যাপনে উদযাপনে দুর্গাপুজো
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
গত কয়েক বছর ধরে উত্তরবঙ্গে বসবাস। পুজোটাও তাই এখানেই। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে পুজো দেখার অভিজ্ঞতা অবশ্য আরও অনেক আগে থেকেই। ছুটি পেলেই আমার একা বেরিয়ে পড়ার শুরুটা উত্তরবঙ্গ দিয়েই হয়। তারপর দীর্ঘ চাকরি জীবনে আমার বেড়াতে যাওয়াও মূলত উত্তরবঙ্গেই, কিছুটা সিকিম। বাকি অন্যত্র। আর সবটাই পুজোর ছুটিতে। এর দুটো কারণ–একটু বেশিদিনের ছুটি পেতাম পুজোতেই। আর একটা, গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার পুজোর পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠা !
মা দুর্গার মর্ত আগমনের বিষয়টি কর্পোরেট ডনদের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই বাংলার এই মহা উৎসবের পুরো চালচিত্রটাই বদলে যায়। প্রথমে কলকাতা, তারপর জেলা শহর–সর্বত্র হই হই করে থিম পুজোর বাড়বাড়ন্ত, উত্তাল প্রতিযোগিতা! পুজো এলেই কলকাতা থেকে পালানো আর পাহাড় গ্রামের ছোট ছোট আয়োজনে পুজো দেখার অভিজ্ঞতা–শুরু হলো একই সঙ্গে।
এবার সরাসরি পুজোর কথায়। উত্তরবঙ্গের ছোট্ট গ্রাম লাটপাঞ্চার। একটিই হোমস্টে। পৌঁছেছি সপ্তমীর সকালে। ফ্রেশ হয়ে, চায়ের কাপ হাতে ঘরের খোলা জানালার কাছে বসেছি। নির্জন প্রকৃতির ঢালাও রূপসুধা পান করছি দু’চোখ ভ’রে। তারই মধ্যে এসে হাজির এলাকার তিন/চারটি নেপালি ছেলেমেয়ে। আলাপ পরিচয় এগোতেই দলের কনিষ্ঠ সদস্যটি হিন্দি-নেপালি মিশিয়ে বললো, তাদের দুর্গামন্দিরে পুজো হচ্ছে। আমি যেতে চাইলে, আমাকে নিয়ে যাবে তারা। সঙ্গে সঙ্গেই এক কিশোরী প্রত্যুত্তরে যা বললো, তার অর্থ, সেই মন্দিরের অবস্থান যেখানে, সেখানে পৌঁছনো আমার কম্ম নয়। সত্যিই তাই। আমি যতই পাহাড়-পাগল হই, শারীরিকভাবে তত সক্ষম কোনওদিনই ছিলাম না। এখানে পাহাড় আর সমতলের ফারাকটা মাথায় রাখবেন, প্রিয় পাঠক !
সেই দলটি তারপর আমাকে নিয়ে গ্রাম দেখাতে বেরিয়ে পড়লো। পথে চলতে চলতেই পুজোর অনুষঙ্গগুলি পৌঁছে গেল কানে ও মনে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন, মাইকে শোনা যাচ্ছে সেই সংগীতময় ধ্বনি। আমার সঙ্গী দলটি বর্ণনা করে শোনাচ্ছে পুজোর ইতিবৃত্ত। পুজোর পর প্রসাদ এনে খাওয়াচ্ছে। উচ্চতায় না পৌঁছনোর কারণে মা দুর্গা যদি তখন আমার কাছে বিমূর্ত হন, তবে, এই বাচ্চারাই মায়ের সন্তানসন্ততি। কী নির্মল, কী পবিত্র ওদের সাহচর্য, বলে বোঝানো অসম্ভব ! এ শুধু অনুভবের। দশমীর দিন টিকা পরার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল সেবারের পুজো পরিক্রমা। বলা বাহুল্য, পুরো যাপনকালটাই আজও রয়ে গেছে স্মৃতিতে।
এরপরের পুজোর স্মৃতি যে গ্রামে, নাম তার সিলেরি গাঁও। মনে পড়ছে গ্রামের সেই ১০/১২ ফুটের ছোট্ট অথচ প্রাণময় পূজা মণ্ডপটির কথা। ভিতরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা দুর্গার মূর্তি। তার সামনে মায়ের জ্যান্ত ছেলেমেয়ের দল। সিলেরি গাঁও থেকে কাছেই রোমিতে ভিউ পয়েন্ট। ভোর ভোর বেরিয়েছি তার উদ্দেশ্যে। পূজোর উদ্যোক্তা ছোটদের দলটি যাওয়ার পথেই পাকড়াও করে আমায়। সামান্য চাঁদা পেয়ে কী খুশি তারা। কথা দিই ফেরার পথে প্রসাদ নেব।
সিলেরি গাঁও থেকে পেডং গেলাম। পেডংয়ে প্রথম সেই যাওয়া। তারপর তো কত পুজোই কাটলো সেখানে। পেডং অবশ্য প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, গঞ্জ-মতো। এখানে একাধিক পুজো হয়। আর সেই সব পুজোতেই সব মানুষের অবারিত যাতায়াত। গ্রামের বাসিন্দা থেকে আমাদের মতো ট্যুরিস্টরা। গেলেই হাসিমুখে আপ্যায়ন, প্রসাদ হাতে দেওয়া। একটি মণ্ডপে আমার অতি প্রিয় চাল-মাখা দ্বিতীয়বার চেয়ে খাওয়ায় কী খুশিই না প্রকাশ করেছিল সেখানকার ছেলেমেয়েদের দলটি।
পেডং থেকে লাভা যাওয়ার পথে একটি পুজোর কথা বলবো এবার। সেটা অন্য এক শরৎ। পেডংয়েই পুরো ছুটিটা কাটিয়েছিলাম সেবার। ঠিক হলো, একদিন সকালে বেরিয়ে লাভা ঘুরে চলে আসবো। সপ্তমীর সকাল। যেতে-আসতে পুজো দেখা হয়েই যাবে, জানা ছিল। আন্দাজমতো, যাওয়ার পথেই দেখলাম একটি মণ্ডপ। লোকজন বেজায় ব্যস্ত। সকলেই সেজেগুজে ফিটফাট। পাহাড়ের মানুষ বাহারী পোশাক পরতে পছন্দ করে। গহনা-মেকআপেও পরিপাটি তারা। ফলে, পুরো পরিবেশটাই রঙিন হয়ে উঠেছে।
মণ্ডপে মায়ের অধিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু মুখ কাগজে ঢাকা তখনও। পুরোহিত এসে মুখাবরণ খুলবেন। ভিতরে-বাইরে পাতা চেয়ারে লোকজন বসে। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। মাইকে নেপালী ভক্তিসংগীত বাজছে। একপাশে গ্যাস ওভেনে বসানো বিশাল চায়ের কেটলি। আমাকেও ওদের সঙ্গে চেয়ারে বসে চা খেতে হলো। কথা দিলাম, ফেরার পথে মায়ের মুখদর্শন আর প্রসাদ নেওয়া, দুটোই করবো। কথামতো ফেরার পথে অতীব সুস্বাদু খিচুড়ি আর পায়েস ভোগ নিয়ে ফিরি। সবটাই বড় মায়াময়, বড় মূল্যবান স্মৃতি।
পেডং থেকে আধঘন্টার পথ কাগে। আক্ষরিক অর্থেই প্রত্যন্ত ছিল সে সময়। কয়েকটি গ্রাম মিলে একটাই পুজো। হোমস্টেও একটাই। আমি আর আমার এক ভাই গেছিলাম সেবার পুজোর ছুটিতে। সেখানেও পুজো সেই পাহাড়ের টংয়ে। অর্থাৎ, আমার পৌঁছ-ক্ষমতার বাইরে। যে বাড়িটাতে আমরা ছিলাম, সে এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। সারাদিন ধরে বাড়ির বাচ্চারা মণ্ডপে যাচ্ছে আর আমায় এসে গল্প শোনাচ্ছে। সেই দলে নাম লিখিয়েছে আমার ভাইটাও।
বেলা পর্যন্ত ঘরে বসে মাইকে ভেসে আসা মন্ত্র শুনছি। তার আগে ঘুম ভাঙতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পেয়েছি। সব মিলিয়ে মুহূর্তগুলি একেবারে উৎসবে রাঙানো। সন্ধ্যায় প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রামের ছেলেমেয়েরাই শিল্পী। নাচ-গান-নাটক–সেও মাইকেই শুনি। ভাই গিয়ে ছবি তুলে আনে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়েটি শালপাতায় মোড়া প্রসাদ এনে খাওয়ায় আমায়। সার্থক হয় আমার মায়ের পুজোর উদযাপন।
সবশেষে চুইখিম। এখানে বসবাস শুরুর প্রথম শরৎ ছিল একেবারেই অন্যরকম। পাহাড়ের আন্দোলনের তিনটি কঠিন সংগ্রামী মাস সবে কাটিয়ে উঠে ছন্দে ফিরছে মানুষ। চুইখিম এমনিতেই আর্থিকভাবে অনগ্রসর এক গ্রাম। তার মধ্যে ওই আন্দোলন একেবারে কোমর ভেঙে দিয়েছে মানুষগুলোর। এমন অবস্থায় পুজো ? আমি নিজেও তখন জীবনের একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতায় কিছুটা হতচকিত। পাহাড়ে নিজের জন্য একটি স্থায়ী আস্তানা করার তাগিদে জীবনটাকেই বাজি ধরে ফেলেছি। গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো বাড়িকে থাকার উপযোগী করতে গিয়ে প্রায় পুনর্নির্মাণের পথে হাঁটতে হয়েছে। জমা পুঁজি মোটামুটি শেষ। ফলে, নতুন করে জীবিকার সন্ধানে শিলিগুড়ি শহরে যেতে হচ্ছে।
ভাঙা মন নিয়ে দিবারাত্রি যাপন তখন। সেই মন নিয়েই একদিন গ্রামের দু’একজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। গিয়ে শুনি বাচ্চারা দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে। সামান্য যা চাঁদা দিতে পারলাম, তাতে আমার তৃপ্তি না হলেও, ওরা খুশি। তারপর তো যাকে বলে স্বর্গ থেকে বিদায় ! এরপর কয়েকটি পুজো গেছে। আজকাল চুইখিম-শিলিগুড়ি মিলিয়ে যাপন। চুইখিম গেলে বাড়ির সামনের শিউলিফুলের গাছটা পুজোর গন্ধ এনে দেয়। না যেতে পারলে শিলিগুড়িতে গৃহবন্দি। কেন না, এখানেও এখন কলকাতার মতোই থিম-সংস্কৃতি। জীবনের পথও কিছুটা বদলেছে। ভয়াবহ অতিমারীর প্রকোপে সারা বিশ্ব টালমাটাল। তারই মধ্যে প্রকৃতির রুটিনছন্দে শরতের আগমন ঘটেছে। এখন পুজো বা তাকে ঘিরে উৎসব যেন দূর বিস্মৃত অতীত। দিন এখন যাপনে। উদযাপন শুধুই স্বপ্ন!