Saturday, May 18, 2024
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

জীবনের ছন্দে প্রাণিতা সোনালি

লিখেছেন অজন্তা সিনহা

তারকাদের বিলাসবহুল জীবন আমাদের বরাবরই টানে। সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে সেই টান আরও বাড়বে, তাতে আর সন্দেহ কি ? তবে, আজ আমরা কোনও তারকার বিলাসী জীবনের গল্প বলবো না। আজ সেই তারার কথা–যিনি বিনোদনের আকাশ থেকে অবলুপ্ত হতে হতেও ফিরে এসেছেন। ফিরেছেন আপন কক্ষপথে। সোনালি বেন্দ্রে। রূপসী, গ্ল্যামারাস এই তারকা আক্ষরিক অর্থেই সোনার মানুষ। অভিনয় ও মডেলিংয়ের ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নাম। বহু হিট ছবির নায়িকা। অজস্র নামী-দামি পণ্য ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে তাঁকে দেখেছি আমরা। দেখেছি রিয়ালিটি শোয়ের বিচারকের আসনে। সিনেমা কেরিয়ারের শুরু ১৯৯৪ সালে। তার আগেই অবশ্য মডেল হিসেবে এক পরিচিত মুখ তিনি। ২০০৩ পর্যন্ত টানা বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করার পর কিছুদিনের ব্রেক। এই সময়টায় তাঁকে দেখা গেছে রিয়ালিটি শোয়ের আসরে। একটি টিভি ধারাবাহিকেও অভিনয় করেন ২০১৫ সালে।

তারপরই–২০২৮’র ৪ জুলাই ধরা পড়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। সোনালি নিজেই টুইট করে এ খবর জানান। তিনি নিউইয়র্ক সিটি হসপিটালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন, সেটাও জানা যায়। ওই বছরেরই শেষের দিকে ক্যান্সারকে হারিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। তখনও শারীরিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল সোনালি সংগত কারণেই। তবু, এতটুকু ভেঙে না পড়ে, বলেছিলেন, “নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাই আমি। ছেলে রণবীরের বড় হওয়াটা দেখতে পাব। মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ পাবো।” সেই অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে আজ তিনি আবার কাজের জগতে। ফিরেছেন ডিআইডি লি’ল মাস্টার্স-এর বিচারকের দায়িত্বে। রিয়ালিটি শোয়ের সঙ্গে সোনালির সম্পর্ক অতি পুরোনো। তবে, তাঁর এই ‘কামব্যাক’ সব দিক থেকেই উদযাপন করার মতো। 

হিন্দি ছাড়াও তেলুগু, তামিল, কন্নড় এবং মারাঠা ছবিতে অভিনয় করেছেন সোনালি। নয়ের দশকের প্রথম সারির অভিনেত্রীদের অন্যতম তিনি। ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ডের মতো পুরস্কারও আছে তাঁর ঝুলিতে। দিলজ্বলে, জখম, সরফরোশ, হাম সাথ সাথ হ্যায় ইত্যাদি ছবিতে তিনি শুধু গ্ল্যামারাস এক নায়িকা নন, সংবেদনশীল অভিনয়ে হৃদয়স্পর্শী সোনালিকে ভোলেনি দর্শক। এমনকী ‘কাল হো না হো’ ছবিতে সোনালির গেস্ট এপিয়ারেন্সও ছিল মনে দাগ কাটার মতো। পরবর্তীকালে তামিল, তেলুগু, কন্নড় ও মারাঠা ছবিতেও দারুন সাফল্য পান সোনালি।

ক্যান্সার চিকিৎসা চলাকালীন যে কোনও মানুষকেই নানা প্রক্রিয়া ও পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ক্যান্সার রোগের দুর্দম কষ্টের পাশাপাশি এই প্রক্রিয়াগুলিও কম  যন্ত্রণাদায়ক নয়। সোনালিও এই অভিজ্ঞতার বাইরে নন। তাঁকে চুল কেটে ফেলতে হয়। চেহারায় কষ্ট ও যন্ত্রণার ছাপ প্রকট হতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেসব ছবি সকলেই দেখেছেন। আদতে, এই সম্পূর্ণ বিষয়টি একজন ক্যান্সার রোগীর ওপর প্রবল এক মানসিক চাপেরও সৃষ্টি করে। বিশেষত, গ্ল্যামার দুনিয়ার মানুষজন–নিজেকে আয়নায় যেভাবে দেখতে প্রস্তুত থাকেন তাঁরা, সেটার একেবারে বিপরীত রঙে নিজেকে দেখা, এও এক লড়াই। এ লড়াই নিজের সঙ্গে। হতাশা, আক্ষেপ, প্রতিনিয়ত হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার লড়াই।

সোনালি এই লড়াইটা শিরদাঁড়া সোজা করেই লড়েছেন। তাঁর কাছে এমন এক পরিস্থিতির পর নিছক গ্ল্যামার দুনিয়ায় আবারও বিচরণ করাটা, সুস্থতার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়। কিন্তু, কাজে ফেরার তাগিদ নিশ্চয়ই ছিল। যে কোনও পেশাদারী মানুষই সেটা চাইবেন। কিন্তু তার থেকেও বড় ছিল সম্ভবত নিজের পরিবারের কাছে সমর্পণ। পরিবারের কাছে ফেরার আকুতির কথা নানা প্রেক্ষিতে জানিয়েছেন সোনালি। সোনালি আকুল হয়ে মনেপ্রাণে সবচেয়ে বেশি যেটা চেয়েছিলেন, সেটা নিঃসন্দেহে ছেলে রণবীরের কাছে ফিরতে, যেটা সব মা-ই চাইবেন। স্বামী গোল্ডি বহেল, যিনি আগাগোড়া সোনালির পাশে ছিলেন ওই কঠিন দিনে, তাঁকে ঘিরেও নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে নিয়েছেন সোনালি।

গোল্ডি শুধু সোনালির পাশে থাকেননি, তাঁকে প্রতিমুহূর্তে জীবনের ছন্দে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে সোনালি জানিয়েছেন, “আমি যাতে কাজের জগতে নতুন উদ্যমে পা রাখি, গোল্ডি সে ব্যাপারে আমাকে রীতিমতো জোরাজুরি করেছে। বারবার বলেছে, ‘তুমি ভালো আছো’, ‘বসে থেকে নিজের মেধার অপচয় করো না’, ‘তোমার অবশ্যই কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত’ ইত্যাদি। ও আসলে সবচেয়ে ভালো জানে, কীভাবে ভালো থাকতে পারি আমি।”

রিয়ালিটি শোয়ের বিচারকের আসনে বরাবর এক পজিটিভ ভূমিকায় দেখেছি আমরা সোনালিকে। রিয়ালিটি শোয়ের যোগ-বিয়োগের অঙ্ক সকলেরই জানা। তা সত্ত্বেও, প্রতিযোগীদের সঙ্গে সোনালির সংবেদনশীল ব্যবহার পৃথকভাবে চোখে পড়ে। ফ্যাশন ও গ্ল্যামার দুনিয়ার চাকচিক্য তাঁর ভিতরের মানুষটাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। এইসবের মধ্যে থেকেও এক স্বচ্ছ, সাবলীল, স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন তিনি। সেই মানুষটিকে ইন্ডাস্ট্রি আরও একবার কীভাবে কাছে টানবে, সেটা সম্ভবত সময়ই বলতে পারবে। তবে, টেলিভিশন দুনিয়া তাঁর উপস্থিতির গুরুত্ব বুঝেছে। সোনালি তাঁর অন্দর ও বাইরের সৌন্দর্য নিয়ে স্বমহিমায় আসীন এখানে। সেটে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করছেন। এর চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না।

ডিআইডি লি’ল মাস্টার্স-এর মঞ্চ উজ্জ্বল তাঁর সোনালি হৃদয়ের দীপ্তিতে। দর্শক প্রতি পর্বে অনুভব করছে সোনালির উষ্ণ উপস্থিতি। কোন প্রতিযোগীর জন্মদিন, কার বাড়ির জন্য মন খারাপ–সোনালি তার পাশে। প্রিয় পাঠক, আমিও জানি, প্রতিযোগিতার বাইরে এখানে অনেক কিছুই যুক্ত করা হয়, যা আসলে পল্লবিত। তাগিদটা শোয়ের টিআরপি বাড়িয়ে বাণিজ্যিক লক্ষ্যপূরণ। সাংবাদিক হিসেবে রিয়ালিটি শোয়ের চিত্রনাট্য আমি কলকাতা, মুম্বইয়ের বিভিন্ন শোয়ের অন্দরে গিয়ে দেখেছি। এতকিছুর মধ্যেও, সোনালির অন্তরের বিশুদ্ধতা ঢাকা পড়েনি। তাঁর দুই সহ-বিচারক গীতা কাপুর ও মৌনী রায়ও সোনালির হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ দেখে অভিভূত।

এই প্রতিবেদন এক মানুষের মারণরোগ জয় করে ফেরা শুধু নয়, তাঁর নবজন্মের কাহিনি। তাঁর জন্মগত সৌন্দর্য, গ্ল্যামার, অর্থ,খ্যাতির পিছনে একটা দীর্ঘ চর্চা ও প্রশিক্ষণ পর্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। সেটা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু যেটা প্রাণিত করে, সেটা তাঁর ছন্দে ফেরার মানবিক কাহিনি। সোনালির আত্মবিশ্বাস, দুর্দম আশাবাদী মন, জীবনকে চেটেপুটে নেওয়ার অদম্য জেদ আমাদেরও মৃত্যুকে জয় করে বাঁচতে শেখায়। দুঃখ, যন্ত্রনা, শোক, হতাশা, আক্ষেপ, পরাজয়–কোনোটাই বেঁচে থাকার আনন্দের চেয়ে বড় হতে পারে না–সোনালি আমাদের সে পাঠ শেখালেন।