স্কাল্পচার অ্যান্ড দ্য এন্ডলেস জার্নি
কিংবদন্তি ভাস্কর-শিল্পী উমা সিদ্ধান্তর সারা জীবনের সৃষ্টি-সামগ্রী নিয়ে গত ২২শে জুলাই নন্দন ৩-এ দেখানো হলো তথ্যচিত্র ‘স্কাল্পচার অ্যান্ড দ্য এন্ডলেস জার্নি’। শিল্পীপুত্র অধ্যাপক আশিস সিদ্ধান্তর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। সিদ্ধান্ত পরিবারের ঘনিষ্ঠ, বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান জুনিয়র পি সি সরকারের বক্তব্যে অনেক স্মৃতি বিজড়িত আবেগের কথা জানতে পারলাম। শিল্প সমালোচক প্রশান্ত দাঁয়ের মতে, যেমন এসথেটিকের পরিমাপ করা যায় না, তেমনি উমাদির মতো একজন শিল্পীকেও মাপার বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। ওঁর কথায়, “ভারতবর্ষ ভাস্কর্যের দেশ। তবে, এদেশে ভাস্কর্যের দীর্ঘ ইতিহাসে, সবই পুরুষ। মহিলা ভাস্করের কথা জানা যায় না। বিংশ শতাব্দীর চার/পাঁচের দশকে আমরা পাই কমলা দাশগুপ্ত, উমা সিদ্ধান্ত এবং মীরা মুখার্জিকে।” উমাদির কাজের বিস্তারিত বর্ণনার শেষে তিনি আবেদন রাখলেন, যে অতীতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে, সেই অতীতকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
এরপর মূল পর্ব। আলো-আঁধারির মাঝে বেজে উঠল তবলা সঙ্গতের বিপুল তরঙ্গ। পরপর দৃশ্যায়িত হলো শিল্পীর এক একটি অবিস্মরণীয় ভাস্কর্য। ভাঙা-গড়ার খেলা নিয়ে পর্দায় উপস্থিত হলেন উমা সিদ্ধান্ত। স্মৃতি থেকে একের পর এক ব্যক্ত করলেন নিজের পরিক্রমার ইতিহাস। একদিকে শিক্ষাগুরুর কাছে শিখেছেন, প্রকৃতিকে কীভাবে দেখতে হয় ! অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই তাঁর সহজাত স্বভাব ছিল, হাতে পেলেই কিছু একটা তৈরি করা। ময়দা মাখার পর, সেসময় মজা করে মায়েরা ল এ, ল এ সাপ বানাতো। এই ল এ, ল এ সাপ থেকেই তিনি প্রথম পুতুল বানান।
বেঙ্গল মিউজিক কলেজে গান শিখতে গিয়ে আর্ট বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে শিক্ষক হিসেবে প্রথম পান নন্দলাল বসুর ছাত্র ফণীভূষণ দাসকে। শান্তিনিকেতনের মতো ক্রাফট, বাটিক, লেদারের কাজ থেকে শুরু করে পেণ্টিং, স্কাল্পচারের প্রথম হাতেখড়ি ফণীভূষণবাবুর কাছেই। তথ্যচিত্রে সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলেন উমা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষক সুমিত্রা সেনের মতে ‘উমা ভীষণ পণ্ডিত’। ভাস্কর শংকর ঘোষ বললেন, “আমাদের ক্লাশে কয়েকজন ছেলে ছাড়া একমাত্র ছাত্রী ছিল উমা। ‘মাদার এণ্ড চাইল্ড’-এর অনেক কাজ ও করেছে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে উমা একটা ল্যাণ্ডমার্ক রেখে গেছে।”
১৯৫১ সালে সরকারি আর্ট কলেজে উমা সিদ্ধান্ত ভর্তি হন। সেসময় প্রিন্সিপাল ছিলেন রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। উনি উমা সিদ্ধান্তর বিষয় নির্বাচন দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন,”তুমি ভাস্কর্য করবে ? কত দৈহিক পরিশ্রম এতে লাগে, তুমি জানো ? ছেলেরাই একে সামলাতে পারে না। মেয়েদের পক্ষে তো মোটেই সম্ভব নয়।” এর উত্তরে উমা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন, “পল্লীগ্রামে গিয়ে দেখবেন, গ্রামের মেয়েরা কতদূর থেকে জল বয়ে আনে। ভারী ভারী জিনিস মাথায় বয়ে বয়ে নিয়ে আসে। আমি পারবো না কেন? আমাকে একটা সুযোগ দিন।” সহশিক্ষক গোপাল ঘোষ, রথীন মৈত্রর সাথে আলোচনা করে রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, “ঠিক আছে, দিয়ে দাও। তিনদিন পর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসবে।” কিন্তু আখেরে ফল হলো উল্টো। উমা সিদ্ধান্ত ভর্তির পর দেখিয়ে দিলেন তাঁর কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতা।
একাডেমিতে বার্ষিক প্রদর্শনী হচ্ছে। উমাও ছাত্র অবস্থায় প্রদর্শনীতে কাজ দিলেন এবং বহু নামী শিল্পীর পাশাপাশি ভাস্কর্যে ‘গোল্ড মেডেল’ পেলেন। উমার ভর্তির পরই সে বছর ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান হয়ে আসেন প্রদোষ দাশগুপ্ত। মূলত শিল্পের যত কলা-কৌশল তাঁর শেখা এই প্রদোষবাবুর কাছ থেকেই। কন্যাসম স্নেহে গড়ে তুলেছিলেন তিনি উমাকে। উমা সিদ্ধান্তর সুরিয়্যালিস্টিক পদ্ধতিতে নির্মিত ‘চার চাকার একটি মোটর’ কাজটি দেখে গুরু প্রদোষ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “এই কাজটায় জোর আছে। উমার অনেক কাজের মধ্যে এ কাজটা অনেকদিন বেঁচে থাকবে। অনেকের হয়তো দালির কথা মনে পড়বে।”
উমা সিদ্ধান্ত নিজের কাজ নিয়ে বলছেন–ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় শ্রোতা-দর্শকে বুঁদ হয়ে আছেন। প্রেক্ষাগৃহে পিন-পতন নৈঃশব্দ। উমার বয়স এখন ৯১ বছর। স্মৃতি চলে গেলেও, বোঝা যায়, আভ্যন্তরীণ জগতে চলেছে সেই আগের মতোই অন্বেষণ। একদিকে ভাস্কর, চিত্রকর, গবেষক–আবার শিক্ষিকা ও সাহিত্যিক। শ্রী শিক্ষায়তন কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়াও বই লিখেছেন–বিভা আনন্দ, লোকশিল্পে লোকশিক্ষা এবং ইউরোপের ডাইরি। তিনি গবেষক হিসেবে নিরক্ষর মানুষের জন্য আবিষ্কার করেন আয়তনিক ফর্ম, যার থেকে শেখা যায়–অ, আ, ক, খ। এই গবেষণার জন্য তিনি NCRT পুরস্কার পান।
সুপারিগাছের ছালকে প্রসেস করে ছবির পট তৈরি করে ছবি এঁকেছেন এবং এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সার্থক তিনি। সব কিছুতেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উমার উৎসাহ ছিল প্রবল। ফলে, তাঁর কাজ কখনও এক জায়গায় থেমে থাকেনি। প্রকৃতিজাত ফর্ম, পশুর আকৃতি, মানব অবয়বধর্মীর পারস্পরিক সম্পর্ক, মুখের নেগেটিভ অভিব্যক্তি, ভাব ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছেন। মেটাল কাস্টিং, ব্রোঞ্জ, মাটি, কাঠ–সব উপাদানের মধ্যেই সমানে ক্রমবিবর্তন এসেছে। রূপ পাল্টেছে সময়ের সাথে সাথে। তথ্যচিত্রে ক্ষোভের সুরে উমা সিদ্ধান্ত বলেন, “হাজরা পার্কে তাঁর তৈরি একটি ভাস্কর্য বসানো হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দুঃখের বিষয়, পাতালরেলের ক্রেন পড়ে গিয়ে ওটা চুরমার হয়ে যায়। এই নিয়ে কোথাও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলো না।” বলা বাহুল্য, এ লজ্জা আমাদের সবার।
তথ্যচিত্র শেষ হচ্ছে স্বনামধন্যা শিল্পীর কণ্ঠে স্বরচিত দীর্ঘ পাঠ দিয়ে–
“সাম্প্রদায়িক আকাশে বাতাসে
বাজায় যে রণভেরী
দাঙ্গাপীড়িত মানুষ শুধায়
শান্তির কতো দেরী?…”
সমাপ্তিশেষে এক ঘণ্টার তথ্যচিত্রটির সংবেদনশীল পরিচালক দীপংকর বসু যথার্থই বলেন,”এই তথচিত্রটি, সমুদ্রের জলকে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখার প্রচেষ্টা মাত্র।” পিয়ালী গাঙ্গুলি