Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

প্রতিবাদের বীজমন্ত্রের বপনকারিণী

লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা

“বাঁচা মানে ছুঁতে পারা / বাঁচা মানে চোখ ভ’রে দেখা / প্রাণ ভ’রে শোনা / হৃৎপিণ্ডের শব্দটুকু শুধু / ও কি বেঁচে থাকা…?”–জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা মেয়েটি আজ না ফেরার দেশে । নাট্যসম্রাজ্ঞী শাঁওলি মিত্র। অভিনেত্রী। নাট্য নির্দেশক। গ্রুপ থিয়েটার সংগঠক। লেখিকা। সাংস্কৃতিক কর্মী৷ প্রতিবাদী। লড়াকু। সাংস্কৃতিক সিংহাসনটি আয়ত্তে রেখেছিলেন শেষবেলা পর্যন্ত। জীবনের অন্তিম দিনেও খানিক আড়ালেই সেই মেজাজ যেন অক্ষত রাখলেন শাঁওলি। শেষ ইচ্ছাপত্রে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর খবর যেন দাহকার্যের পর জানানো হয় সবাইকে। বাবা শম্ভু মিত্রের মতোই মৃত্যু পরবর্তী নিয়মবিধি প্রকাশ করে গেলেন। ফুলের ভারে তাঁর দেহ তাই সেজে উঠলো না। আর এক অভিনেত্রী এবং শাঁওলির ‘মানসকন্যা’ অর্পিতা ঘোষকে তাঁর শেষকৃত্যের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন ২০২০ সালে।

সময়টা ১৯৮৩। শাঁওলি মিত্র’র লেখনীতে নবরূপে পাঞ্চালকন্যা যাজ্ঞসেনী। সৃষ্টি হল ‘নাথবতী অনাথবৎ’। যে পুরুষের ওপর নারীর সুরক্ষার ভার অর্পিত বলে সমাজ মনে করে, সেই পুরুষের কারণেই নারী কখনও কখনও হারায় তার লজ্জা, আত্মসম্মান। পথের ধারের বুনোফুল বা পৌরবসরসে নলিনী, নারীর সম্ভ্রমে বিষাক্ত কামড় বসায় একদল লোলুপ ভ্রমর। পৌরাণিক আলিঙ্গনের চাদর সরিয়ে মুক্তমনা ‘বঙ্গবালা’ নবরূপে উন্মোচন করলেন দ্রৌপদীর সেই লজ্জা। সম্রাজ্ঞী যেন অতি সাধারণ কন্যা, যিনি অসহায় ক্ষমতা ও চক্রান্তের আস্ফালনে। যেখানে পঞ্চপাণ্ডবের পৌরুষ নয়, নির্যাতিতা নারীর আর্তনাদ মূল উপজীব্য।

Shaonli3

 “যিনি কৃশা নন, যিনি খত্বা নন, সেই অতীব সুন্দরী প্রিয়ম্বদা দ্রৌপদীকে তিনি পণ রাখলেন”–শাঁওলি মিত্র’র কন্ঠে একপ্রস্থ প্রতিবাদ, একরাশ বিস্ময়। পঞ্চম বৈদিক-এর প্রথম নিবেদন কেবল এক বঙ্গনারীর প্রতিভার প্রকাশ নয়, বরং সমগ্র নারীজাতির লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার আহ্বান। আন্তর্জাতিক স্তরে নাট্যজগতে আলোড়ন তুলেছিল ‘নাথবতী অনাথবৎ’। এই নাটক প্রসঙ্গে শাঁওলি মিত্র নিজেই বলেছেন, “সময়টা আশি থেকে তিরাশি সাল। তখন মহিলাদের অবমাননাকর বেশ কিছু ঘটনা ঘটছিল। যেটা হয়তো দ্রৌপদীর অপমানের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। সেই জন্যই আমার মনে হয়েছিল দ্রৌপদীর চরিত্রটা নিয়েই আমি কাজ করব।”

Shaonli Mitra1

কেবল নাট্যজগতের অমূল্য প্রতিভা হিসেবে নয়, সমস্ত নারীর হৃদয়ে প্রতিবাদের বীজমন্ত্রের বপনকারিণী হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয়া। আটের দশকে শম্ভু-কন্যার প্রতিবাদের ভাষায়, সর্বস্তরের নারীর জীবনে কুহেলিকার উদঘাটনে প্রকাশ পাক স্বাধীনতার নবীন সূর্য। বঙ্গীয় নাট্যইতিহাস তথা নারী ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা থাক শাঁওলী মিত্র’র নাম। স্রষ্টা চিরস্মরণীয়া থাকুন তাঁর অমর সৃষ্টির সঞ্জীবনী মন্ত্রে।