Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

কণ্ঠে সামান্য সুর থাকলেই শিল্পী হওয়া যায় না

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়

নিজের গান গাওয়া এবং সাংবাদিকতার সূত্রে বহু সঙ্গীতশিল্পীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছে। শ্রীনন্দার সঙ্গেও পরিচয় সেই সূত্রেই। আগে নাম, পরে পরিচয়। ব্যাপারটা এইরকম–শ্রীনন্দা প্রায় শুরু থেকেই আমার জানা নামী শিল্পীদের একজন। দূর থেকে সম্ভ্রম ভরে দেখতাম তাঁকে। রবীন্দ্রসদন ও অন্যান্য মঞ্চে গাইছেন বা গ্রীনরুমে অপেক্ষায় বসে। পারিবারিক সূত্রেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে বেড়ে উঠেছেন। সেই বাবদ একটা পৃথক আড়ষ্টতাও ছিল। আমি শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে কণ্ঠটুকুই পেয়েছি। প্রশিক্ষণও নিয়েছি। কিন্তু একনিষ্ঠ চর্চা কোথায় ?

সেইসময় প্রবল ব্যস্ত পেশার কারণে। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা করি। প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হয় না, ওঁদের মতো নিখুঁত গাইতে পারি না–এসব মনের মধ্যে আন্দোলিত হতো। খুব সুন্দর লাগতো শ্রীনন্দার গাইবার ভঙ্গিটি। নম্র, নিবেদিত এবং স্বতন্ত্র। আলাপ হওয়ার আগে পর্যন্ত সেই আড়ষ্টতা, দূরত্ব ও মুগ্ধতা বজায় ছিল। আলাপ হওয়ার পর সব দ্বিধা ও দূরত্ব কেটে গেল। মুগ্ধতা বাড়লো–শুধু গানে নয়, ব্যবহারেও। তারপর কবে যে আমাদের আলাপ-পরিচয় আন্তরিক বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে, আজ আর মনে করতে পারি না। আমার চাহিদা, আবদার মেনে নিয়ে এই বিভাগে নিজের মূল্যবান মতামত জানিয়ে আমায় কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন শ্রীনন্দা। এবার বাকিটা তাঁর নিজের কথাতেই জেনে নিন–

ছোটবেলা থেকেই গানের পরিবেশে বড় হওয়ায় অনেকগুলো জিনিস নজরে এসেছে। গান শিখতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন সুর ও তালজ্ঞান থাকা, যেটা জন্মগত। এই সুর-তাল চর্চায় বাড়ে। কিন্তু নতুন করে তৈরি হয় না। আজকাল নজরে পড়ে, অনেকেই ভেবে নেন, গলায় সামান্য সুর থাকলেই রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যায় বা শিল্পী হওয়া যায়। ধরেই নেওয়া হয়, এই ধারার গান খুব সহজ। এই ধারণা কতটা ভুল, সেটা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, সামগ্রিকভাবে গানবাজনার অধোগতি বলে দেয়।

রবীন্দ্রনাথের গান করতে গেলে সুর-তাল ছাড়াও বোধের প্রয়োজন, যা পরিবার বা শিক্ষা থেকে আসে। ছাত্রীদের কাছে শুনি, কারওর ছোট বয়স থেকেই বাবা-মা গান শুনিয়েছেন, যাতে কান তৈরি হয়। আবার কিছুজনের দেখি, বড় হয়ে নিজের চেষ্টায় গান শিখছে। কি অসম্ভব ও কঠিনলব্ধ সেই চেষ্টা ! শিল্পী হতে গেলে রেওয়াজ অত্যন্ত জরুরি। রাগসঙ্গীতের চর্চা থাকা দরকার। এতে স্বরস্থান নিখুঁত হয়, তালজ্ঞান বাড়ে। এটা যারা শৈশব থেকে করে আসে, তাদের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দেয়। যারা বড় হয়ে সঙ্গীতচর্চা করছে, তাদের ক্ষেত্রে তাই সময়টা বেশি দেওয়া ও যথাযথ প্রশিক্ষণ একান্ত জরুরি।

নানা জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের দেখি, গান শেখাটা খুব হালকাভাবে নেয়। এই ক্ষেত্রে আমি বলবো,  শিক্ষকদের দায়িত্ব বেশি। ‘শ্যামা’র প্রথম পরিচ্ছদ সিলেবাসে আছে বলে, পুরোটা আর পড়ে দেখার প্রয়োজন নেই। গোটা নাটকের বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই। এ শিক্ষা তো অসম্পূর্ণ। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের কাজ হলো, বিষয়টাকে একটা সম্পূর্ণ রূপ দেওয়া।

কন্ঠ প্রক্ষেপণ সম্পর্কে ধারণা সাধারণত পাওয়া যায় শিক্ষকদের কাছ থেকে। আমার ক্ষেত্রে বাবা-মা বা শিক্ষকগণ ( বিশেষ করে সুচিত্রাদি) গানের মানে বুঝিয়ে, সেই অনুসারে গলার আওয়াজ জোরে বা আস্তে করতে বলতেন। তারপর বহু বছর সেগুলো অভ্যাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে শুরু করেছিলাম। অর্থাৎ সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়া, ক্যাসেট বা ইউটিউব ইত্যাদি থেকে শুনে গান তুললে, এই ধারণাটা তৈরি হওয়া অসম্ভব।

রবীন্দ্রসংগীতের সম্যক ধারণা থাকতে হলে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা পড়া দরকার। তাতেও রবীন্দ্রনাথের মত মহীরুহের কতটা নাগাল পাওয়া যায় জানি না। সেই কারণেই বহু দিন ভালো গুরুর কাছে শেখার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁরাই সঠিক পথনির্দেশ করতে পারেন।

যন্ত্র এমন ব্যবহার করা প্রয়োজন, যাতে গানের কথা, ভাব কোনও কিছু ঢেকে না যায়। গানের সুর ও কথা সম্পূর্ণ বুঝে, তবেই যন্ত্র ব্যবহার করা দরকার। আজকাল অনেকের গানে যন্ত্র ব্যবহার শুনে বোঝাই যায় না সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত না অন্য কিছু ! কী ভেবে এই যন্ত্রের ব্যবহার জানতে ইচ্ছা করে। তবে এমন নয় যে, আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলেই গান খারাপ হবে। ব্যবহার যথাযথ হওয়াটা প্রয়োজন।

স্বরলিপি খুব ভালো করে পড়তে শিখতে হয়। যদিও স্বরলিপি গানের কাঠামো দেয়। তাতে লয় বলা থাকে না। সেখানেই সঠিক গুরুর প্রয়োজন–যিনি স্বরলিপির read between the linesটা শেখাবেন। মীড় বা স্পর্শস্বর গলায় তোলা যায়, কিন্ত, সঠিক প্রয়োগ বুঝতে গেলে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি। একই স্বরলিপি দেখে পাঁচজন গান শিখলেও সেই গান প্রত্যেকের গলায় আলাদা মাত্রা পায়। সেখানেই সেই শিল্পীদের মধ্যে বোধ ও শিক্ষার তফাতটা ধরা পড়ে। ভালো স্বরস্থান, গুরুর কাছে প্রশিক্ষণ, বোধ ও শিক্ষাই একজন প্রকৃত শিল্পী তৈরি করে। এর সঙ্গে কঠোর রেওয়াজ তো আছেই।

রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের জন্য অনুধাবনের এই স্তরগুলি পার হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা শ্রীনন্দার এই প্রতিবেদনে যথার্থ বিশ্লেষিত। অনুধাবন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেটা রাতারাতি সম্ভব নয়। সোস্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে যে কেউ যা খুশি কান্ড করে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে সহজেই। তাদের মধ্যে কেউ রানুর মতো হঠাৎ তারকা হয়ে অচিরেই হারিয়ে যেতে পারেন। কেউ বাদামকাকুর মতো গাড়িবাড়ির মালিক হতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত শিল্পী হওয়ার সমীকরণটা অনুধাবন ছাড়া অসম্ভব। সেটা সময়সাপেক্ষ। আজ তাই লক্ষ লক্ষ রানু ও ভুবন। শিল্পী হাতে গোনা।

** আলোচনায় অজন্তা সিনহা।