অনুরাগী ‘মেট্রো’ আর একবার
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এবারে তাঁর পাখির চোখ চার মেট্রো শহর ঘিরে। অনুরাগ বসুর ‘মেট্রো ইন দিনো’ নিয়ে লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
একদা মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে শাসন করেছেন বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি বাঙালি পরিচালক। বিমল রায় থেকে হৃষিকেশ মুখার্জি হয়ে সেই ধারা আজও প্রবাহিত। আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের সৃষ্টি। তাঁরা কেউই সেভাবে উত্তরসূরীদের পথ অনুসরণ করেননি এটা যেমন ঠিক, তেমনই নিজেদের ভাবনা ও অনুভবে স্ববৈশিষ্টে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁরা, এ কথাও অনস্বীকার্য। অনুরাগ বসু এমনই একজন পরিচালক। বাঙালি মননকে হাতিয়ার করেই তিনি একের পর এক সংবেদনশীল ছবি বানিয়েছেন, যা মুম্বইয়ের বিশাল বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে না হারিয়ে গিয়ে, নিজেদের আলাদা এক বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
অনুরাগের ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ এমনই এক ছবি। ২০০৭-এ মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ধর্মেন্দ্র, নাফিসা আলি, শিল্পা শেট্টি, সাইনি আহুজা, শরমন যোশী, কঙ্গনা রানাওয়াত, ইরফান খান, কঙ্কনা সেনশর্মা ও কেকে মেনন। এ ছবি বিপুল প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছিল দর্শক এবং সমালোচক মহলে। শুধু তাই নয়। প্রীতমের সুরে ছবির গানগুলিও ছিল চার্টবাস্টার। মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে অনুরাগ যে সিদ্ধহস্ত তা বারবার প্রমাণ করেছে অনুরাগের বিভিন্ন ছবি। তবে, তাঁর সমস্ত ছবিগুলির মধ্যে কোথাও ‘মেট্রো’ তাঁর মনের অনেক কাছের। তাই দীর্ঘ ১৪ বছর পর আবার ‘মেট্রো ইন দিনো’ নিয়ে আসছেন অনুরাগ। ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে সেই খবর জেনে গিয়েছেন সকলেই। প্রসঙ্গত মুম্বই শহরের প্রেক্ষাপটে আবর্তিত ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’-য় বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব, কমিটমেন্ট ফোবিয়া, প্রেমের বিভিন্ন আখ্যানকে তুলে ধরেছিলেন অনুরাগ।
‘মেট্রো ইন দিনো’-য় একটি নয়, চারটি আলাদা আলাদা শহরের গল্প বলেছেন অনুরাগ। একটি গল্পের সঙ্গে যোগ রয়েছে অপরটির। তবে চারটি গল্পের প্রেক্ষাপট আলাদা হওয়ার কারণে শহর আলাদা হয়ে যায়। গল্পগুলি আবর্তিত হয়েছে মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা এবং বেঙ্গালুরুতে। কলকাতার প্রেক্ষাপটে থাকা গল্পে রয়েছেন অনুপম খের ও নীনা গুপ্তা। চমক রয়েছে অন্য জায়গায়। ছবিতে রয়েছেন বাংলা ছবির পরিচিত মুখ দর্শনা বণিক। ইতিমধ্যেই মুম্বইয়ে ছবিটির একটি অংশের শুটিং করেছেন অভিনেত্রী। ছবিতে তাঁর বেশিরভাগ দৃশ্য রয়েছে অনুপম খেরের সঙ্গে। কলকাতা অংশের শুটিংয়ে দর্শনা ছাড়াও দেখা গিয়েছে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে। অর্থাৎ কলকাতা শহরের গল্পটিতে অনুপম ও নীনার সঙ্গে রয়েছেন দর্শনা ও শাশ্বত। সূত্রের খবর, ছবির আরও একটি গল্পেও নাকি দেখা যাবে শাশ্বতকে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ‘জগ্গা জাসুস’-এ অনুরাগের সঙ্গে কাজ করেছিলেন শাশ্বত। তাঁর দক্ষতা সবসময়ই প্রশ্নাতীত। দিন কয়েক আগেই নতুন ছবিতে কারা অভিনয় করছেন তা প্রকাশ্যে এসেছে। ছবিতে অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন আদিত্য রায় কাপুর, সারা আলি খান, ফতিমা সানা শেখ, আলি ফজল, পঙ্কজ ত্রিপাঠী ও কঙ্কনা সেনশর্মা। ছবির কাস্টিং বলে দিচ্ছে, এবারেও আমরা দারুণ ইনটেন্স অভিনয়ের ঝলক দেখতে পাব চারটি গল্পে বিন্যস্ত এই ছবিতে, যা অনুরাগের ছবির অন্যতম ইউএসপি। প্রতি ছবিতেই দর্শক লক্ষ্য করেছেন এই বিষয়টি। ‘মেট্রো ইন দিনো’-তেও সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন প্রীতম। অর্থাৎ, এখানেও কামাল করা কিছু ঘটতে চলেছে।
সম্প্রতি ছবির কলকাতা শিডিউলের একপ্রস্থ শুটিং শেষ করলেন অনুরাগ। শহর তিলোত্তমার বহুল পরিচিত নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো সহ বেশকিছু জায়গায় অনুপম-নীনা ও শাশ্বত-দর্শনাকে নিয়ে একপ্রস্থ শুটিং করেছেন পরিচালক। ছোট্ট শিডিউলের ফাঁকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তায় ছবি ও শহর কলকাতা নিয়ে নিজের মনের কথা খুলে বলেছেন তিনি। ‘মেট্রো ইন দিনো’-কে সিক্যুয়েল বলতে নারাজ তিনি। অনুরাগের মন্তব্য, “আমার ‘মেট্রো’ শহরকে বিষয় করে আর একটা ছবি বানানোর ইচ্ছে ছিল। এই ছবিটাকে আগের ছবির সিক্যুয়েল বলব না। সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। লোকজনও অনেকটাই বদলে গেছে। এমনকী কোভিড পরবর্তী সময়ে পুরো পৃথিবী জুড়েই একটা বদল ঘটে গিয়েছে। আগেরবারের গল্পটা পুরোপুরি মুম্বই শহরকে কেন্দ্র করে ছিল। এবার ভারতের সবকটা মেট্রো শহর (কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরু) উঠে আসবে। প্রতিটা শহরের সমস্যা আলাদা। মানুষের জীবনে শহরের একটা প্রভাব আছে। সেটার প্রতিফলন খুব বেশি করে পড়ে মানুষের উপরে।”
কলকাতায় ছবির শুটিং প্রসঙ্গে অনুরাগ বলেন, “কলকাতা আমার কাছে শুধুমাত্র শহর নয়, কলকাতা হচ্ছে ডায়েরি। কলকাতার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। দুনিয়া যে গতিতে বদলেছে, কলকাতা বদলায়নি। শহরটার একটা নিজস্ব গতি থাকলেও এখনও সেই old world charmটা রয়েছে।” ছবিতে অনুপম খের ও নীনা গুপ্তার সঙ্গে কাজ করার প্রসঙ্গে পরিচালক জানান, “অনুপমজীর সঙ্গে আগে কাজ করেছি। এই জুটিটা খুব ভালো। আমি যখন ছবির জন্য কাস্টিং করছিলাম তখন প্রথমেই ওঁদের দুজনের কথাই মাথায় এসেছিল।” পাশাপাশি শাশ্বতকে নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ অনুরাগ। তাঁর কথায়, “আমি ওকে (শাশ্বত) ভীষণ ভালোবাসি। অসাধারণ একজন অভিনেতা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। পাশাপাশি ওর কাজের খিদেটাও বেড়েছে।”
তবে ‘মেট্রো ইন দিনো’ শুধুমাত্র একটা ছবি নয় অনুরাগের কাছে। পাশাপাশি এক অর্থে স্মৃতিরোমন্থনও। সেই কথা অকপটে সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। অনুরাগের কথায়, “এই ছবিটা করার সময় ইরফান, কেকে (গায়ক)-কে খুব মিস করছি। ইরফান আমাকে সবচেয়ে বেশি push করতো এই ছবিটার জন্য।” তবে শুধু ইরফান বা কেকে নন, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ও এডিটরকেও হারিয়েছেন অনুরাগ। তাই ‘মেট্রো ইন দিনো’-র শুটিংয়ে রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এখন দেখার বিষয় এটাই যে অনুরাগ বসুর ‘মেট্রো ইন দিনো’-তে চার মেট্রো শহরের আলাদা আলাদা গল্পের কোন কোলাজগাথা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন ? এবার মানব সম্পর্কের কোন দিকগুলি উন্মোচিত হয় ?