Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

মনোহর লেক আর দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত  উদয়পুর

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। রাজস্থান ডায়েরি লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ চতুর্থ পর্ব।

  • ৩য় দিন 

রাজস্থানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় বাস সার্ভিস বেশ ভালো। জয়পুর থেকে ৩৯৩ কিমি পথ উদয়পুর পৌঁছতে এক ঘন্টা লাঞ্চ-ব্রেক সহ সাড়ে ছ’ঘন্টা সময় লাগলো। রাজস্থান ট্যুরিজমের টুরিস্ট লজে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা চা অর্ডার করলাম। এরপরে বেরতে বেরতে  চারটে বেজে গেল। উদয়পুর সিটি প্যালেস কাছেই। কিন্তু ভিজিটিং আওয়ার সাড়ে নটা থেকে সাড়ে পাঁচটা। রাজস্থানের বৃহত্তম এই রাজপ্রাসাদ রয়্যাল সিটি প্যালেস ঘুরতে সময় লাগবে অন্তত তিন ঘন্টা। সেই কারণে আমরা ‘সহেলিওঁ কী বাড়ি’ ঘুরতে গেলাম। গাড়ির ব্যবস্থা করাই ছিল। আরবল্লী পর্বতের প্রেক্ষাপটে একাধিক মনোহর লেক আর অসাধারণ স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত স্বপ্নের শহর উদয়পুর গ্রীষ্মকাল ছাড়া বছরের বাকি সময় ভ্রমণের আদৰ্শ স্থান।

মহারানা সংগ্রাম সিংহের আমলে ‘সহেলিওঁ কী বাড়ি’ নির্মাণ করা হয়েছিল রাজ-পরিবারের মহিলাদের বিনোদনের জন্য। সুন্দর বাগান,পদ্ম দীঘি, দোলনা, ফোয়ারায় সুসজ্জিত এই বাড়িতে পা রেখেই মন ভালো হয়ে যায়। একটা ছোটো মিউজিয়ামও আছে ভিতরে। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কিভাবে পেরিয়ে গেল দেড়ঘন্টা, টেরই পাওয়া গেল না। ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ারও শেষ। সূর্যদেব পাটে বসেছেন। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা বাজার এলাকায় গেলাম। সবরকম পসরায় জমজমাট নানান বাজেটের রকমারি রঙিন বাজার। বেশ খিদে পেয়ে গেছিল। একটা রেঁস্তোরায় ঢুকে আমরা চা আর পকোড়া খেয়ে লজে ফিরে এলাম। সকলেই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সেইজন্য  ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়লাম এনার্জি সঞ্চয়ের জন্য। পরদিন সকাল নটায় স্নান ব্রেকফাস্ট সেরে আবার বেরিয়ে পড়া।

  • ৪র্থ দিন 

পাক্কা সাড়ে নটায় আমরা পৌঁছে গেলাম সিটি প্যালেস চত্বরে। আরাবল্লীর সবুজ ঢালে তিন দিকে পিছোলা লেক দিয়ে ঘেরা অসাধারণ লোকেশন সিটি রয়্যাল পালেসের। সুরক্ষার কারণেই ৫৭৭ মি উচ্চতায় এই ফোর্ট কাম প্যালেস তৈরি করেছিলেন মেবারের মহারানা উদয় সিং ২! মুঘলদের লাগাতার আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে চিতোর গড় থেকে উদয়পুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন রানা উদয় সিং ২। তাঁর ছেলে মহারানা প্রতাপ বিখ্যাত হলদিঘাটের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে পরাজিত হন। তাঁর পরে রাজ্যের হাল ধরেন মহারানা অমর সিং। উদয়পুরে রাজধানী স্থানান্তরের পরেও মারাঠাদের বারবার আক্রমণে পর্যুদস্ত মেবারের রানা প্রতিরক্ষা সহায়তার চুক্তি করেন ব্রিটিশদের সঙ্গে। এর ফলে রাজত্ব এবং রানা খেতাব অক্ষুন্ন থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৫১ সালে মেবার সংযুক্ত হয় স্বাধীন ভারতের অঙ্গ হিসেবে।

Img 20230121 Wa0064
মনোহর লেক আর দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত  উদয়পুর 9

রয়্যাল সিটি প্যালেসের প্রাচীন অংশের অনেকটা এলাকা জুড়ে সমৃদ্ধ মিউজিয়াম। সিটি প্যালেসের ভেতরে আরও অনেক প্রাসাদ আছে। বেশ কিছু প্রাসাদকে হেরিটেজ হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একটার পর একটা মহল আর তার অলঙ্করণ, স্থাপত্য দেখতে দেখতে অবলীলায় পেরিয়ে গেল তিন ঘন্টা। সিটি প্যালেস থেকে বেরিয়ে প্রোগ্রাম হলো পিছোলা লেকে বোটিং এবং বোটিং-এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাইট-সিইংও। পিছোলা লেকের মধ্যে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে চারটে দ্বীপ। তারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জগনিবাস প্যালেস এবং জগমন্দির প্যালেস। রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস হিসেবে তৈরি করা হয় জগনিবাস প্যালেস। মহারানা অমর সিংহের আমলে শুরু হয়ে নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হয় মহারানা জগৎ সিংহের হাতে। জগত সিংহের নামানুসারেই প্যালেসের নামকরণ হয়েছে।

মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজকীয় বৈভবে সাজানো এই প্রাসাদকে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বিলাসবহুল হেরিটেজ লেক প্যালেস হোটেলে রূপান্ন্তরিত হয়েছে জগনিবাস প্যালেস। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই এই হোটেল উদ্বোধন করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি একরাত্রি বাস করে গেছেন এই হোটেলে।

Img 20230121 Wa0065
মনোহর লেক আর দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত  উদয়পুর 10

জগনিবাসের বিপরীতে হলুদ বেলেপাথরে তৈরি ত্রিতল প্রাসাদ জগমন্দির বা গুলমহল প্যালেস রূপান্তরিত হয়েছে হেরিটেজ হোটেল লেক গার্ডেন প্যালেসে। হোটেলের রেসিডেন্ট ছাড়া সাধারণ পর্যটকের প্রবেশাধিকার নেই প্যালেসে। কথিত আছে, সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশরা শেল্টার নিয়েছিল এই প্রাসাদে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী শাহজাহানও কিছুদিন এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, স্বপ্ননগরী উদয়পুরের পিছোলা লেক এবং রাজপ্রাসাদগুলিতে বেশ কিছু হলিউড এবং বহু বলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছে। বিশিষ্ট বাঙালি চিত্র পরিচালক তপন সিনহার অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’র বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিংও হয়েছে উদয়পুরে।

লেকের আয়নায় মুখ দেখছে উজ্জ্বল নীল আকাশ। কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ আরাবল্লীর অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। চলমান বোটে বসে এইসব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল আরও দুই ঘন্টা। লাঞ্চের জন্য ফিরে এলাম বাস্তব পৃথিবীতে। ড্রাইভার আনন্দ খুবই হাসিখুশি অমায়িক বিনয়ী যুবক। স্পেশাল ‘বড়িয়া’ লাঞ্চ করাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল বাজার এলাকার একটা রেস্তোরাঁয়। বাইরে থেকে দেখে তেমন ‘বড়িয়া’ মনে হলো না। কিন্তু রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে অবাক–সব টেবিল প্রায় ভর্তি। ভাগ্যক্রমে আমরা একটা টেবিল পেয়ে গেলাম। ওখানে শুধু রাজস্থানী থালি পাওয়া যায় বলে খাবার পেতেও দেরি হলো না। থালির মেনু জয়পুরের মতই –ডাল বাটি চুরমা, গাট্টে কী সবজি, কড়ি চাওল ইত্যাদি। কিন্তু স্বাদে আকাশ-পাতাল তফাৎ।

লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠে আনন্দকে ধন্যবাদ জানালাম এবং পরবর্তী গন্তব্য ফতেহ সাগর লেকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মহারানা ফতেহ সিং ১৮৮০ সালে খনন করান এই লেক। আসলে উদয়পুরের সব লেকই কৃত্রিম লেক। চাষবাস, গৃহস্থালীর কাজকর্ম এবং অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে লেকগুলো খনন করে জল ধরে রাখার জন্য ‘ড্যাম’ বানানো হয়। পরবর্তী সময়ে সৌন্দর্যায়ন করে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। এই লেকগুলোই উদয়পুরের প্রাণ সঞ্জীবনী। ফতেহ সাগর লেকেও কয়েকটি ছোটো ছোটো দ্বীপ আছে। তারমধ্যে একটি দ্বীপে বৃন্দাবন গার্ডেন-এর আদলে নেহরু পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। আরেকটিতে ‘উদয়পুর সোলার অবজারভেটরি সেন্টার’ তৈরি করা হয়েছে। বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে এখানেও। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় বাইরে থেকেই দেখে, সজ্জন গড় প্যালেস বা ‘মনসুন’ প্যালেসের দিকে রওনা দিলাম।

Img 20230121 Wa0069
মনোহর লেক আর দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত  উদয়পুর 11

শহরের বাইরে পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা আরবল্লীর উচ্চ শিখরে রাজস্থান স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত এই প্যালেস নির্মাণ করেছিলেন মেবার রাজবংশের মহারানা সজ্জন সিং। মূলত পাহাড়চূড়ায় বসে মনসুন রেন বা বর্ষার বৃষ্টি উপভোগ করার জন্য এবং উদয়পুর শহর ও চারপাশে নজরদারির জন্য এই প্যালেস নির্মাণ করা হয়। ভেতরে দর্শনীয় অনেককিছু আছে। মিনি চিড়িয়াখানা, ছোটোদের মনোরঞ্জনের জন্য মিনি টয় ট্রেন, মূল্যবান পুঁথি ও বইয়ের সংগ্রহশালা সরস্বতী সদন, গোলাপ বাগ ইত্যাদি। সজ্জন গড় প্যালেস থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক দুর্লভ স্মৃতি। লজে ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল । ডিনার সেরে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানিয়ে রাখি, পরদিন সকালে লেক-সিটি উদয়পুরকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেব ভারতের অন্যতম বিখ্যাত শৈলশহর ‘মাউন্ট আবু’র উদ্দেশে। (চলবে)

ছবি : লেখক