সেবার আদর্শে অতুলনীয় ডঃ গ্রাহামস হোম
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
গন্তব্য কালিম্পং। উত্তরবঙ্গে স্থায়ী বসবাস শুরুর পর থেকে হঠাৎ করে, পরিকল্পনা বিহীন বেরিয়ে পড়ার ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটছে। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিম্পং যাবার বাস ও গাড়ি ছাড়ে। আবার পানি ট্যাঙ্কি থেকেও শেয়ার গাড়ি ছাড়ে, বাসও যায়। বাড়ির কাছে পানি ট্যাঙ্কিতেই এলাম। এক বন্ধুর সঙ্গী হয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। শিলিগুড়ি শহরের ঘুম তখন একটু একটু ভাঙছে। সেটা ছিল এক ভাইফোঁটার দিন। ফলে গাড়ি ও যাত্রী দুইই কম। রাস্তা ফাঁকা, গাড়ি খুব তাড়াতাড়ি গতি নিল। দ্রুত পার হলাম শহর, তারপর মহানন্দা রিজার্ভ ফরেস্ট, শেষে তিস্তাকে ডাইনে রেখে গাড়ি চলল উৎরাইয়ের পথে।
ঘন্টা দুই পার করে কালিম্পং শহরের প্রবেশপথ ছুঁতেই বাঁদিকে উঁকি দিলেন তিনি। আজ্ঞে কাঞ্চনজঙ্ঘা ! আজকাল আমার প্রতি কিছু সদয় ইনি। গাড়ি আর একটু যেতেই আবার দৃশ্যবদল। কাঞ্চনজঙ্ঘা উধাও। একটি মাঝারি মানের হোটেলে উঠেছি। খুব বেশি আয়োজন না থাক,পরিচ্ছন্নতা বিদ্যমান। নিয়মমতো ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সেরে বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম। আগে থেকেই ভাবা ছিল, এবার ডঃ গ্রাহামস হোম দেখতে যাব। কালিম্পঙে আগত পর্যটকরা অনেকেই হয়তো এর সম্পর্কে জানেন। আমারও কিছুটা জানা গুগলদাদুর কল্যাণে। কালিম্পঙে বার দুয়েক যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকবার পেডং ও বারমেক যাওয়ার পথে বাইরে থেকে দেখেছি এই হোম। পাহাড়ের গায়ে, বড় বড় গাছপালা ঘেরা স্কুল বাড়ি, গির্জা, চিকিৎসাকেন্দ্র–সব মিলিয়ে এক বিশাল কর্মকান্ড। এবার ভিতরে গিয়ে দেখবো। তার আগে, এই কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার প্রাণপুরুষ যিনি, তাঁর কথা।
রেভারেন্ড জন এন্ডারসন গ্রাহাম। কালিম্পঙে প্রথম পা রাখেন ১৮৮৭ সালে, দার্জিলিং মিশনের কাজে। মানুষের সেবার মিশন। সাল ১৯০০, গ্রাহামসনের স্বপ্নের যাত্রা শুরু। অঞ্চলের বিশেষ কিছু শিশুর জন্য একটি হোম প্রস্তুত করবার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কোন শিশু, না, সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয় যাদের জন্ম। এই শিশুদের মায়েরা চা বাগানে কর্মরত–যাঁরা এই অঞ্চলের অধিবাসী। বাবারা ব্রিটিশ–যাদের এদেশে আগমন কর্মসূত্রে। এই মা-বাবার সম্পর্ক যেহেতু নিছক ঘটনাচক্র, সেখানে শিশুদের সামাজিক অবস্থান বুঝতে অসুবিধা হয় না। আঞ্চলিক সমাজ এদের অবহেলায় দূরে ঠেলে দিলেও গ্রাহাম চুপ করে বসে থাকেননি। তাঁর হৃদয় তাঁকে নাড়া দিয়ে বলেছে, এই অসহায় শিশুদের জন্য আশ্রয় ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই সেদিন ওই কেন্দ্রের পত্তন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে ভুটান ও তিব্বত থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের শিশুরাও স্থান পায় এখানে।
এরপর একে একে নানা কাজ। এখানকার কৃষকদের জন্য সংগঠিত হলো কালিম্পং মেলা। সঙ্গে তাঁতীদের জন্য সিল্ক কমিটিও তৈরি হলো ডঃ গ্রাহামের উদ্যোগে। কালিম্পঙের প্রথম কোঅপারেটিভ সোসাইটিও তিনিই গঠন করেন। স্বল্প পরিসরে ডঃ গ্রাহামের বিস্তৃত কর্মকান্ড আলোচনা করা অসম্ভব। এটা বলা যেতে পারে, ৬ জন শিশু আর একজন হাউসমাদারকে নিয়ে ১৯০০ সালে যে হোম প্রতিষ্ঠিত হয়, আজ তা মহীরুহ। স্কুল বিল্ডিং ছাড়াও ল্যাবরেটরি, মিউজিয়াম, খেলার বিশাল মাঠ ইত্যাদি সব নিয়ে পরিপূর্ণ এক শিক্ষা আবহ গ্রাহামস হোমকে অভিনবত্ব দান করেছে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে এই প্রতিষ্ঠানের নাম। বিশ্বের বহু নামী ও প্রতিষ্ঠিত মানুষ এখানকার প্রাক্তন ছাত্র। স্ত্রী ক্যাথরিন ও আরও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীকে নিয়ে ডঃ গ্রাহাম এই হোমকে ঘিরে একে একে গড়ে তোলেন বহু সংস্থা। শিক্ষার বিস্তারে নানা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৯৪২-এ ডঃ গ্রাহামের জীবনাবসান। রেখে যান হাজারের ওপর ছেলেমেয়ে, যাদের কাছে তখন তিনি ড্যাডি গ্রাহাম। তিনি চলে যাওয়ার পরেও থামেনি কাজ। তাঁর আদর্শ বহন করে এক ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালনায় চলছে গ্রাহামস হোমের কাজ।
এমন এক মানুষ আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত হোম ও তাকে কেন্দ্র করে এই কর্মযজ্ঞ–মাথা অবনত হয় স্বাভাবিকভাবেই। সেই দিনটি আমার কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের সমস্ত প্রান্তে। দূরে দেলোর উঁকিঝুঁকি। আর এক দিকে শহর কালিম্পং। মাঝে গ্রাহামস হোম। গির্জার চূড়ো আকাশ ছুঁয়েছে। সেখানে পিছলে যাচ্ছে গোধূলির নরম আলো। ঘাসের গালিচা পাতা সবুজ খেলার মাঠে ছেলের দল। পথ চলে গেছে সোজা, দুপাশে জঙ্গল ফেলে। বড় মায়াবী সব কিছু এখানে। ফেলে আসতে মন চায় না। তবু ফেরা। একরাশ ভালো লাগা নিয়ে প্রথমে হোটেলে। তারপর রাত পোহালে শিলিগুড়ি। উৎসাহীরা যাওয়ার আগে গুগল সার্চ করে নিলে ভালো হয়। হোম ঘুরে দেখার নির্দিষ্ট সময় আছে। সেটা পরিবর্তিত হতেই পারে।