Sunday, May 19, 2024
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

মানুষের দুঃখ ভোলানোর তাগিদেই কমেডিয়ান হই

আমরা এই গুণী, হৃদয়বান মানুষটির দীর্ঘ জীবন কামনা করি। মানুষকে হাসানোর ব্রত যেন রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে ভুলে না যান তিনি ! রাজু শ্রীবাস্তবকে নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা

আপনাকে যদি বলি সত্য প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে চেনেন?– আপনি নির্ঘাৎ স্মৃতি হাতড়াবেন। কিন্তু রাজু শ্রীবাস্তব বললেই, আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটা নির্মল হাসিমুখ। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে খবরে আসেন রাজু। গত ১০ অগাস্ট জিমে শরীরচর্চা করাকালীন হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর। তাঁকে দিল্লির এইমস-এ ভর্তি করা হয়। অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক ছিল। অবশেষে অভিনেতা শেখর সুমনের ট্যুইটে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন রাজুর ভক্ত এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সঙ্কটমুক্ত রাজু! সংবাদ সূত্রে সকলেই জানেন তাঁর ‘ব্রেন ডেড’ হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে রাজুর সুস্থ হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে ম্যাজিক। যদি বলি, তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসাই রাজুকে সঙ্কটমুক্ত করেছে, সেটা ভাবাবেগ সঞ্জাত হলেও, মিথ্যে নয়।

লাফটার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তামাম হিন্দী টিভি দর্শকের উন্মাদনা পর্ব তখনও চলছে। মেগার চূড়ান্ত মেলোড্রামা, রিয়ালিটি শোয়ের উন্মাদনা ছাড়িয়ে দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে হাস্য রসাত্মক এই অভিনব শো। এক ঝাঁক দক্ষ ও প্রতিভাবান কমেডিয়ান উঠে এসেছেন স্ট্যান্ডআপ কমেডি ট্যালেন্ট শো ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’-কে ঘিরে। এঁদেরই একজন ছিলেন রাজু শ্রীবাস্তব। প্রসঙ্গত, কমেডি দুনিয়ায় তাঁকে গজধর বলেও সম্মোধন করেন কেউ কেউ। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’-এ রাজু সেকেন্ড রানার আপ হন। আর পরে এরই সূত্রে প্রস্তুত ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ-চ্যাম্পিয়নস’-এ তিনি ‘দ্য কিং অফ কমেডি’-র খেতাব জেতেন। ভারতীয় কমেডির মানচিত্রে রাজুর উজ্জ্বল হয়ে ওঠা এরপর ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা !

তারপর আরও অনেক শো-তে অংশ নেন রাজু। তার সবই যে কমেডি শো, তা নয়। সিনেমা ও মেগাতেও অভিনয় করেন। কোথাও ক্যামিও, কোথাও কোনও কমিক চরিত্র। পরবর্তীকালে রাজনীতিতেও আসেন তিনি। জন্ম কানপুরে ১৯৬৩-র ২৫শে ডিসেম্বর। তাঁর কমেডির মূল মন্ত্র শুরু থেকেই হয়ে উঠলো জীবনবোধ। বাল্য ও কৈশোর থেকেই চারপাশের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। সমাজের অসঙ্গতিগুলি ভাবিয়ে তুলতো তাঁকে। সেখান থেকেই আহরণ করতেন বিষয়, যা স্যাটায়ার ফর্মে উঠে আসতো পর্দায় ও মঞ্চে। এদেশে স্ট্যান্ডআপ কমেডির ভাবনা বিপুল জনপ্রিয়তা পায় যাঁদের জন্য, রাজু সেই দলের পুরোধা, অন্যতম প্রধান কারিগর।

সম্ভবত, সেটা বিগ বস সিজন ৩-এর সময়। ততদিনে রাজু হিন্দি বিনোদন দুনিয়ায় কমেডির সুপারস্টার। তখন এক প্রথম সারির বাংলা দৈনিকের সান্ধ্য বিভাগের বিনোদনের পাতার দায়িত্বে আছি আমি। মুম্বইতে শোয়ের জন সংযোগের কাজটা যাঁরা করছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে একটা ফোন এলো একদিন। অনুরোধ, রাজুর একটি সাক্ষাৎকার যদি আমি নিই এবং আমাদের কাগজে ছাপি। একটুও না ভেবে ‘হ্যাঁ’ বলি স্বাভাবিক কারণেই। তারপর রাজুর সঙ্গে আলাপ ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। পেশায় থাকাকালীন মুম্বইয়ের অনেক অভিনেতা, পরিচালক প্রমুখের সঙ্গেই কথা হয়েছে–সামনাসামনি বা ফোন আলাপনে। সেই সব কথোপকথনের সব যে মনে আছে, তা নয়। তবে,   রাজুর সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা ভুলিনি। অনাবিল এক সারল্য ছিল তাঁর বক্তব্য ও অভিব্যক্তিতে।

কেন কমেডি ? সব ছেড়ে এই বিষয়টাকেই বেছে নিলেন কেন ?– এই প্রশ্নের জবাবে রাজু বলেছিলেন,”আমার ছোটবেলাটা খুব কষ্টে কাটে। অনেক কিছু না পাওয়ার দুঃখ জড়িয়ে আছে স্মৃতিতে। তখনই ঠিক করেছিলাম, সুযোগ পেলে মানুষকে হাসাবো। দারিদ্রের থেকে বড় অভিশাপ আর কিছু হয় না। আমার আসরে এসে অন্তত কিছুক্ষণ তো তারা সব ভুলে থাকতে পারবেন !” সেটা যে রাজু পেরেছেন, তাতে সন্দেহ কী ! আমার আজও মনে আছে, বিগ বসের ঘরের কূটকচালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতদিন থাকতে পারবেন তিনি, এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায়, খুব একচোট হেসেছিলেন রাজু। বলেছিলেন,”কতদিন পারবো জানি না। যতটুকু পারবো, হেসে, হাসিয়ে কাটিয়ে দেব।” বলাই বাহুল্য, দু’মাসের বেশি টেকেননি রাজু সেখানে। এটা জানার পর ওঁর প্রাণখোলা হাসিটা কানে ভেসে এসেছিল।

ছোটপর্দার আর একটি কমেডি শো ‘কমেডি কা মহা মুকাবালা’–এখানেও নজর কাড়ে রাজুর পারফরম্যান্স। তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার শুরু বলিউড ব্লকবাস্টার ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ ছবিতে এক ছোট চরিত্রে। এরপর ‘বাজিগর’, ‘বোম্বে টু গোয়া’ থেকে ‘আমদানি আঠানি খরচা রূপাইয়া’–বহু ছবিতে কাজ করেন রাজু। তবে, সবই ছোট ছোট রোলে। ‘নাচ বলিয়ে সিজন ৬’-এও অংশগ্রহণ করেন রাজু, স্ত্রী শিখার সঙ্গে। ‘দ্য ইন্ডিয়ান মজাক লীগ’-এও ভাগ নেন রাজু, যার বিচারক ছিলেন জনপ্রিয় ক্রিকেটর হরভজন সিং (ভারত) ও শোয়েব আখতার (পাকিস্থান)। সাম্প্রতিক কমেডি সেনসেশন কপিল শর্মার শোয়েও আসেন রাজু। সেই সন্ধ্যায় তাঁর স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল উপস্থিতি কপিলের শোয়ের লক্ষ দর্শকের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।।

রাজু শ্রীবাস্তবের রাজনৈতিক কেরিয়ার যেন তাঁর কমেডি মেজাজের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলে। ২০১৪ সালে সমাজবাদী পার্টি কানপুর কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য রাজুকে টিকিট দেয়। কিছুদিন পরেই রাজু সে টিকিট ফেরত দেন এই অজুহাতে, যে, আঞ্চলিক ইউনিট তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে সমর্থন ও সহযোগিতা করছে না। এরপর রাজু বিজেপিতে যোগ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মেগা ইভেন্ট ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এ অংশ নেবার সুযোগ পান। আজও পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন শহরে মানুষকে পরিচ্ছন্নতার পাঠ পড়াচ্ছেন রাজু। তাঁর জনপ্রিয়তাকে একটি সৎ কাজে লাগানো হয়েছে, এটা বলতেই হবে।

‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-কে কেন্দ্র করে টিভি কমার্শিয়াল, মিউজিক ভিডিও ইত্যাদিতেও দেখা গেছে রাজুকে। সাম্প্রতিক হার্ট অ্যাটাকের আগে পর্যন্ত রাজুর জীবনে সবচেয়ে বড় খবরে আসার মতো যে ঘটনাটি ঘটে, সেটি হলো, পাকিস্থান থেকে থ্রেটনিং কল। তাঁর কোনও একটি শো-তে দাউদ ইব্রাহিম ও পাকিস্তানকে জড়িয়ে কিছু মস্করা করেছিলেন রাজু। এই শাসানি সেই কারণেই। বলিউড সেলিব্রিটিদের অনেকেই রাজনীতিতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের গ্ল্যাম ইমেজকে আর একটু পুষ্ট করতে এই মাঠে খেলার ভাণ করেন। রাজু সম্ভবত, খুব সিরিয়াসলি রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন, যেটা তাঁর কমিক ইমেজের একেবারে বিপরীত। তাঁকে শাসানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার কিছুদিন পরেই তাঁর হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা কাকতালীয় হতেই পারে। তবে, আমরা এই গুণী, হৃদয়বান মানুষটির দীর্ঘ জীবন কামনা করি। মানুষকে হাসানোর ব্রত যেন রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে ভুলে না যান তিনি !