স্নেহময়ী দিদি
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই বিভাগ। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে। আজ বনশ্রী সেনগুপ্ত।
যখন থেকে বাংলাগান শুনি এবং শিল্পীদের নাম জানার সুযোগ ঘটে, তখন থেকেই আরও অনেক গুণী শিল্পীর মতো ওঁর সঙ্গেও একটা হৃদয়ের বন্ধন সৃষ্টি হয়ে যায়। স্বর্ণযুগ বলতে যে সময়টাকে চিহ্নিত করি আমরা, ইনি সে যুগেরই একজন উজ্জ্বল তারা। উজ্জ্বল এবং স্নিগ্ধ। বস্তুত, বনশ্রী সেনগুপ্তের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই একথা স্বীকার করবেন। অমন নিরহংকারী, সুন্দর মনের শিল্পী সর্বকালেই বিরল।
বনশ্রীদির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ সিটিভিএন চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানের সূত্রে। তখন সবে চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়েছে। আমি একটা গানভিত্তিক অনুষ্ঠান করছি নিজের ভাবনা ও পরিচালনায়। সঞ্চালনার কাজটাও করছি। এটা ছিল আমার নিজের টিভি অনুষ্ঠানের শুরুয়াত। বিষয়টা এমন, আমরা ক্যামেরা, লাইট ইত্যাদি সেট নিয়ে পুরো টিম চলে যেতাম শিল্পীর বাড়িতে। সেখানে ঘরোয়া মেজাজে তাঁর সঙ্গে গান ও কথোপকথন চলতো। গানবাজনা সংক্রান্ত বহু অজানা তথ্য জানা হয়ে যেত দর্শকেরও এভাবেই। নির্বাচনে থাকতো, বাংলাগানের সমস্ত বিভাগের কিংবদন্তি শিল্পী থেকে নতুন প্রজন্মের তারকারা।
পরিকল্পনা মাফিক যোগাযোগ ও সেই অনুসারেই একদিন বনশ্রীদির বাড়িতেও গেলাম। টালিগঞ্জ এলাকার একটি ছিমছাম ফ্ল্যাট। সেখানেই আমরা আনুষঙ্গিক আয়োজন নিয়ে গুছিয়ে বসলাম। শুটিং চলেছিল প্রায় আড়াই/তিন ঘন্টা। বিস্তারে না গিয়ে কয়েকটা কথা শুধু বলবো। বনশ্রীদি নিতান্তই মগ্ন একজন শিল্পী ছিলেন। ভীষণ আন্তরিক ও প্রাণবন্ত। আমার আজও মনে আছে, সাজগোজ অত বুঝতেন না। বোঝার দরকারও পড়েনি কখনও। মঞ্চে, জলসায়, রেকর্ডিং-এ সাদামাটা সেজে, গানেই মাতিয়ে দিয়েছেন আসর। কিন্তু টিভির অনুষ্ঠানে একটু তো বাড়তি পরিপাটি হতেই হবে। সেদিনের শুটিংয়ে সেই পরিপাট্যের অনুষঙ্গে আমিই ছিলাম বনশ্রীদির পরামর্শদাতা। কোনও ইগো ছাড়াই আমাকে নিজের বোনের আসনে বসিয়ে, নিজেকে সমর্পণ করেন সেদিন তাঁর মতো এক খ্যাতনামা শিল্পী।
এই দিন বনশ্রীদির বাড়িতে আর একজনের সঙ্গেও পরিচিত হই–ওঁর স্বামী শান্তিদা। শান্তিদা ছিলেন বনশ্রীদির ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড। প্রয়াত নিঃসন্তান এই দম্পতির কাছে সন্তানবৎ ছিল বনশ্রীদির গান। একেবারে ছাতার মতো বনশ্রীদির মাথার ওপরে আশ্রয় হয়ে থাকতেন শান্তিদা। দুজনেরই অন্তহীন স্নেহ আমি পেয়েছি। আমি একা নই, পরিচিতজনের অনেকেই পেয়েছেন। সেদিনের পর সিটিভিএন চ্যানেলেরই আরও নানা অনুষ্ঠান, টক শো, আমার নিজের কোনও অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাওয়া–বহুবার বনশ্রীদির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়েছে। এমনি ফোন করেও খবর নিতেন। ওঁরা দুজনেই আজ নেই। শান্তিদা চলে যাওয়ার পর খুব একা হয়ে যান বনশ্রীদি। তারপর তো নিজেও চলে গেলেন।
নানা সূত্রে নানা কথায় অতীত গৌরবের দিনগুলিতে যে প্রবাদপ্রতিম গীতিকার-সুরকারদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁদের গল্প শোনাতেন। খুব বেশি করে বলতেন সুধীন দাশগুপ্তের কথা। বলতেন,”আমি যখন মফঃস্বল থেকে বিয়ের সূত্রে কলকাতায় এলাম, তখন কমার্শিয়াল গানবাজনার কিছুই জানতাম না। আমার বাপের বাড়ির সকলেই গান গায়। বাড়িতে ছোট থেকে সংগীতচর্চার পরিবেশ পেয়েছি, ওস্তাদ ও গুরুদের কাছে শিখেছি–ওই পর্যন্ত। অনুষ্ঠানে গেয়েছিও হয়তো। কিন্তু, প্লেব্যাক কী করে করতে হয়, রেকর্ডিংয়ের সময় আর মঞ্চে গাওয়া–মাইক্রোফোন ব্যবহারের পৃথক পৃথক পদ্ধতি, এসব তত ভালো জানতাম না। সব শিখেছি এই সুরকারদের হাত ধরে। বিশেষত সুধীনদা। কত রকম এক্সপেরিমেন্ট যে করেছেন আমায় নিয়ে! সেভাবেই অনেক শেখা ও অভিজ্ঞতা। গানের ভাবার্থ বুঝেছি গীতিকারদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে।”
শেষ করবো একটি ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল স্মৃতির কথায়। সাংবাদিকতা ও টিভি অ্যাঙ্কারিংয়ের সূত্রে কিছুটা পরিচিতি বেড়েছে তখন। মঞ্চ অনুষ্ঠানে গান গাওয়াটাই আমার নিজের বেশি পছন্দের ছিল। তবে, কালেভদ্রে অ্যাঙ্কারিংও করতাম, মূলত অনুরোধের ঢেঁকি গিলে। এমনই এক পুজো উদ্বোধন অনুষ্ঠান। সেখানে বনশ্রীদি ছাড়াও আসবেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর কোনও এক সিরিয়ালের তারকা। এখন নাম ভুলে গেছি কিন্তু, এটা মনে আছে, সেসময় তার ক্রেজ একেবারে তুঙ্গে। সে যাই হোক, আমি আর বনশ্রীদি নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেছি। চা-বিস্কুট আর মিনি আড্ডা চলছে। একটু পর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এলেন। বনশ্রীদি ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চে যাওয়া, জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য ইত্যাদির পর্ব শেষ। টিভি তারকা আর আসে না।
শেষে অনেকটা দেরি করে তার আগমন এবং আমার বাড়ি ফিরতে প্রচুর দেরি। উদ্যোক্তাদের এই নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল না থাকলেও বনশ্রীদির ছিল। কিছুদিন পর আর একটি অনুষ্ঠানে দেখা। আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বললেন, সেদিন তুমি অত কষ্ট করলে। অত রাত হলো। সারাদিন অফিস করে গেছ। আমি তো তোমায় ওখানে রেখে চলে এলাম। কিন্তু আসার পরে খুব খারাপ লাগছিল। এই ছোট উপহারটা রাখো। না বলবে না। এটা তোমার দিদির আদেশ।” আদেশ মেনেছিলাম। চাদরটা আজও আছে। দেখি আর বনশ্রীদির কথা মনে পড়ে। নানা সূত্রে গুণী শিল্পীদের সাহচর্য পাওয়া আমার জীবনে ভাগ্যক্রমে বারবার ঘটেছে। কিন্তু এমন নির্মল ও অনাবিল স্নেহে কাছে টেনে রাখার মানুষ ক’জন পেয়েছি, হাতে গুনে বলতে পারবো।