হাসির কুঠার হাতে পরশুরাম
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেনও চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। আগামী ১৬ মার্চ রসসাহিত্যিক রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রতিবেদন লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা।
ছেলেবেলাটা আর পাঁচজনের মতো ছিল না। তবে, কর্মকান্ডে সুকুমার রায়ের সঙ্গে খানিক মিল পাওয়া যায়। যে কোনও খেলনা–টিনের ইঞ্জিন, রবারের বাঁশি, স্প্রিংয়ের লাট্টু–হাতে পাওয়া মাত্রই দেরি না করে এক ঘণ্টার মধ্যেই ইনিও লোহা-পাথর-হাতুড়ি দিয়ে তা ভেঙে ফেলতেন শৈশবে। কেন না, শিশুর মনে তখন নানান প্রশ্ন— কেন বাজে ? কেন ঘোরে? এক বার কলকাতা থেকে স্প্রিংয়ের নতুন ইঞ্জিন আসার পরে মা লক্ষ্মীমণি বললেন, “দেখিস যেন ভাঙ্গিস না।” চার বছরের খোকার অমনি মুখ গম্ভীর। পরে যা খুশি করার অনুমতি পেতেই ইঞ্জিন শতটুকরো।
আর একটু বড় হতে হাতে এলো আড়াই টাকার ইঞ্জিন, স্পিরিট দিয়ে তাকে চালানোর চেষ্টা চললো। শোঁ শোঁ হিস হিস আওয়াজ হল, কিন্তু চলল না। একটু পরে দড়াম করে বিকট আওয়াজ এবং আড়াই টাকার অকালমৃত্যু। তিনি অবশ্য আগে থেকেই বিপদ বুঝে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “দাদা পালাও। পালাও!” আর ছোটবেলা থেকে এই সব দেখে ভাইয়ের প্রতিভায় মুগ্ধ বড়দাদা শশিশেখর লিখছেন, ‘সায়েনটিফিক মেকানিক্যাল ব্রেন’। ১৮৮০-র ১৬ মার্চ। বর্ধমানের বামুনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট রাসায়নিক ও রসসাহিত্যিক রাজশেখর বসু। শৈশবেই তাঁর বিজ্ঞানচেতনা প্রতিভাত, যার কিছুটা ঝলক আমরা পেলাম আগের তথ্যে।
তবে, আমাদের এই প্রতিবেদন মূলত সাহিত্যিক রাজশেখরের পরশুরাম হয়ে ওঠার বৃত্তান্তে বিচরণ।
১৮৯৫ সালে পাটনা কলেজে এফ এ পড়তে গিয়ে প্রথম বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হলো রাজশেখরের। সঙ্গে কিছু সাহিত্য-নির্ভর আলোচনায় অংশ নেবারও সুযোগ পেলেন। পরে কলকাতায় আসার পর তাঁর বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক আর একটু নিবিড় হলো। ১৮৯৭-এ কলকাতা এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলেন তিনি। দু’বছর পরে কেমিস্ট্রি এবং ফিজিক্সে সেকেন্ড ক্লাস অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করলেন। পরের বছর কেমিস্ট্রিতে এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেন। এর পরে আবার বি এল পড়া। কিন্তু মাত্র তিন দিন আদালতে গিয়েই মোহভঙ্গ।
জীবনের মোড় বদলাল ১৯০৩ সালে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে আলাপের সূত্রে। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের রসায়নবিদ বা কেমিস্টের পদে যোগ দিলেন রাজশেখর। তিন বছরের মধ্যে সংস্থার সর্বময় কর্তা হয়ে বসলেন। ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত সংস্থার জন্য প্রাণপাত করে কাজ করলেন। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সংস্থার জন্য কাজ করে গিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যে রাজশেখর বসুর খ্যাতি তাঁর অতুলনীয় রস-সাহিত্যের জন্য। যদিও তাঁকে পরশুরাম বলেই চেনেন অধিকাংশ মানুষ। তাঁর সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ সালে। পরশুরাম ছদ্মনামে ১৯২২ সালে একটি মাসিক পত্রিকায় ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ নামে ব্যঙ্গ রচনাটি প্রকাশিত হয়। এই গল্পে, আমরা ব্যঙ্গের প্রাথমিক চকিত স্পর্শ পেয়েছিলাম। ভণ্ডামি আর মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে, বক্তব্য সেখানে তির্যক রেখায় অঙ্কিত হয়েছিলো। স্বদেশী কোম্পানী বা বাংলার যৌথ ব্যবসাগুলো মোটামুটিভাবে চিরকালই জাল-জুয়াচুরির আখড়া। বাঙালির এই জাতীয় চরিত্রের মজ্জাগত প্রবৃত্তির বিরুদ্ধেই হাস্য- রসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে আক্রমণ করেছিলেন রাজশেখর বসু।
বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, শ্লেষ বা ব্যঙ্গের লক্ষ্য-সন্ধানে দক্ষতা এবং সেই সঙ্গে অনায়াস ভঙ্গিতে কৌতুককর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অতুলনীয় ক্ষমতা রাজশেখর ওরফে পরশুরামের ভালো রকমই ছিল। এই সব দুর্লভ গুণের অধিকারী হয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রশস্ত অঙ্গনে রসের ঝরণা ছুটিয়ে প্রায়শই পাঠকদের ‘হাড্ডি পিলপিলিয়ে’ দিচ্ছিলেন। তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে কটাক্ষ করেছেন, আঘাত হেনেছেন। কিন্তু, এই রসিকতা শুধু বিষের দহন আনেনি। এনেছে বিশুদ্ধ কৌতুকরসও।
একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিজের লেখা প্রসঙ্গে বলেন যে তিনি রাসায়নিক বলেই হয়তো কাব্যে কৌতুক রসের অভাব পড়েনি। তবে, হাসির গল্প লেখার বিপদ আছে। পাঠক ভাবেন, হেসেই কাজ শেষ। অনেক সময়ই তলিয়ে দেখেন না। কিন্তু রাজশেখরের হাসির গল্পে সামাজিক মন থেকে ব্যক্তিমন সবই ধরা পড়ত ভাষার জাদুতে। ‘কজ্জলী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘গামানুষ জাতির কথা’, ‘ধুস্তরী মায়া’, ‘কৃষ্ণকলি’, ‘নীল তারা’, ‘আনন্দীবাঈ’, ‘চমৎকুমারী’ ইত্যাদি গল্পের ভিতরে ছড়িয়ে আছে এমন হাজার ঐশ্বর্য।
প্রমথনাথ বিশী লিখছেন— ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়া মাত্র (১৯২২) বাঙালি পাঠকের কান ও চোখ সজাগ হয়ে উঠল, এ আবার কে এলো ? Curtain Raiser হিসাবে গল্পটি অতুলনীয়। এক গল্পেই আসর মাত। উদ্বোধনী লেখার ধারাবাহিকতা রেখেছিলেন রাজশেখর। পাঠকের উৎসাহে ভাটা পড়ার কোনও অবকাশই দেননি তিনি। পরশুরাম নামেই অবশ্য জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তখন তাঁর। ৪২ বছর বয়সে প্রথম লেখা ছাপা হলো। আর তাতেই হইচই পড়ে গেল বাঙালি পাঠকসমাজে। প্রথম গল্প সম্পর্কে বলছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক কোম্পানি রাতারাতি গড়ে ওঠে, আবার ডুবেও যায়। অসাধু ব্যবসায়ীদের সেই ব্যঙ্গচিত্র আঁকাই তাঁর উদ্দেশ্য।
‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্য সম্পাদক জলধর সেন গল্প দিতে বলেছিলেন। স্বনাম ব্যবহারে আপত্তি থাকায় ছদ্মনামের ব্যবস্থা। ছদ্মনাম পরশুরাম রাখার কারণটিও বেশ মজার। সে দিন কোনও কারণে বাড়িতে তারাচাঁদ পরশুরাম স্যাঁকরা এসেছিল। সেই নামটাই লেখায় বসিয়ে দেন। এর মধ্যে কোনও পৌরাণিক কটাক্ষ বা শ্লেষ নেই। এমনকী এটা যে পরে স্থায়ী হতে পারে, তা-ও তিনি ভাবেননি। আসলে, সাহিত্যজগতে রাজশেখরের প্রবেশটাই খানিক আকস্মিক। তবে, ‘রসসাহিত্যিক’ সম্বোধনে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁর। তিনি বলতেন, “রসসাহিত্যিক আবার কি ? আমি কি হাঁড়িতে রস ফুটিয়ে তৈরী করি ?”
প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতেই হয়, রান্নায় দারুণ আগ্রহ ছিল রাজশেখরের। চমৎকার আচার বানিয়ে বয়ামে বয়ামে সাজিয়ে রাখতেন। তবে চেনা রান্নায় রাজশেখরকে চেনা মুশকিল। তাঁর ‘সিগনেচার’ আবিষ্কারে। হেঁশেলের সুবিধের জন্য বানিয়েছিলেন তরল মশলা। শিশিতে ভরে রেখে দিতেন, প্রয়োজনমতো কাজে লাগাতেন। এক্সপেরিমেন্ট করে বানিয়েছিলেন জিলিপির পুডিং আর কুমড়োর স্যান্ডউইচ।
বাংলা বানানের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে একটি অভিধান তৈরি করার জন্য ভাষা-উৎসাহী ও ভাষা-প্রাজ্ঞ রাজশেখরকে অনুরোধ করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। একা এ কাজ সম্ভব নয়। তাই সহযোগী হন সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা। যে সমস্ত শব্দের একাধিক বানান আছে, তার তালিকা তৈরি করেন। বানান নির্বাচনের মতামত চেয়ে তালিকা পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, যোগেশ বিদ্যানিধি, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘চলন্তিকা’, প্রথম মুদ্রণে শব্দের তালিকা ২৬০০০, পরে ৩০০০০। সব সময়ে ব্যবহারের উপযোগী এই অভিধান বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পেতে লাগল।
বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দেওয়ার পরে নিজের এই আগ্রহকে খুব কার্যকরী ভাবে ব্যবহার করেছিলেন রসায়নবিদ রাজশেখর। তাতে রসায়নের কী উপকার হয়েছিল, সে হিসেব বিজ্ঞানীরা করবেন। কিন্তু বাংলা ভাষার যে দুর্দান্ত একটা লাভ হয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তৎসম, তদ্ভব, ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে জিনিসের নিত্যনতুন নামকরণ করতেন তিনি। ‘কীটনাশক পদার্থ’ হল ‘মারকীট’, ‘সুগন্ধ-সার’ বা ‘এসেন্স’ হল ‘কনসেন্ট’, ‘ডায়াবেটিসের ওষুধ’ হল ‘ডায়াবিনল’, ‘কাশির ওষুধ’ হল ‘কাসাবিন’, ‘স্নায়ুস্নিগ্ধকারী ওষুধ’ হল ‘কোয়াটিন’, ‘আইওডিন প্রলেপ বা মলম’ হল ‘আইডোলেপ’, ‘বোরিক মলম’ হল ‘বোরোলেপ’। এ রকম অসংখ্য ওষুধ, রাসায়নিক ও প্রসাধনী শুধু কাজের গুণে নয়, নামের গুণেও জনপ্রিয় ছিল। এগুলি যখন বিজ্ঞাপন হিসেবে পত্রিকার পাতায় বের হতো, তখন সেই বয়ানও নিজে হাতে লিখতেন রাজশেখর। অফিসের খাতায় সইও করতেন বাংলায়। ‘ডেসপ্যাচ স্লিপ’কে লিখতেন ‘যা-পত্র’, ‘ভিজিটিং অর্ডার স্লিপ’কে ‘দ্র. পত্র’।
রাজশেখর বসুর হাস্যরসিক শিল্পীসত্তাকে আরও বেশী ক্ষুরধার করেছিল তাঁর অদ্ভুৎ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী শক্তি। জগৎ ও জীবনকে বৈজ্ঞানিকের নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তিনি। হয়তো এ কারণেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রাজশেখরকে ‘সুবুদ্ধি বিলাস’ অভিধায় অভিহিত করে বলেছেন, “রসবস্তু যা তাঁর লেখায় আমরা পাই, আর পাই বলেই তাঁকে আমরা ছাড়তে পারি না, তাঁকে উদ্ভাসিত করে রেখেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানপ্রসূত এক অতি অসাধারণ সাধারণ-বুদ্ধি, ইংরাজিতে যাকে বলব ‘most uncommon common sense বা সুবুদ্ধির জ্যোতি।”