সুরলোকে সম্রাজ্ঞী
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
দশকের একটা হিসেব অবশ্য আছে, মানে কতদিন যাবৎ গাইছেন তিনি। গুগল বলছে সাতটি দশক। দশক নাকি যুগ! কোন হিসেবটা করবো ? ভাবলে গুলিয়ে যায়। আদতে ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে একটি অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন তিনি। লতা মঙ্গেশকর। নাহ, ইচ্ছে করেই ‘প্রয়াত’ কথাটা লিখলাম না। মাঝে মাঝে ব্যাকরণ ভাঙতে ভালোই লাগে। মাঝে মাঝে কঠিন সত্যকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাঁর সম্পর্কে অনুজ শিল্পী শুভমিতা যথার্থই বলছিলেন এক সাক্ষাৎকারে,”ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত ঘটলো তাহলে। বয়স হয়েছে জানি। অসুস্থ হয়েছেন জানি। তবু, বিশ্বাস হয় না ওঁর এই চলে যাওয়া। ঈশ্বরের কী মৃত্যু হয় ?” নাহ, ঈশ্বরের মৃত্যু হয় না। মর্ত্যের সরস্বতী তিনি। এক লোক থেকে আর এক লোকে, অর্থাৎ স্বর্গলোকে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু, সেটা কী করে সম্ভব ?
দেবী সরস্বতীর মৃন্ময় মূর্তির মতোই তাঁর পার্থিব দেহের বিসর্জন ঘটেছে। কিন্তু আত্মা তো অমর। অগণিত ভারতবাসী, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লতাজির অসংখ্য ভক্ত মনে করেন, তাঁর কণ্ঠের মৃত্যু নেই। শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায় কথা বলতে গিয়ে কার্যত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আপনজনের বিয়োগ ব্যাথা গোপন করেননি। বলছিলেন, “আজও লতাদিদির গান শুনে শিখি।” বলছিলেন মুম্বইতে লতাজির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখার দিনটির গল্প। কীভাবে একেবারে নতুন, প্রায় কিশোরী এক শিল্পীকে বরণ করে নিয়েছিলেন লতাজি। শুনে কিছু বিতর্কিত প্রচারের কথা মনে পড়ছিল। কারা যেন বলতো, লতাজি ইন্ডাস্ট্রিতে অন্য কোনও শিল্পীকে দাঁড়াতে দেন না ! তাহলে তো আরতি মুখোপাধ্যায়ের এই কান্না মিথ্যে হয়ে যায়। সত্যি বলতে, লতাজির কী কোনও প্রয়োজন ছিল, এইসব ক্ষুদ্রতা চর্চার ? ওঁর ধারেকাছে কে ছিল বা কে আছে ? আর কখনই বা করবেন। দিবারাত্র তো গানেই মগ্ন থেকেছেন।
পরের জন্মে তিনি আর লতা মঙ্গেশকর হয়ে জন্মাতে চান না–কোনও এক টিভি চ্যানেলে প্রচারিত তাঁর এক সাক্ষাৎকার সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। সেই সূত্রেই তাঁর এই ভাবনার বিষয়ে জানতে পারি আমরা। প্রশ্ন জাগে, কেন ? নামের ভার, কমিটমেন্ট রাখার তাগিদ কী একটা সময়ের পর বোঝা হয়ে যায় ? নাকি পেশাদারী জীবন নয়, ব্যক্তিগত যাপন তাঁকে এমন উপলব্ধি দিয়েছে ! সেখানে কী কোনও শূন্যতা ছিল ? জানি এসব প্রশ্ন তোলা বারণ ! জীবন্ত কিংবদন্তী ছিলেন। কিন্তু মানুষের সুখদুঃখের বাইরে নন তিনিও। চূড়ান্ত পেশাদারী সাফল্য, অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, অনুরাগের পর একান্তের মানুষের জন্য কোনও চাওয়া থাকবে না, এতটা নির্লিপ্ত উদাসীন কী তিনি ছিলেন ? থাকলে তো অমন এক একটি সংবেদনশীল গান তাঁর কণ্ঠে প্রাণ পেত না !
সংসারের হাল ধরার জন্য একদা সংগীতকে পেশা করতে হয়েছিল তাঁকে। নাহ, শুরুতে অভিনয়। কয়েকটি ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করেন তিনি। ওই পুরোনো টিভি সাক্ষাৎকারটিতেই লতাজি বলছিলেন শুনছিলাম,”অভিনয় করতে ভালো লাগতো না আমার। গানই বেশি পছন্দের ছিল। নিরুপায় হয়ে করতাম। তখন যে কাজে সুযোগ পাবো, সেটাই করবো–এতটাই মরিয়া আমি। বাবা অসময়ে চলে গেলেন। মা আর ভাইবোনদের কে দেখবে ? সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হলো। আমি সবার বড়।” এরপর প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই গান-দরিয়ায় ভেসে পড়া। তারপরের ইতিহাস জানেন পাঠক। শুধু একটা কথা, যে সংসারের হাল ধরার জন্য অনাগ্রহের অভিনয়ও করতে রাজি হয়ে যান একদা, সেই সংসার কী সেকথা মনে রেখেছিল? শুনেছি শেষের দিনগুলোয় খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে গেছিলেন লতাজি।
সংসার। চিরকাল তাঁর সংসার বলতে মা-বাবা, ভাই-বোনেরা। বিয়ে-থা তো করলেনই না। “ভাগ্যিস করেননি। তাই তো জীবনটা গানে নিবেদন করতে পেরেছিলেন”–দৃঢ় প্রত্যয়ে বলছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। বিবাহ আর কেরিয়ার নিয়ে মেয়েদের চিরন্তন লড়াই। আরতির এই লড়াইয়ের দিনগুলিতে লতাজি কী বলছেন, শুনুন–”মানিয়ে চলো। ছেলেটা আছে। নিজেকে শান্ত,স্থির রেখে গানটা করে যাও।” সেটাই করেন আরতি। তাঁর লতাদিদির কথা অমান্য করেননি তিনি। এই প্রেক্ষিতেই লতাজির চলে যাওয়ার মুহূর্তে আরতি মুখোপাধ্যায়ের উপলব্ধি, “শান্তি শব্দটা আলোর মতো ঘিরে রেখেছিল লতাদিদিকে। কখনও হইচই করতে দেখিনি। শেষের দিনেও দেখো, কী শান্ত, সমাহিত ওঁর যাত্রা।” আসলে, মেয়েদের তথাকথিত সংসার জীবন, কেরিয়ার, সমাজের রক্তচক্ষু, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব–এই যাবতীয় ক্লিশে বিষয়গুলিকে ঝেড়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। যেভাবে শুধু সংগীতকে সামনে রেখে এগিয়ে গেছেন লতাজি, তা হিমালয়ের গুহায় বসে ধ্যানমগ্ন সাধকদের সাধনার থেকে কোনও অংশে কম নয়। সাধনা তাঁর কণ্ঠের–সাধনা যাপনের।
পরের জন্মে উনি কী হতে চান, কী হবেন–সেটা একটি তর্কের বিষয়। আমরা কেউই জন্মান্তরের কথা জানি না। কিন্তু এটা সকলেই জানি, লতাজি একজন্মেই সংগীতের নতুন ইতিহাস রচনা করে ফেলেছেন। তাঁর প্রজন্ম থেকে পরের কয়েক প্রজন্ম, শুনে চলেছে তাঁর গান। অক্লান্ত এই শোনার পালা যে শারীরিক মৃত্যুতে শেষ হবার নয়, সে তো তাঁর জীবৎকালেই প্রমাণিত। শুভমিতার কথা এ প্রসঙ্গে আর একবার নিয়ে আসবো, “যেমন রবীন্দ্রসংগীত, জীবনের সব অবস্থায় গাইবার কিছু না কিছু মিলেই যায়। তেমনই লতাজির গান। আমাদের জীবনের প্রতিটি অনুভবে খুঁজলেই পাওয়া যাবে তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানের কোনও একটিকে।” অজস্র গাওয়া আর সবই সফল–এই রেকর্ডেও অদ্বিতীয়া তিনি।
সংগীতশিল্পী অরুন্ধতী হোম চৌধুরী বললেন, “আজ লতাজির চলে যাওয়ার এই ক্ষণে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আমরা লতাজির কী মূল্যায়ন করবো ? হেমন্তদা ওঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারতেন। বাংলা গানে উনিই নিয়ে এসেছিলেন লতাজিকে। একটা ভাষা না জেনেও কতটা অভিব্যক্তি গানে আনা যায়, লতাজি ছিলেন তার এক অতুলনীয় উদাহরণ।” আসলে, নিজেকে ভাঙতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। গড়তে পারারও। তাই তো সমস্ত গীতিকার, সুরকার ও সহশিল্পীদের এত প্রিয় ছিলেন তিনি। শেখার ক্ষেত্রে ক্লান্তি ছিল না তাঁর। আরতি বললেন, “রেকর্ডিং বা মঞ্চ অনুষ্ঠানের পর দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ঠিক ছিল ?’ ভাবা যায় ? কে করছেন এই প্রশ্ন ? জীবন্ত কিংবদন্তী যিনি আমাদের কাছে !”
এই ভাঙাগড়ার প্রেক্ষিতেও মনে হয়, কী অদ্ভুত বৈপরীত্য–তাঁর গান ঠোঁটে নিয়ে নায়িকারা বিকিনি থেকে জিন্স-টি শার্ট, ঘাগরা-চোলি থেকে স্কিন টাইট পোশাক পরে যখন পর্দায় অবতীর্ণ হচ্ছেন–তিনি তখন সেই এক সাদা শাড়ি পরে, বিনুনি বেঁধে হয় রেকর্ডিং, নয় রেওয়াজ। মাঝে মাঝে মঞ্চ অনুষ্ঠান। নায়িকাদের বিলাসবহুল জীবনের ঠিক উল্টোপথে চলাই ছিল লতাজির সংস্কৃতি। শুধু নায়িকা কেন, তাঁর পরের প্রজন্মের, এমনকী বোন আশা ভোঁসলেও তো সাজপোশাকে দুরস্ত থাকার পক্ষপাতী। সেটা দোষেরও নয়। তবে, লতাজি চিরদিন শ্বেতশুভ্র বৈভবহীন জীবনভাবনার প্রতীকই থেকে গেলেন। আর তাতেই অনন্যা হয়ে মানুষের স্মৃতিপটে থেকে গেল তাঁর ছবি।
লতাজির সংগীতক্ষেত্রে অবদান নিয়ে যতই বলি, বলাটা শেষ হবে না। রীতিমতো ইনডেক্স বানাতে হবে, লতাজির গানের ক্রমানুসার বজায় রাখার জন্য। শুধু ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর যে অবদান, তা নিয়ে বলতে গেলেও পাতার পর পাতা লিখতে হবে। নতুন সংগীত পরিচালক, নতুন নায়িকা, নতুন পুরুষ প্লেব্যাক সিঙ্গার–অনেককেই টেনে নিয়ে গেছেন লতাজি। নায়িকার প্রথম ছবি–প্লেব্যাকে লতা মঙ্গেশকর। সব গান হিট। নায়িকা হিট। তাঁর কেরিয়ারের পানসি ভেসে পড়লো সিনেমার বাজারে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তাঁদের প্রতিষ্ঠা ধরে রেখেছে, লতাজির গাওয়া হিট গান। ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবির যে ফর্মূলা, সেখানে বিভিন্ন সিকোয়েন্স-এর ক্ষেত্রে গান অপরিহার্য। আর সব সিকোয়েন্স, সব নায়িকার মতো করে গান আর কে গাইতে পারতেন ? নাহ, আজও তেমন কেউ আসেননি। ভবিষ্যতেও আসবেন না।
এই যে আর কেউ নেই। আর কেউ এমন হবেন না কোনও দিন–এই জনশ্রুতিটা তৈরি করে গেলেন লতাজি নিজেই। প্রচারসর্বস্ব যুগে তিনি এক বিরল ব্যতিক্রম। নিজের মধ্যে, নিজের মতো করেই বাঁচলেন। প্রচার মাধ্যম তাঁর পিছনে ছুটে গেল চিরকাল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে এমন নীরব সাধনায় মগ্ন থাকা সহজ নয়। অথচ সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে। অগণিত মানুষ কুর্নিশ জানায় তাঁকে। সারা বিশ্বকে নিজের সংগীতের জাদুছায়ার নিচে একত্রিত করেন তিনি। ভারতকে চেনান সারা বিশ্বের দরবারে। এ এক অদ্ভুত জীবনের উপাখ্যান। সংগীত ভালোবাসেন, সংগীত নিয়ে বাঁচেন–এমন আরও কেউ হয়তো আছেন। কিন্তু, তাঁদের জীবনে আরও কিছু অনুষঙ্গ আছে। শুধু সংগীত নিয়েই বেঁচে থাকতে একজনকেই দেখলাম আমরা। তিনি লতা মঙ্গেশকর। এক ও অদ্বিতীয়।
এতকিছু দিয়ে গেলেন। এত সাধনা। তবু, জীবনের যাবতীয় প্রাপ্তিকে ঈশ্বরের দান বলেই অভিহিত করেছেন। নিজের সাধনাকে দিয়েছেন সামান্য কৃতিত্ব। এ বিনয় অভাবনীয়। তুলনাহীন তাঁর নম্রতা। কোথাও একটা শুনেছিলাম, ঈশ্বর অহংকার ক্ষমা করেন না। তাহলে নিরহংকারীকে নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করেন। সংগীতের ঈশ্বর লতাজির শুধু কণ্ঠ নয় চরিত্রের বাকি গুণগুলিকেও বিচারে রেখেছিলেন বোঝাই যাচ্ছে। তাই তো, জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত সংগীত লতাজির সাথী হয়ে থেকেছে। তাঁর ঈশ্বর, তাঁর প্রেমিক, তাঁর স্বামী ও সন্তান–সব সম্পর্ক মূর্ত হয়েছে সংগীতে।
স্বর্গ থেকে দেবী সরস্বতী নিশ্চয়ই দেখেছেন মর্ত্যের সরস্বতীর সংগীত যাপন। কষ্ট কল্পনা জানি। তবু, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এখন তিনি বিশ্রাম করছেন সুরলোকে। তবে, মর্ত্যের সরস্বতীর যাত্রা এখানেই শেষ নয়। পরজন্মে আবার তাঁকে নিশ্চয়ই পাবে শ্রোতারা। গান ছাড়া কী করে থাকবেন তিনি ? হয়তো জন্ম নেবেন অন্য কোনও পৃথিবীতে। তাঁর সুমধুর কণ্ঠে প্লাবিত হবে দেশ-কাল। পৃথিবীর কোনে কোনে ছড়িয়ে পড়বে তার সুরেলা কণ্ঠের অমৃতসংগীত। আবার সম্রাজ্ঞীর মতো রাজত্ব করবেন এই অমৃতকন্যা। মানুষের হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠবে অন্তহীন, অনাবিল সংগীত সুধারসে।
*ছবি সংগৃহীত