কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।
নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার পঞ্চম পর্ব আজ।
আগেই বলেছি, পৃথিবীর সর্বোচ্চ গন্ডোলা রাইডগুলোর অন্যতম গুলমার্গের গন্ডোলা। কন্ডোরি থেকে দেড় ঘন্টা হেঁটে বা পনিতে চেপে খিলেনমার্গ যাওয়া যায়। রিপেয়ারের কাজ চলছে বলে সেকেন্ড ফেজের রাইড বন্ধ আছে। সেইজন্য ফার্স্ট ফেজে আমরা কন্ডোরি পর্যন্ত গিয়ে, ওখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম। তারপর মনোমত একটি জায়গা দেখে বসলাম। ঠিক তখনই নজরে এলো, তিনজন স্লেজগাড়ি নিয়ে আমাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনজনের মধ্যে দুজন ১৪-১৫ বয়সের ছেলে, আরেকজন বৃদ্ধ । এদের সঙ্গে কেউ ভরসা করে স্লেজ গাড়িতে চাপতে চায়নি বলে এরাই বাকি রয়ে গেছে। আমাদের কাছে এসে খুব অনুনয়-বিনয় করলো। আমরা যাব না শুনে স্বভাবতই দুঃখিত হলো তারা।
ছেলেদুটোকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওরা দুই ভাই। বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায়, ওরা কাজে এসেছে। আগে স্কুলে যেত, এখন আর যায় না। বাড়িতে মা আর ছোটো একটা বোন আছে। বুঝলাম কি কঠিন পরিস্থিতিতে এরা লেখাপড়া ছেড়ে কাজে এসেছে। বৃদ্ধর কাছে জানা গেল, তাঁর ছেলেরা শহরে কাজে গেছে, আর গ্রামে ফেরেনি। বৃদ্ধ একাই থাকেন বাড়িতে। মন খারাপ হয়ে গেল ওদের কথা শুনে। এরাই আমার দেশের আসল প্রতিনিধি! কি চরম দারিদ্র্য! ওদের হাতে টাকা দিতে গেলাম। তিনজনেই বলল, ওদের গাড়িতে না চাপলে, ওরা টাকা নেবে না। এত সমস্যাতেও মূল্যবোধ টিকে আছে দেখে ভালো লাগলো।
আমাদের বেশ খিদে পেয়ে গেছিল বলে আমরা কেক, বিস্কুট আর ড্রাই ফ্রুট বের করে খাবো ভাবলাম। খাবার বের করা মাত্রই ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, হয়তো সকালে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে বললাম, আমাদের সঙ্গে খাবে তোমরা ? ওদের চোখেমুখে অদ্ভুত এক দীপ্তি খেলে গেল। আমাদের যার কাছে যা খাবার ছিল, বের করে সবটুকুই ভাগ করে তিনজনের হাতে দিলাম। দেখলাম, বৃদ্ধর দুচোখ জলে ভিজে গেছে। রোজ সকালে ৩-৪ কিমি দূরের গ্রাম থেকে এখানে চলে আসে এরা দু -পয়সা রোজগারের আশায়। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এরপর যতক্ষণ ওখানে ছিলাম, স্টেশনে কেবল-কার এসে দাঁড়ালেই ওরা কাস্টমারের জন্য ছুটে ছুটে যাচ্ছে আর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসছে। চলে আসার আগে বললাম, এখন তো আমরা বন্ধু হয়ে গেছি–বলে তিনজনের হাতে কিছু টাকা দিলাম। এবার আর ওরা ওরা আপত্তি করলো না।
খিলেনমার্গ যাবার ঝামেলায় না গেলেও গন্ডোলায় চেপে বরফে ঢাকা পাইন-ফlর্ন-পপলারে ছাওয়া পাহাড়, উপত্যকা দেখতে দেখতে মন ভরে গেল। শুধু বরফ আর বরফ। মাঝে মাঝে রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে একেকটা পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়গুলোর নাম জানলেও, কোনটা কোন পাহাড় চেনা সম্ভব ছিল না। পশ্চিম হিমালয়ের পীরপাঞ্জাল রেঞ্জের কোলে গুলমার্গ। দৃশ্যমান পর্বতগুলোর মধ্যে আছে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চশৃঙ্গ নাঙ্গা পর্বত, গৌরীশংঙ্কর, ত্রিশূল। শুনেছিলাম আকাশ পরিষ্কার থাকলে নাকি শ্রীনগরের শংকরাচার্য পাহাড়, ডাল লেক এগুলো দেখা যায়।
ঘন্টা চারেক পরে আমরা ফিরে এলাম। সকলেরই খুব খিদে পেয়েছে। আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল মেহরাজ। তাকে সে কথা জানতেই মেহরাজ একটা খাবারের দোকানে নিয়ে গেল। সেখানে অনেকরকম খাবার আর সবই গরম গরম বানিয়ে দিচ্ছে। আমরা রুটি সবজি আর কফি অর্ডার করলাম। মেহরাজ চা ছাড়া কিছু খেল না। আরও অবাক হবার বিষয়, আমাদের খাবারের বিলটাও মেহরাজ দিল।
বললাম, এটা কি হলো মেহরাজ ?
লাজুক হেসে মেহরাজ বলল, কাল বলেছিলাম না আপনারা আমাদের গেস্ট !
গুলমার্গের যে কোনও দিক থেকেই নজরে পড়ে পাহাড়ের ওপরে তৈরি দৃষ্টিনন্দন মহারানী টেম্পল। মহারাজ হরি সিং এই শিব-পার্বতী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। উল্লেখযোগ্য, গুলমার্গে বাসিন্দাদের মধ্যে ৮৫% হিন্দু এবং ১২% মুসলিম। বহু বছর আগে থেকেই বলিউডের অন্যতম পছন্দের শুটিং লোকেশন গুলমার্গ। বহু বিখ্যাত ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। শুধু গুলমার্গ নয়, আসলে পুরো কাশ্মীর উপত্যকাই শুটিং স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এবার ফেরার পালা। মাঝপথে কোট আর জুতো ফেরত দিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। এবার ফ্রেশ হয়ে ডিনার। তারপর বিশ্রাম। আগামিকাল যাব সোনমার্গ। (চলবে)