আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমারকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ তৃতীয় পর্ব।
তিনি ঠিক মোট কত সংখ্যক গান গেয়েছেন, কাদের কথা ও সুরে, কতগুলি ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন–তার পরিসংখ্যান দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদন নয়। গানের কথা তো আসবেই ঘুরেফিরে। তবে, সেই উল্লেখের উদ্দেশ্য থাকবে কিছুটা ভিন্নমাত্রার অবলোকন। একটু আগেই ওঁর মেধার কথা বলছিলাম। কিশোরকুমার আজকের উন্নততর প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য ছিলেন না। বিস্ময়কর বোধ হয়, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেও নিজের কন্ঠকে অনায়াসে প্রতি সপ্তকে কী করে সমান ওজন ও মাত্রায় শ্রোতার কানে পৌঁছে দিতে সক্ষম হতেন তিনি ! এটা রেকর্ডিং ও স্টেজ পারফরম্যান্স–দুই ক্ষেত্রেই। এ প্রসঙ্গে কিশোরকুমারের বড় দাদা অশোককুমার বলেছেন, মাইক্রোফোন ব্যবহারের সময় কিশোর তার কন্ঠকে একেবারে সোজাসুজি লাগাতো। সঠিক পয়েন্ট ছুঁতে পারতো বলেই কিশোরের কন্ঠ নিপুণ ব্যঞ্জনায় পৌঁছে যেত শ্রোতার দরবারে। বোঝাই যায় কিশোরের চূড়ান্ত সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল এখানেও। তিনি কণ্ঠে যেটা ধারণ করতেন, মননে গানটির যে ভাবার্থ হৃদয়ঙ্গম করতেন, ঠিক সেটাকেই পৌঁছে দিতে সক্ষম ছিলেন অগণিত শ্রোতার অনুভবের দরজায়।
কিশোরকুমারের প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছিল কী ছিল না, তাই নিয়ে কাগজের বহু পৃষ্ঠা ও কালি একদা খরচ করেছেন সমালোচকবৃন্দ। আলোচনা-বিতর্কে সময়ও নষ্ট করেছেন। তল খুঁজে পাননি। তথাকথিত প্রশিক্ষণ ছাড়া কিভাবে একটা মানুষ বছরের পর বছর আবিষ্ট করে রাখতে পারে, সেই গবেষণা করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে অবশেষে হাল ছেড়েছেন তাঁরা। ‘তথাকথিত প্রশিক্ষণ’ কথাটা এই জন্যই বললাম–প্রশিক্ষণ আর একজন কিশোরকুমার এযাবৎকালের মধ্যে দিতে পারেনি আমাদের। অতএব এই বিষয়টাকে যুক্তির খাতিরে আমরা আপেক্ষিক ধরে নিতে পারি।
এই যুক্তির খাতিরেই বলা যায়, নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলার গুরুভার তো তিনি নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নেন। আজকাল স্বশিক্ষিত কথাটা খুব ব্যবহৃত হয় যত্রতত্র ! সেটার উল্লেখ করে এই সংগীতের যুগপুরুষকে আর অসম্মান করলাম না। তাঁর প্রশিক্ষণ বা চর্চার ব্যাপারটা ছিল কিশোরকুমারের চরিত্রের মতোই স্বতন্ত্র। ঈশ্বর তাঁকে কণ্ঠের পাশাপাশি কানটাও দিয়েছিলেন একেবারে সূক্ষ সংগীতবোধসম্পন্ন। প্রায় দিবারাত্র গান শুনতেন। আর রেওয়াজ ? বড়দাদা অশোককুমার নিজে বলেছেন কিশোরের নিবিষ্ট রেওয়াজের প্রসঙ্গে। উল্লেখ করা জরুরি, অশোককুমার নিজেও তো সংগীতচর্চা করতেন আর কিশোর বরাবর বড় দাদার অনুগত ছোট ভাই। সংগীতচর্চার ক্ষেত্রেও।
এছাড়াও শুনতেন কিংবদন্তি শিল্পীদের গান। একেবারে শুরুতে কিশোরকুমার যাঁর গানে প্রায় ডুবে থাকতেন, তিনি কুন্দনলাল সায়গল। সায়গল তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে প্লেব্যাকের শুরুর দিকে একেবারে সায়গলের স্টাইল অনুসরণ করেই গাইবার চেষ্টা করতেন কিশোর। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি নিজেই বেরিয়ে এলেন সায়গলের প্রভাব থেকে। এটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। চাইলেই সবাই প্রভাবমুক্ত হতে পারেন না। কিশোর পেরেছিলেন এবং একইসঙ্গে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করলেন। এছাড়াও হলিউডের গায়ক-অভিনেতা ড্যানি কে’রও ভক্ত ছিলেন তিনি। আর প্রবল অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এ বিষয়ে পরে বিস্তারে যাব। তার আগে একটা কথা, রবীন্দ্রনাথ, সায়গল এবং ড্যানি কে’র এতটাই ভক্ত ছিলেন কিশোরকুমার যে তাঁদের বাড়ি গৌরীকুঞ্জে নিজে এঁদের ছবি টানাবার ব্যাবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে ছবির সামনে প্রণত হতেন।
পরবর্তীকালে তিনি আহমেদ রুশদির দ্বারাও প্রভাবিত হন। সেই প্রভাবও এতটাই যে পরে তিনি লন্ডনের রয়েল এলবার্ট হলে তাঁর সম্মানে অনুষ্ঠানও করেন। সেখানে পরিবেশিত গানের তালিকায় কিশোর নিজের গান ছাড়াও কয়েকটি রুশদির গানও রাখেন। এছাড়া, কিশোরকুমারের বিখ্যাত ইয়োডলিং, একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে যা একেবারে তাঁর স্বতন্ত্র ক্ষমতার অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়, সেটা তিনি পান জিমি রজার্সের কাছ থেকে। আদতে আর কোনও ভারতীয় শিল্পী এই বিষয়টিকে তাঁর মতো করে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই।
এই ইয়োডলিং প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে সেই গানটির কথা, যার কথা একেবারে শুরুতে বলেছিলাম–ইয়ে দিল না হোতা…শচীন দেববর্মণের সুরে ‘জুয়েল থিফ’ ছবির গান। এছাড়াও এর দুর্দান্ত প্রয়োগ ছিল ‘আন্দাজ’ ছবির ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা’ এবং ‘মেরে জীবন সাথী’-র ‘চলা যাতা হুঁ’ গানদুটিতে। প্রসঙ্গত, শেষের দুটিই রাজেশ খান্না অভিনীত ছবি। হিন্দি সিনেমার ক্ষেত্রে একটা লম্বা সময় রাজেশ আর কিশোরকুমার একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। এটাও আবার একটা পৃথকভাবে আলোচনার বিষয়। তাই পরে আসছি। ইয়োডলিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। এক্ষেত্রে যেটা আলাদা করে বলার, কিশোর কিন্তু রজার্সকে একেবারেই নকল করেননি। তিনি এর মধ্যেও একটা নিজস্বতা যোগ করেছেন, যা ছবির চরিত্র বা সিকোয়েন্স অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু এই তিনটি ছবির মধ্যেকার পার্থক্য বিশ্লেষণ করলেই এটা অনুভব করা যায়। (চলবে)