্দনও বললেন, “স্ক্রিপ্ট পড়া ও শোনার সময় সত্যিই ছবির স্ট্রাকচারটা একই সঙ্গে অ্যবসার্ড এবং গ্র্যান্ড লেগেছিল! প্রসঙ্গত, একটা সত্যি কথা বলি– আমার জীবনেও ঘটেছিল এমন ঘটনা। ধর্মতলা পাড়া দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ মনে হলো মাথার ওপর একটা মেঘ যেন আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই ! সত্যি একটু ভয় ভয়ও করছিল। মিনিট পাঁচ-সাতেক হাঁটার পর  গ্র্যান্ড হোটেলের নিচে ছাদের তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, যাতে মেঘটা চলে যায়। গেলোও তাই। অভিনন্দনের স্ক্রিপ্ট শোনার সময় তো বটেই, অভিনয় করার সময়েও সেই পুরোনো স্মৃতি মাথায় ঘুরেছে!”

ছবির না-গল্পের খাঁচাটাও বেশ অন্যরকম। বৃদ্ধ অথর্ব বাবা-ছেলের সংসার। এক পোড়োবাড়িতে থাকে দুজনে। বাড়ির ছাদে গাছগাছালির এক বাগান রয়েছে, সেটির পরিচর্যা করাও বাবার দেখাশোনার মতো ছেলে মানিকের নিত্য কর্তব্য। একদিন সে আবিষ্কার করে, ছাদের ওপর এক খন্ড সাদা মেঘ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসের পথে, বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায়, কিম্বা যেখানেই সে যায়, দেখতে পায় সেই খন্ড মেঘটি যেন তাঁকে অনুসরণ করেই চলেছে ! বাড়ি পাল্টেও নিস্তার নেই! এভাবেই মানিকবাবুর সঙ্গে মেঘের এক বিনি সুতোর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।

এখনও পর্যন্ত চন্দন সেন যেমন তিরিশ-চল্লিশটি নাটকে অভিনয় করেছেন। সিনেমা এবং টিভি সিরিয়ালের সংখ্যাটিও কম নয়। এই মুহূর্তে তাঁর ‘নাট্য আনন’-এর তিনটি প্রযোজনা– ‘দিল্লি চলো’, ‘অ-পবিত্র’ ও ‘দারোগা হলো ম্যানেজার’-এর প্রায় নিয়মিত শো চলছে শহরে এবং শহরের বাইরে। তাঁর কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এখনকার বাংলা নাটকে কি আজকের সামাজিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলো ঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে ? জবাবে তিনি বললেন,”সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, আশা, স্বপ্নভঙ্গের কথা আমাদের নাটকে যেভাবে উঠে আসা উচিত ছিল, সেটা প্রায় হচ্ছে না। ইতিউতি, এদিক-সেদিকে দু’চারটে হয়তো বা হচ্ছে। আসলে সেই বামফ্রন্টের আমল থেকেই অধিকাংশ নাট্যদলের সরকার মুখাপেক্ষিতাই ডুবিয়েছে আমাদের। ডোবাচ্ছে এবং ডোবাবেও! সরকারের লেজুড় হয়ে গেলে নিজের স্বাধীনতা কোথাও থাকে না। আমি বামফ্রন্টের সময় থেকেই এই কথা বলছি। এটা সিপিএম দলের বিরুদ্ধে বলা নয়, এই রাজ্যের নাট্যজগতের উন্নতির পরিপন্থী বলেই আমি মনে করি!”

খুবই সোজা সাপটা কথা তাঁর। ক্রিয়ার একটা প্রতিক্রিয়া থাকবেই, সেটাই হচ্ছে এখন। তবে তাঁদের ‘দিল্লি চলো’ বা ‘অ-পবিত্র’ নিশ্চিতভাবেই চলতি ধারার বাইরে যথেষ্ট প্রতিবাদী প্রযোজনা। ইতিমধ্যে দু’দুবার আমেরিকাও ঘুরে এসেছেন চন্দন। ওখানকার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘নুরুলুদ্দিনের সারাজীবন’ নাটকটির এগারোটি শো-এর মধ্যে নটি শো অফ অফ ব্রডওয়ে-তে হাউসফুল পেয়েছে। তাঁরই পরিচালনায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। দ্বিতীয়বার গিয়ে ইংরেজি নাটক ‘justice’-এর অভিনয় করিয়েছেন ওখানকার স্থানীয় বাঙালিদের নিয়ে ইংরেজিতেই। সাফল্য তাঁর এখন হাতের মুঠোয়। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ‘অ-পবিত্র’-র বক্তব্য এখানেও আলোচনার বিষয়।

নাটক আর সিনেমা–কোনটা তাঁর বেশি পছন্দ জানতে চাইলে চন্দন বললেন, “আমার রক্তে রয়েছে অভিনয়, তা সে মঞ্চের ওপর হোক বা ক্যামেরার সামনে। চরিত্র হয়ে ওঠাই আমার কাজ। সিনেমায় বা সিরিয়ালে কাজ করলে একটু আয় বেশি হয়, সংসার চালাতে কাজে লাগে। কিন্তু প্রাণের টান মঞ্চের দিকেই, সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে !” ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিতে কাজের জন্য ভ্লাদিভস্তক উৎসব থেকে সেরা অভিনেতার স্বীকৃতি পাওয়াটা কেমন লাগছে জানতে চাইলে বেশ নির্লিপ্তির সুরেই বলে উঠলেন, “খারাপ মোটেই লাগছে না। তবে সতীর্থদের কাছ থেকে পাওয়া উৎসাহটা আরও বেশি ভালো লাগে!” ঘন্টাখানেক আড্ডার পর কফি হাউস থেকে বেরিয়েই তিনি যাবেন ‘দিল্লি চলো’ নাটকের মহরায়। জানিয়ে দিলেন, “সামনেই শো। রিহার্সাল তো এড়ানো যাবে না!” অনুভব করলাম তাঁর নাট্যপ্রেমের আবেগকে !!