সিনেমাই জানিয়ে দিল, সিনেমা নিয়ে বাঁচবো
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ সব্যসাচী ভৌমিক। ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব আজ। আলাপচারিতায় অজন্তা সিনহা।
■■ সিনেমা তৈরির উৎস সন্ধান
ঠিক কিভাবে শুরু হোলো বা আদৌ শুরু হয় কিনা প্রশ্নটা সেখানেই ! সিনেমা আসলে রক্তের ভেতরে থাকে। শরীরের চামড়ার মতো তাকে শরীর থেকে আলাদা করা যায়না। একজন সামাজিক মানুষ অল্প বয়স থেকে যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমটিকে anticipate করে, আমার শুরুও তেমনই। ওই সাদাকালো টিভিতে মাটিতে বসে ছবি দেখতে দেখতে হয়তো ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ একটু বেশি ভালো লেগে যাওয়া বা ‘আপনজন’ দেখার পর একটু বেশি ভাবনাচিন্তা করা–আর দশটা ছেলের মতোই। ক্লাস নাইন-টেন থেকে বুঝতে পারি সিনেমা একটু অন্যভাবে আপিল করছে আমায়। স্কুল পালিয়ে নুন শো দেখা–সেভাবেই একদিন দেখে ফেলি ‘বাইসাইকেল থিভস’। পরপর তিনদিন ফাঁকা হলে দেখলাম ছবিটি। সিনেমার ভাষা, তার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে নিজের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। তারপর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল–মনে আছে ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’ দেখার জন্য টকি শো হাউসের সামনে রাত জেগেছিলাম। একটা চায়ের দোকানে কোনও ক্রমে ম্যানেজ করে শুয়েছিলাম। সিনে সেন্ট্রাল তখন প্রতি সপ্তাহে অসামান্য সব ছবি দেখাতো। এভাবেই বিশ্ব সিনেমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলো। আগ্রহ বাড়লো।


■■ সিনেমা নয়, কবিতাই ছিলো প্রথম প্রেম
শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি। একটু কেমন সিনিকও ছিলাম সেসময়। মনে হতো, কবিতাই সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম। তাই অন্য কোনও শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দরকার নেই। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ ও নক্ষত্রের কুশপুতুল’। তারপর ‘সমান্তরাল স্বপ্ন পরিষেবা’। দেশ, সানন্দাসহ যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিনে লেখা, আড্ডা, কফিহাউস, কলেজ ক্লাস কেটে দুম করে শান্তিনিকেতন–এসব ঘটছিল। কিন্তু সব কিছুর অগোচরে সিনেমার প্রতি টানটাও অন্যভাবে অনুভব করছিলাম। একটা কথা বারবার মনে হতো ক্রমশঃ, সব শিল্পমাধ্যম যেন একটা ক্রস ফারটিলাইজেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যে ছেলেটা প্যারিসে বসে ছবি আঁকছে, লাতিন আমেরিকায় বসে যে একটা ডকুমেন্টারি বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, বারাসাতে বসে যে একটা নিরীক্ষামূলক ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করছে, সকলে আসলে একটাই কাজ করছে।
■■ কবিতা নিয়ে ভাবনার বদল এবং সিনেমা
তিনটে জিনিস খুব দ্রুত কাজ করলো।
এক, কবিতাই কুলীন, আর শিল্পমাধ্যমগুলো কিছু নয়–এই ধারণা ফিকে হতে শুরু করলো। উল্টোদিকে মনে হতে শুরু করলো, সিনেমারই সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ভাষা আছে। একটা আঞ্চলিক ভাষায় বানানো ছবি জার্মানির মানুষের কাছেও পৌঁছতে পারে। সাহিত্যে অনুবাদের পর তার নির্যাস কমতে বাধ্য।
দুই, বাংলা কবিতার জগৎ মধ্যমেধার আখড়া হয়ে যাচ্ছিলো। নামী কাগজে লেখা ছাপানোর জন্য তরুণ কবিদের হ্যাংলামি পীড়া দিতো। এমনকী, বাজারী কাগজে কবিতার পাতা দেখেন, এমন এক বিখ্যাত কবির বাড়ির গ্যাস কানেকশন নিয়েও তরুণ কবিদের সারাদিন হন্যে হয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছি।
তিন, সিনেমার ভাষা, দুনিয়া জুড়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। ইতালির নিও রিয়ালিজম, ফ্রান্সে গোদার ও ত্রুফোর নেতৃত্বে নুভেল ভাগ, রোমানিয়ান ন্যু ওয়েভ, লার্স ভন ট্রায়ারের অনুপ্রেরণায় ডগমা 95, সব ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমাভাষার নতুন নতুন দিগন্ত উঠে আসছিলো। বার্গম্যান দেখার পর মনে হোলো আর কোন মাধ্যম পারে এভাবে আত্মার গভীর ক্ষতে শুশ্রুষার তর্জনী রাখতে ? কিয়েসলোসকি, তারকোভস্কি, গোদার সকলেই তখন প্রতি মুহূর্তে ভাবাচ্ছেন। ২০০৫ সালের দেশ পুজো সংখ্যায় ‘আলাদীন ও আশ্চর্য সেলফোন’ আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কোনও কাগজে আমার শেষ লেখা। তার আগে কলকাতা টিভির জন্য ছোট একটা ডকুমেন্টারি করেছিলাম। তারপর থেকেই সিনেমাতেই বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত !


■■ টান পড়লো সিনেমা-রথের চাকায়
আমার প্রথম কাজ ‘নাগরিক রাজার ভিটে’, এটা মহিষাদল রাজবাড়ীর ওপর একটা ডকুমেন্টারি। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে (KIFF) শর্ট ফিল্ম সেকশনে দেখানো হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে একটা ফিচার ছবি করেছিলাম ‘বিবেক’ নামে, ভারত সরকারের পয়সায়। সেটাও KIFF-এ দেখানো হয়েছিল। স্পেশাল চিলড্রেনদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করি, ‘ডিফারেন্ট সোলস’। আর উত্তর কলকাতার গঙ্গা তীরবর্তী ঘাটগুলো নিয়ে আর একটা ডকুমেন্টারি, ‘A letter on the timeline : Riverside, Kolkata North’.
■■ তারপর আরও কিছু…
ছোট ছবি করি পরপর অনেকগুলো–6th august, We are locked, Mirror of RAYs, Brief history of windows–শ্রীলেখা মিত্র, অমৃতা চট্টোপাধ্যায়, রাহুল অনেকে অভিনয় করেছিল। আমার তৈরি আর একটি ছোট ছবি ‘সব রাত্রি কাল্পনিক’ জয়পুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট শর্ট ফিল্ম পুরস্কার পায়। এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলছে। ঋ, সায়ন্তনী আর অমৃতাকে নিয়ে ‘তিন কন্যা’ (Women with keys) আমার সেই অর্থে বড়ো ছবি–একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ হতে চলেছে। ছবিটি ভিয়েনার কাল্ট ক্রিটিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালক ও সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায়। অস্ট্রিয়ার একটি অনলাইন ফেস্টিভ্যালেও পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি।
(চলবে)