ভোজনরসের প্রাঙ্গনে
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল খুললেই ভুরি ভুরি খাবারের ছবি আর রান্নার ভিডিও। দেখেই জিভে জল এসে যায়। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। রান্নার সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা বড়ই দুর্বল। রোজকার ডালভাতটা কোনও ক্রমে চালিয়ে নিই, ব্যাস ! সহজতম রেসিপিও অনুসরণ করে খাবার বানাতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যায় আমার। নিজে যে পদ্ধতিতে যেমন তেমন রেঁধে এসেছি, সেটাই মোটামুটি চলে। যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যগুণ বজায় রাখা, সেই পদ্ধতির অন্যতম অধ্যায়। আদতে এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ, উৎসাহ, ধৈর্য্য সবটাই কম। তারপরেও আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনরা যে আমার রান্না সোনামুখ করে খেয়ে নেয়, সে তাদের উদারতা !
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। আমার মা ছিলেন এককথায় রন্ধনপটিয়সী। সবজি কাটতেন, না, তো যেন শিল্পচর্চা ! রান্নার সঙ্গে সবজি কাটার নিবিড় সম্পর্ক মায়ের রান্না বাঁধাকপি, মোঁচা, লাউ বা চালকুমড়া ঘন্ট খেয়ে বোঝা যেত। চাকরি করতেন, বাড়িতে তখন পরিচারিকা রাখার ক্ষমতা ছিল না। মনে পড়ে, স্কুল থেকে এসে কোনও রকমে জামাকাপড় ছেড়েই রান্নাঘরে ঢুকতেন। তারপরও অমন মহার্ঘ রান্না। সবজির খোসাটা পর্যন্ত বেটে, তাকে কি যে সুস্বাদু করে তুলতেন কি বলবো ! আমার বোনও খুব ভালো রান্না করে। এখন আর মা রান্নাঘরে যান না। বয়স হয়েছে। ভাইয়ের বউই রান্না করে। সেও বেশ ভালোই রাঁধে। আমার ছোটমাসি, এপার বাংলার এক পরিবারে বধূ হয়ে গিয়ে পোস্ত, কলাইয়ের ডাল আর মাছের ঝাল, টক এমন রাঁধতে শিখে গিয়েছিলেন যে গোঁড়া এপার বঙ্গীয়রাও জয়জয়কার করতো নির্দ্বিধায়। গত বছর মাসি চলে গেছেন। কোনওদিন ওঁর অভাব পূর্ণ হবে না। তাঁর বাড়ি গেলে পোস্ত আর মাছের ঝাল খাওয়া বাঁধা ছিল আমার। রান্না করে, যত্নে তাকে পরিবেশন করায় নারীর মনের অনেক অনুভব জড়িয়ে থাকে। রান্না একদিকে তাই যেমন শিল্প, তেমনই নারীর চিরন্তন আবেগের এক অনুপম প্রকাশ।
খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাই। ওই ডালভাতটুকু সেখানে গিয়েই শেখা। আমার শাশুড়ি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। বিয়ের আগে মা হাজার চেষ্টা করেও আমাকে রান্নাঘরে আকর্ষিত করতে পারেননি। ভয় দেখাতেন, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিপদে পড়বি। কিসের বিপদ ? আমি প্রায়ই উল্টোপাল্টা কান্ড করতাম, আর আমার শ্বাশুড়ি বলতেন, প্রথম প্রথম সবারই ওইরকম হয়। সেই প্রথমাবস্থা কাটতে অনেকদিন লেগে গেল আমার। যেদিন প্রথম সফল শুঁটকি মাছ রান্না করতে পারলাম, সেদিন আমার বিশ্বজয় !! ঠিকই ধরেছেন, আমি দুদিকেই কাঠ বাঙাল। তবে, শুঁটকি মাছ খেতে ও রাঁধতে শেখা শ্বশুরবাড়ি গিয়েই। আমাদের বাড়িতে এর চল, যে কোনও কারণেই হোক ছিল না। আর একদিন, শ্বশুরবাড়িতে আমার সবচেয়ে বড় পরীক্ষক বড় ননদাই আমার রান্না বাঁধাকপির তরকারি খেয়ে বললেন, নাঃ, এবার বাড়ির ছোটবউ রান্না শিখে গেছে। মনে পড়ছে, রীতিমতো উল্লসিত হয়েছিলাম। রান্না বিষয়ে আমার সার্টিফিকেট পাওয়ার ঘটনা এতই কম যে, যতটুকু ঘটেছে, তা জীবনখাতার প্রতি পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
সাংবাদিকতায় একটু আধটু নাম হয়েছে তখন। এদিকে রবীন্দ্রসংগীতের একটা ব্যাকগ্রাউন্ডও ছিল। একটা চ্যানেলে টিভি শো হোস্ট করছি। সব মিলিয়ে কিছুটা পরিচিতি হয়েছে। সেই সময় একটি বাংলা চ্যানেলের একটি জনপ্রিয় কুকারি শো-তে আমাকে ডাকলো, অতিথি হিসেবে। চিকেনের একটা (ওই একটাই স্পেশাল ডিশ জানতাম) প্রিপারেশন করেছিলাম সেখানে। শো টেলিকাস্ট হওয়ার পর সেটা দেখে আমার মা বললো, তুই টিভিতে রান্না করছিস, আর সেটাও আমাকে দেখতে হলো ? ভাবুন একবার, পুরো প্রেস্টিজ পাংচার। শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন ততদিনে। উনি বেঁচে থাকলে কিন্তু দিব্যি খুশি হতেন ! আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসাটা ছিল ফল্গুধারার মতো। বয়েই চলতো। এটা ঠিক ওই বিশেষ আইটেমটি এরপর অনেককে করে খাওয়াতে হয়। মোটামুটি উৎরেও যাই। বারদুয়েক অফিসেও বানিয়ে নিয়ে গেছি। এটা হলো, যাকে বলে, প্রচারের মহিমা। ওই যে টিভিতে দেখিয়েছে।
আমার শিলিগুড়ি বাড়ির প্রতিবেশী সোনিয়া একজন স্কুল শিক্ষক। সংসারে বেজায় ব্যস্ত। তারই মধ্যে নিজের দারুন এক কুকারি শো চালায় ইউটিউব চ্যানেলে। সোনিয়ার তৈরি পদগুলির রেসিপি অধিকাংশই তুলনামূলক ভাবে সরল। সাহস করে চেষ্টা করেছি। নিজে খেয়েছি। খারাপ লাগেনি। কিন্তু কাউকে চাখতে দেওয়ার সাহস পাইনি। কী জানি, ঠিক হলো কিনা! রান্নার ক্ষেত্রে এই দুর্বার ভয়, আমার আর কাটে না। আর সোনিয়ার স্পেশাল ডিশগুলো এতটাই স্পেশাল যে হাত দেওয়ার সাহসই পাইনি। বলেছি, ওর বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো। সোনিয়া আমার লাইভ টক শো-তে এসে জানিয়েছিল, রান্না তার প্যাশন। বিষয়টা আদ্যন্ত উপভোগ করে সে। এই উপভোগ ব্যাপারটাই আসল। তাহলেই সেই রান্না, অতি সাধারণ পদ হলেও শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছয়।
আমার ফেসবুক বন্ধু রিংকু। সেও রীতিমতো রন্ধন পটিয়সী। রান্নার গুণে সে একাধারে আপামর মানুষের হৃদয় জয় করেছে। অন্যদিকে পারিবারিক ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ভাবে সংসারের হাল ধরেছে রিংকুর রান্না। অতিমারীর সময়ে বহু পরিবার তাঁর হোম ডেলিভারি সার্ভিস পেয়ে বর্তে গেছে। রিংকুর রান্নার পদের ছবি ও রেসিপি ফেসবুকে দেখি আর জিভের জল সংবরণ করি। বহুদিন ধরে নেমন্তন্ন নিয়েও রেখেছি। কথা হয়ে আছে, কলকাতা গেলে, তার বাড়িতে যাব আর সব খাবারই চেখে দেখবো। বলতে পারেন, বাংলার চিরন্তন প্রবাদ ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়’–রিংকু আর আমার বন্ধুত্বের সূত্রকে দৃঢ় করেছে।
আমি আদতে একজন ভোজনরসিক মানুষ। যেমন ‘টি টেস্টার’ থাকে, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে আমি ঠিক সেই কাজটাই নিখুঁতভাবে করতে পারি। শুক্তো থেকে চাটনি, এপার ও ওপার বাংলা, এই রাজ্য, ভিন রাজ্য, ভারতীয় বা অভারতীয়, সব পদেই আমার বিলক্ষণ রুচি বর্তমান। আমি খেতে ভালোবাসি, তা আমার ভালোবাসার মানুষরাও জানে। তারা আমায় পাত পেড়ে খাইয়ে সুখ পায়। আমি নির্দ্বিধায় তাদের সুখী করি। আর নিজেও সুখী হই। এই ডায়েটিং-বেলাতেও খুব আহামরি নিয়ম মেনে চলা ঘটে না আমার। রোজ প্রতিজ্ঞা করি, রোজ ভাঙি। দিনের শেষে নিজেকে ক্ষমা করে বলি, খেয়ে নাও দু’দিন বই তো নয় !!