স্মৃতি ও বেদনার খোশবাগ
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। আজ মুর্শিদাবাদের খোশবাগ। লিখেছেন অজন্তা সিনহা
যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় মানুষটির সমাধিতে মোমবাতি, ধূপ জ্বালাতেন সন্ধ্যায়। ছড়িয়ে দিতেন আতর। দাঁড়িয়ে আছি খোশবাগে। রোদ্দুর মাখা এক বসন্ত সকাল। গাইড বর্ণনা করছেন আর আমি শুনতে শুনতে পৌঁছে যাচ্ছি ইতিহাসের সেই দিনগুলিতে। এ ইতিহাস চরম বেদনার। এ ইতিহাস লজ্জার। বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার যুগসন্ধিক্ষণ। সেদিন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজৌদ্দল্লার পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুশো বছরের জন্য পরাধীন হয়েছিল এই উপমহাদেশ, স্বাধীনতা হারিয়েছিল একটি জাতি। বলা যায়, এই আবেগ, এই গুরুত্বই ভূমিকায় নিয়ে আসে খোশবাগকে। ইতিহাসের গন্ধমাখা মুর্শিদাবাদে এলে একবার আপনাকে এসে দাঁড়াতেই হবে খোশবাগে।
বহরমপুর থেকে ভাগীরথী পার হয়ে চলেছি খোশবাগ দর্শনে। নাহ, নদীপথে নয়। সেদিন গেছে। এখন এপার-ওপার ফ্লাইওভারে নদী পারাপার, নাও বদলে গেছে চারচাকা গাড়িতে। খোশবাগ। এখানেই চিরশান্তির ঘুমে শুয়ে আছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। সিরাজৌদ্দল্লা–যেমন বর্ণময় বিতর্কিত জীবন, তেমনই মর্মান্তিক তাঁর অন্তিম পরিণতি। সাধারণভাবে পাহাড়প্রেমী হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির প্রতিও আকর্ষণ রয়েছে আমার। আর মুর্শিদাবাদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য টানের কেন্দ্রে শুরু থেকেই ছিল খোশবাগ। তার কারণ নিঃসন্দেহে সিরাজের বিতর্কিত ও বহু বর্ণে রঞ্জিত জীবনগাথা। তাঁকে নিয়ে নিন্দার বহু তথ্য রয়েছে ইতিহাসের পাতা জুড়ে। তবু এ সত্য ইতিহাসও অস্বীকার করতে পারবে না, যে, তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথিকৃৎ।
প্রথমবার যাই ফেব্রুয়ারিতে। খোশবাগের ভিতরের বাগানে তখন গাছপালার ফাঁকফোকড় দিয়ে চুইয়ে পড়ছে মিঠে আবেশ মাখানো রোদ। নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের পারিবারিক সমাধিস্থল এটা। তাঁর পরিবারের প্রায় সকলেই শায়িত এখানে। কেন জানি না, গাইডের মুখে খোশবাগের ইতিহাস শুনতে শুনতেই মনে হচ্ছিল, এখানে একবার ভরা বর্ষায় আসতে হবে। অনুভব বলছিল, আকাশের কান্না আজও ধুয়ে দেয় খোশবাগে শায়িত সিরাজ, মেহেরুন্নেসার সমাধি। সেই অনুষঙ্গ মেনেই ভরা শ্রাবণে দ্বিতীয়বার আসা।
ইতিহাসের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নেই–ঐতিহাসিক সম্পদগুলির দূরাবস্থা দেখলেই বিষয়টি অনুভূত হয়। মুর্শিদাবাদের বহু প্রাচীন কীর্তি এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর দায়িত্ব নেওয়ার পর অবস্থা বদলেছে। দেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক মূল্যবান স্মৃতিসৌধগুলির মতো করেই মুর্শিদাবাদের খোশবাগ, কাটরা মসজিদ, হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া, মোতিঝিল, বাচ্চাওয়ালি তোপ ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করছে এই বিভাগ। আর দফতরের পক্ষ থেকে শিক্ষিত গাইডও রাখা হয়েছে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে। এতে সকলেরই সুবিধা হচ্ছে।
দ্রষ্টব্যের অভাব নেই মুর্শিদাবাদে। একদা বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী বলে কথা ! ধ্বংস ও অবলুপ্তির পরও যা আছে, তা দেখার জন্য কমপক্ষে ৩/৪ দিন জরুরি। সমান জরুরি কিছুটা হোমওয়ার্ক করে যাওয়া। প্রচুর বইপত্র আছে। তবে, চটজলদি জানতে গুগলদাদুই ভরসা। সত্যি কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হোমওয়ার্ক করতে গিয়েই দেখলাম, মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা নেই আমার। আর গিয়ে দেখলাম, পড়ে যা জেনেছি, তাও অসম্পূর্ণ। আমি দুবার গেছি, তাতেও বাকি থেকে গেছে অনেক।
ভাগীরথীর তীরবর্তী খোশবাগ আদতে এই গোলাপবাগান ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁয়ের পারিবারিক অবকাশ যাপনের প্রিয় ক্ষেত্র। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বজরায় করে এখানে আসতেন তিনি। গোলাপের খুশবু থেকেই খোশবাগ নামকরণ। বড় আনন্দের ছিল সেই দিন। আলীবর্দীর পেয়ারের নাতি সিরাজ। সিরাজ চাইলে আকাশের চাঁদ এনে দিতে পারেন তিনি। সেখানে মেহেরুন্নেসার প্রতি সিরাজের প্রেম মেনে নেবেন না তিনি ? হোক না সে এক দাসীকন্যা ! যদিও ইতিহাস বলে দাসীকন্যা হলেও মেহের ছিল রূপ ও গুণে অনন্যা। ব্যক্তিত্বশালিনীও বটে। আর প্রেম ? সিরাজ তাঁকে যত না, তার বহুগুণ মেহের ভালোবেসেছিল তাঁর সিরাজকে।
সিরাজের মৃত্যুর পরও বছর সাতেক বেঁচেছিলেন মেহের। ঢাকা থেকে ব্রিটিশ সরকার যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসে, তখন তাঁর একটাই প্রার্থনা, তাঁকে যেন খোশবাগে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ইংরেজ সরকার সদয় হয়েছিল তাঁর প্রতি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রোজ মৃত স্বামী ও কন্যার সমাধির উপর ধূপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের স্মরণ করেছেন এই অসাধারণ নারী। এ ছাড়া সম্পূর্ণ সমাধিক্ষেত্রই পরিষ্কার রাখা, দেখভাল করার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। এ বাবদ মাসোহারাও পেতেন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে। মৃত্যুর পর সিরাজের সমাধির নিচেই রচিত হয় মেহেরের সমাধি, তাঁরই একান্ত ইচ্ছায়।
ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম খোশবাগ। গেটের মুখে গাড়ি থামিয়ে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। গাইডও এখানেই থাকেন। ইটের বাঁধানো পথ সোজা চলে গেছে। দুপাশে সবুজ গালিচার মতো নরম ঘাস। প্রাচীন গাছেরা দাঁড়িয়ে। বড় শান্ত ও নির্জন খোশবাগ। চারপাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একদিকের পাঁচিলের গায়ে ছোট্ট একটি ইটের ঘর। শুনলাম, ওই ঘরেই থাকতেন একাকিনী মেহেরুন্নেসা। খোশবাগে সিরাজ, মেহের, তাদের কন্যা ছাড়াও আছে সিরাজের এক প্রেমিকার সমাধি। কথিত আছে, এই হিন্দুকন্যা যুদ্ধের সময় সিরাজের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করতেন। ভিতরে একটি মসজিদও আছে। দিনের শেষে আলীবর্দী তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে এখানেই বসে নামাজ পড়তেন।
খোশবাগে এছাড়াও সমাধিস্থ আছেন নবাব আলীবর্দী, তাঁর বেগম, সিরাজের ছোট ভাই ও দুই মাসি, যার একজন ঘসেটি বেগম। ইনি ইতিহাসে কুখ্যাত সিরাজের বিরুদ্ধে অন্যতম ষড়যন্ত্রী হিসেবে। ইতিহাস অবশ্য তাঁকেও ক্ষমা করেনি। এছাড়াও এখানে সমাধিস্থ নবাব পরিবারের আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠ সহচর, পারিষদ, খাস পরিচারক এক-দুজন। তাদেরই কেউ কেউ আবার ছিলেন সিরাজ হত্যার মূলে। খোশবাগের প্রায় ৩০/৩১টি সমাধির ক্ষেত্রে মাত্র দুজনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল–আলীবর্দী ও মেহেরুন্নেসা। বাকি সব অপঘাত। হত্যা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, লোভ ও লালসার ফসল। কালের নিয়মে ভাগীরথী সরে গেছে অনেক দূরে। পারাপার আজও চলছে। শত ইতিহাসের সাক্ষী ভাগীরথী বহতা আপন ছন্দে। কান পাতলে আজও শোনা যায় কান্না আর হাহাকার।
ইতিহাস বড় জীবন্ত এখানে। প্রেম ও অপ্রেমের সেই ইতিহাসে সময় যেন থমকে আছে। সিরাজ ও মেহের। সিরাজ ও ঘসেটি। রাজত্বের লোভ শুধু নয়, সিরাজের প্রতি ঘসেটির বিরাগের ভিন্ন কারণও ছিল। কিছু কিছু ঐতিহাসিকের মতে, দীর্ঘদেহী, রূপবান ও বীর্যবান এবং চূড়ান্ত বেপরোয়া স্বভাবের বোনপোটির প্রতি ঘসেটির তীব্র অনুরাগ জন্মায়, যাতে সাড়া দেননি সিরাজ। এরপর ঘসেটির অনুরাগ বিরাগে পরিণত হতে দেরি হয়নি।
রূপসী, ব্যক্তিত্বময়ী ঘসেটির জীবনেও শান্তি ছিল না। আলীবর্দী সিরাজকে মসনদে বসানোর পর থেকেই ঘসেটির ষড়যন্ত্র প্রক্রিয়া শুরু। যেখানে তাঁর সহ-কুচক্রীরা ছিল মীরজাফর ও জগৎ শেঠ। ষড়যন্ত্রের শেষ পলাশীর যুদ্ধে। তারপর একে একে পতন। শোনা যায় নদীবক্ষে নৌকা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো ঘসেটি বেগমকে। জলেই শেষ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারীর জীবন। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। স্বামী নওয়াজিশ মুহম্মদ খান যথেষ্ট ভালোবাসতেন ঘসেটিকে। তিনি ঘসেটির জন্য নির্মাণ করেন মোতিঝিল প্রাসাদ। বিখ্যাত মোতিঝিলের পিছনে প্রাসাদ, সেই নামেই নাম। এই ঝিলও দেখার মতো। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয় এই প্রাসাদ, সেই থেকে কোম্পানি বাগও বলা হয় একে।
ঘোড়ার খুরের মতো আকৃতির মোতিঝিল এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য, যা একদা বিখ্যাত ছিলো মুক্তো চাষের জন্য। নওয়াজিশ ও পরিবারের অন্যদের স্মৃতিসৌধ মোতিঝিল সংলগ্ন প্রাসাদে। আজ অবশ্য প্রাসাদ না বলে তাকে ধ্বংসস্তূপ বলাই ভালো। তবে ধ্বংসের মাঝেও উঁকি মারে নবাবী শান শহকৎ। অনেকটা ছড়ানো জায়গা জুড়ে প্রাসাদ ও ঝিল দাঁড়িয়ে অতীতের সাক্ষী হয়ে। মসনদে বসার পর থেকেই সিরাজের সঙ্গে ঘসেটির শত্রুতা। মোতিঝিল পরে সিরাজ অধিগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়াও নিজের বসবাসের জন্য তিনি তৈরি করিয়েছিলেন হিরাঝিল। জাঁকজমকের চূড়ান্ত ছিলো এই প্রাসাদ। ভাগীরথীর এক পাড়ে মোতিঝিল, অন্য পাড়ে হিরাঝিল। মোতিঝিল দাঁড়িয়ে, হিরাঝিল তলিয়ে গেছে ভাগীরথীর গর্ভে।
(পরের পর্ব আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি)