সুনীলের অরণ্যে আবার চার তরুণের যাপন
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। পাঁচটি দশক পার করে নতুন জমানায় অরণ্যে আবার কোন দিবারাত্রির কাব্য লেখা হয়, সকল বাঙালি সিনেমাপ্রেমীই তার অপেক্ষায়। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
খবরটা সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে ইতিমধ্যেই সিনেমাপ্রেমী দর্শকের গোচরে এসে গিয়েছে। ১৯৭০-এ মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত বিখ্যাত ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ৫২ বছর পর আবার বড়পর্দায় ফিরছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সেই উপন্যাসকে ভিত্তি করে ছবি তৈরি করছেন পরিচালক অরুণ রায়। ২০২৩-এর অক্টোবরে মুক্তি পাওয়ার কথা নতুন জমানার এই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। স্বাভাবিকভাবেই খবরটি ঘিরে বাংলা সিনেমা জগতে আলোচনা তুঙ্গে। একদিকে সাহিত্যিক সুনীল, অন্যদিকে সিনেমার সত্যজিৎ–বাঙালির বড়ই শ্রদ্ধা ও সমাদরের দুটি নাম। সেই স্মৃতির পুনর্নবীকরণ ঘটছে এই সময়ের আর এক বাঙালি পরিচালকের হাত ধরে। উদ্দীপনার অবকাশ তো থাকবেই !
সকলেরই মোটামুটি জানা। তবু, একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে চার অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে কেন্দ্র করে, যারা নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বেড়িয়ে পড়ে পালামৌয়ের পথে, নির্ঝঞ্ঝাট অরণ্য ভ্রমণে। ছবিতে চার বন্ধু অসীম, সঞ্জয়, শেখর ও হরি-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ ও শমিত ভঞ্জ। ছবিতে অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। তাঁদের সঙ্গে ছবিতে দেখা গিয়েছিল কাবেরী বসু ও পাহাড়ি সান্যালকে। ছবির অন্যতম চরিত্র সাঁওতালি মেয়ে দুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সিমি গারেওয়াল। দেশে ও বিদেশে রীতিমতো প্রশংসিত ও সমাদৃত এই ছবিটি ক্লাসিকের তকমা পেয়েছিল। এখানে একটা কথা, সত্যজিতের তৈরি ছবির চিত্ররূপ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনঃপূত হয়নি। ছবিটি যে তাঁর ভালো লাগেনি একথা তিনি সত্যজিতের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে বহুবার বলেছেন। যদিও জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এই ছবির জন্য বিদেশে প্রশংসিত ও সমাদৃত হওয়ায় কিছুটা মন গলেছিল সুনীলের।
এটাও সকলেরই প্রায় জানা, ২০০৩-এ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র চরিত্রগুলিকে নিয়ে ‘আবার অরণ্যে’ শিরোনামে সিকোয়েল তৈরি করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক গৌতম ঘোষ। ছবিতে অসীম, সঞ্জয় ও হরি-র পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে অরণ্য ভ্রমণের বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। সেই ছবিতে অসীম ও অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর। সঞ্জয়ের চরিত্রে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। হরির চরিত্রে শমিত ভঞ্জ। মারণব্যাধি ক্যানসার নিয়ে সেই শেষবারের মতো বড়পর্দায় দেখা গিয়েছিল শমিত ভঞ্জকে।
‘আবার অরণ্যে’-তে অসীম ও অপর্ণার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাব্বু। এটিই ছিল তাঁর প্রথম বাংলা ছবি। ছবিতে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সঞ্জয়ের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী গুলশান আরা চম্পা। সঞ্জয়ের ছেলে ও পুত্রবধূর ভূমিকায় আমরা পাই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও বিদীপ্তা চক্রবর্তীকে। হরির স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়াও ছবিতে দেখা গিয়েছিল যিশু সেনগুপ্ত, রজতাভ দত্ত ও চৈতি ঘোষালকে। প্রসঙ্গত, এই ছবিটিও সমালোচনার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কারণ, ‘আবার অরণ্যে’-তে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যজিতের ছবির বেশ কিছু ক্লিপিংস।
এবার আসি আমাদের আলোচ্য ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ প্রসঙ্গে। ইতিমধ্যেই ‘এগারো’, ‘হীরালাল’, ‘৮/১২ বিনয় বাদল দীনেশ’-এর মতো ছবির জন্য বাংলা ছবির দর্শক চিনেছেন পরিচালক অরুণ রায়কে। আরও বড় চমক, দেবকে বাঘাযতীনের চরিত্রে বড়পর্দায় নিয়ে আসছেন অরুণ। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র ঘোষনা করা হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে বালিগঞ্জস্থিত এক জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন ছবির বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন পরিচালক ও প্রযোজনা সংস্থা। উপস্থিত ছিলেন ছবির কলাকুশলীরাও।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র মতো এক ছবিকে পুনরায় নির্মাণ করার দায়িত্ব নিয়ে বেশ বড় ঝুঁকি যে নিয়ে ফেলেছেন পরিচালক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, ছবিটিকে রিমেক বলতে নারাজ পরিচালক অরুণ রায়। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাসটিকে অবলম্বন করে ছবি তৈরি করছেন পরিচালক। তাঁর কথায়, “আমার ছবিটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবির কোনও সম্পর্ক নেই। ৫০ বছর আগে লেখা একটা উপন্যাস, আজও কতটা প্রাসঙ্গিক, সেটা তুলে ধরতেই এই উপন্যাসটা নিয়ে কাজ করছি। মূল উপন্যাসের চিত্ররূপ হবে আমার ছবিটি।” অর্থাৎ, আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটেই এগোবে নতুন ছবিটির গল্প। নিজেদের মোবাইল ফোন ছেড়ে চার বন্ধু চলে যায় জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করবে তারা। সেটাই মূলত ছবির নির্যাস। ছবির শুটিং হবে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন লোকেশনে। প্রমোদ ফিল্মস নিবেদিত এই ছবির প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছেন প্রতীক চক্রবর্তী। সহ প্রযোজনায় শুভেন কুমার দাস।
ছবির অন্যতম চমক হল ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত অসীম চরিত্রে দেখা যাবে জিতু কমলকে। প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই অনীক দত্ত পরিচালিত ‘অপরাজিত’ ছবিতে তিনি সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এবার সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছেন, এমন একটি গল্পের প্রধান মুখ হচ্ছেন অভিনেতা। ছবির আরেক আকর্ষণ সোহিনী সরকার। অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন কিঞ্জল নন্দ, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অনুষ্কা চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তবে সিমি গারেওয়াল ও রবি ঘোষের চরিত্রে কে অভিনয় করবেন তা এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। এই দুই চরিত্রের শিল্পী চয়ন করতে কিছুটা সময় লাগবে। ছবিতে সংগীত পরিচালনা করছেন সৌম্য ঋত। এই মাস থেকেই ছবির শুটিং শুরু হওয়ার কথা।
ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রে অভিনয় করতে পারার সুযোগ পেয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত জিতু। সাংবাদিক সন্মেলনে তিনি জানান, “সৌমিত্র জেঠু কাজটি করেছিলেন ১৯৭০-এর সময়কালে। আমি ছবিটা করবো ২০২৩-এ। আমি এখনকারই ছেলে। এ ছবি পিরিয়ড পিস নয়। আমি বলবো না, এটা চ্যালেঞ্জ। বলবো না, কোনও ভয় আছে। এটা পথ চলা। আমি উত্তেজিত এই চরিত্রটা করার সুযোগ পেয়ে।” ‘অপরাজিত’ তাঁর কেরিয়ারের অভিমুখ বদলে দিয়েছে। এবার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। জিতুর প্রতি আলাদা করে চোখ থাকবে সবারই। এছাড়া পুরো ছবিটা ঘিরেই নতুন এক প্রত্যাশা যে জন্ম নিয়েছে দর্শকমহলে, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।