সুন্দর এক পদ্মের মতোই পর্দায় ফুটে ওঠে ‘লোটাস ব্লুমস’
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এই বিভাগে মাঝে মাঝে আমরা ভিন্ন ভাষার ছবি নিয়েও আলোচনা রাখছি। আজ তেমনই একটি–মৈথিলী ভাষার ছবি ‘লোটাস ব্লুমস’ নিয়ে লিখেছেন নির্মল ধর।
মৈথিলী হলো, সাধারণত উত্তর বিহার, নেপাল ও বাংলার তরাই অঞ্চলের এক উপজাতীয় ভাষা। প্রায় চার কোটি ভারতীয়ের মাতৃভাষা হচ্ছে মৈথিলী। এখন সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত অন্যতম ভারতীয় ভাষাও বটে। এই ভাষায় শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি, তাঁর লেখা ব্রজবুলি এবং পদাবলী বাংলা সাহিত্যেও যথেষ্ট পরিচিত। মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলার যেমন ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে–তেমনই অসমীয়া, ওড়িয়া ভাষার সঙ্গেও এর যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। প্রতীক শর্মা নামের এক বিহারী তরুণ এই ভাষাতেই বানিয়েছেন ‘লোটাস ব্লুমস’ নামের এক ছবি। আজ এই ছবি নিয়েই আলোচনা করব।
ছবির পটভূমি দ্বারভাঙ্গা অঞ্চলের এক ছোট্ট শহর। সেখানে সরস্বতী নামের এক তরুণী তাঁর একমাত্র কিশোর সন্তান বেণুকে নিয়ে কোনও রকমে লোকের বাড়িতে কাজের মাধ্যমে দিন গুজরান করে। সরস্বতীর স্বামী মধুবনী ঘরানার একজন নিপুণ শিল্পী। সে স্ত্রী ও ছেলেকে ফেলে আরও বেশি রোজগারের জন্য চলে গেছে শহরে। সরস্বতী নিজেও ভালো মধুবনী অঙ্কনশিল্পী। যদিও, তাঁর নিজের শিল্পকে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের কোনও বাসনা নেই। বেচারি সরস্বতীকে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতে হয় কাজের খোঁজে। তাতেই চলে সংসার।
গ্রামের একমাত্র ধনী বাবামশাই তাকে বাড়ির কাজে নিয়োগ করে। ছেলেকে গ্রামের স্কুলেও পাঠায় মা। নিচু জাতের বলে, সেখানেও সে শিক্ষকের কাছে সঠিক ব্যবহার পায় না। একসময় স্কুল থেকে তাড়িয়েই দেওয়া হয় কিশোর বেণুকে। তখন ওই বাবামশাইকে ধরেই সরস্বতী বেণুকে পাঠিয়ে দেয় সিঙ্গাপুর। সেখানে বাবামশায়ের ছেলের সংসারে থেকে বেগার খাটার বিনিময়ে বেণু লেখাপড়ার সুযোগ পাবে, এই আশাতেই মা পাঠিয়ে দেয় তার একমাত্র সন্তানকে।
এদিকে গ্রামেরই এক যুবক অমরেন্দ্র অনেকদিন থেকেই সরস্বতীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল, শহরে গিয়ে সরকারি এক প্রতিষ্ঠানে ছবি এঁকে প্রচুর অর্থ উপার্জনের। সরস্বতী সেই লোভের ফাঁদকে অনেকদিন দূরে ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এবার আর পারল না। কারণ, বেণুর অবস্থা ! বেণু সিঙ্গাপুর চলে যাবার পর সরস্বতী তাকে ফোন করে জানতে পারে, ছেলেকে ওখানে বাড়ির কাজের লোক হিসেবেই শুধু খাটানো হচ্ছে, লেখাপড়ার কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। ছেলেকে ফিরে পেতে চাইলে, বাবামশাইয়ের ছেলের শর্ত, বেণুকে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরিয়ে আনতে অন্তত আড়াই লাখ টাকা লাগবে। সেটা দিলেই ছেলেকে ফিরে পাবে সরস্বতী।
বেণুকে ফিরিয়ে আনার তাগিদে অগত্যা অমরেন্দ্রর প্রস্তাবে সরস্বতীকে রাজি হতেই হয়। মোটা টাকার পারিশ্রমিক পাবার লোভ দেখিয়ে শহরের একটি অফিসঘরের পুরো দেওয়াল সুন্দর মধুবনী ছবি আঁকিয়ে নেয় অমরেন্দ্র। আর সেই সুযোগে সরস্বতীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে উপভোগও করে। স্বপ্ন দেখায় নতুন সংসারের। আর কাজের শেষে পারিশ্রমিক চাইলে সে উধাও হয়ে যায়। সরস্বতী জানতে পারে, অমরেন্দ্র একজন কুখ্যাত জালিয়াত! অর্থাৎ এখানেও ঠকতে হয় সরস্বতীকে। অমরেন্দ্রর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক পায় না সে। ছবির ক্লাইম্যাক্স অবশ্য বেশ ইতিবাচক। বাবামশায়ের ছেলে, যাকে এতদিন খারাপ মানুষ ভেবেছিল সরস্বতী, দেখা গেল, সেইই প্রকৃত ভালো মানুষের কাজটি করল। বেণুকে নিজের খরচে ফিরিয়ে দিল তার মায়ের কাছে।
গল্প এটুকুই। সাধারণত ছবির গল্প আগাম বলে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু পুরো গল্পটা শোনালাম একটাই কারণে–আধা শহর এবং গ্রাম মিলে মৈথিলী ভাষীদের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সম্পর্কের বন্ধনটি আজও রয়েছে, নাগরিকতায় কলুষিত হয়নি, সেটা বোঝানোর জন্য। অমরেন্দ্র এখানে নাগরিক কলুসতার প্রতীক, আর বাবামশাই ও তাঁর ছেলে আপাতভাবে রাগী, দাম্ভিক বা স্বার্থপর হয়েও সহানুভূতি পরায়ণ, সমব্যথী ও যথার্থ সৎ মানুষ। বলা বাহুল্য, পরিচালক প্রতীক শর্মার ‘লোটাস ব্লুমস’ মৈথিলী সমাজের এই অনন্য দিকটিকেই প্রকাশ করেছে।
ছবির শুরু গ্রামীণ প্রকৃতির মাঝে কিশোর বেণু আর তার মায়ের আনন্দমুখর এক জার্নির সঙ্গে ‘জাবর ঝে জাবর ঝে চিককা চর চর…’ একটি প্রচলিত মৈথিলী লোকসঙ্গীতের ব্যবহার দিয়ে। এই ইঙ্গিতটুকুই যেন জানিয়ে দেয়, ‘লোটাস ব্লুমস’ হতে চলেছে জলে ফুটন্ত রঙিন পদ্মফুলের মতোই সুন্দর এক ছবি। অধিকাংশ আঞ্চলিক ভাষার ছবিগুলো যে এখনও পর্যন্ত হলিউডি বা বলিউডি মসলায় রান্না হতে শুরু করেনি, এই ছবিগুলি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পরিচালক প্রতীক শর্মা ছোট গল্প বলার স্টাইলে সহজ ভঙ্গিতে মৈথিলী ভাষায়, নিজের মাটির সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন না করে সুন্দর সাজিয়ে ছবিটি করেছেন। অমরেন্দ্রকে ঠিক ভিলেন সাজাননি, বুঝিয়ে দিয়েছেন সেও এই নাগরিক দূষণের শিকার। তার বিপরীতে রেখেছেন গ্রামের আপাত রুক্ষ, অন্তরে নরম মনের মানুষটিকে। ছবির এমন মানবিক ও স্বাভাবিক উত্তরণই ‘লোটাস ব্লুমস’-এর ইতিবাচক দিক। সিনেমা তৈরির তেমন কোনও অভিজ্ঞতা বা ঐতিহ্য না থাকা সত্ত্বেও আলোকচিত্রী মধু চন্দ্রন ও সুরকার রোহিত শর্মা ছবিটিতে নিজেদের অবদান রেখেছেন শিল্পীর আন্তরিকতা দিয়ে।
প্রধান কয়েকটি চরিত্রে অস্মিতা শর্মা (সরস্বতী), প্রভাত রঘুনন্দন (অমরেন্দ্র), অর্থ (বেণু) এবং পারভেজ আখতার (বাবামশায়ের ছেলে) বেশ সাবলীল অভিনয় করেছেন। তাঁরা যে পেশাদারী অভিনেতা নন, একথা একটিবারও মনে হয়নি। নতুন মুখের এই মৈথিলী শিল্পীরা সুযোগ পেলে আরও ভালো কাজ করবেন, তার সম্ভাবনা জানিয়ে দিয়েছেন নিজেদের ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টায়।