Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

মরুভূমির শূন্যতা ঢেকে দেয় আনন্দপ্রিয় মানুষের রঙিন উপস্থিতি

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। রাজস্থান ডায়েরি লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ সপ্তম ও শেষ পর্ব।

একথা অনস্বীকার্য, জয়সলমীরকে জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম ঠিকানা হিসেবে সন্ধান দেবার নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা লেখক ও চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের। তাঁর লেখা ফেলুদা সিরিজের প্রথম গোয়েন্দা গল্প ‘সোনার কেল্লা’ এবং তার অসাধারণ চলচ্চিত্রায়ন জনসমক্ষে এনে দিয়েছিল সোনার কেল্লার মরুশহর জয়সলমীরকে। ধু ধু বালি আর দিগন্ত বিস্তৃত সোনালি-হলুদ বালিয়াড়ির মধ্যে জয়সলমীর যেন আরব্য রজনীর একটুকরো দেশ। ১৭৫০ সালে রাজস্থানের অন্যান্য শহরের ফোর্টগুলির মত সুরক্ষার কারণে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয় পুরো জয়সলমীর শহর।  রাজপ্রাসাদ, আমলা, প্রজাদের বাসস্থান দোকানপাট, মন্দির–সবকিছুই ফোর্ট এরিয়ার মধ্যে ছিল। ফোর্ট এরিয়ার বাইরের অঞ্চলের বিস্তৃতি শুরু হয় তার অনেক পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত এখান থেকে মরুপথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য-যোগাযোগ ছিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য তথ্য, জয়শলমীর ফোর্ট, অর্থাৎ, ‘সোনার কেল্লা’ ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্মান অর্জন করেছে।

জয়সলমীরে রাজত্ব করেছেন রাওয়াল রাজপুত (ভাটি) বংশ । রাজা জয় রাওয়াল এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামানুসারেই নামকরণ হয় জয়সলমীরের। বারবার মুসলিম আক্রমণের ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছে জয়সলমীরকেও। ১২৯৪ সালে আলাউদ্দিন খিলজি, ১৫০০-য় মুঘল আক্রমণ। এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে জয়সলমীর। উনিশ শতকের প্রথমদিকে আসে ব্রিটিশ। ভারতের স্বাধীনতার পরে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে সীমান্ত সুদৃঢ় করতে অতিদ্রুত গড়ে তোলা হয় রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। সীমান্ত পাহারায় মোতায়েন করা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। ইলেকট্রিসিটি ও জলের ব্যবস্থার উন্নতি করা হয়। জয়সলমীর হয়ে ওঠে বসবাস এবং পর্যটক সমাবেশের আদৰ্শ স্থান।

জয়সলমীর ভ্রমণের প্রধান দ্রষ্টব্য সোনালি-হলুদ বেলেপাথরের তৈরি দুর্গ জয়সলমীর ফোর্ট বা সোনার কেল্লা এবং থর মরুভূমি, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট। এছাড়া কয়েকটা লেক (মরুদ্যান ) আছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গদিসাগর লেক। জয়সলমীরের বৈশিষ্ট্য–পাথর কুঁদে তৈরি সূক্ষ জাফরির কাজ –যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। রাজপ্রাসাদ শুধু নয়, জয়সলমীরের বহু বাড়িতেও এইসব কাজ দেখা যায়। গোলাকার প্রাচীরে ঘেরা জয়সলমীর ফোর্টের অবস্থান ত্রিকূট পাহাড়ের ওপরে। সেইকারণে বহুদূর থেকে নজরে আসে এই স্বর্ণালী ফোর্ট। ফোর্টের ভেতরের রাস্তা সংকীর্ণ হলেও বেশ পরিকল্পিত এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থায় মজবুত। রাজপ্রাসাদের ভিতরের এবং বাইরের কারুকাজ, অলঙ্করণ মুগ্ধ করে। দুর্গচত্বরে সাতটি জৈন মন্দির এবং চারটে শিবমন্দির আছে। এছাড়া কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ‘হাভেলি’ও আছে। আছে প্রচুর দোকানপাট–সেখানে কার্পেট, আঞ্চলিক হস্তশিল্প, সূচীশিল্প, কাচ বসানো পোশাক ইত্যাদি বহু সংগ্রহযোগ্য জিনিসের হাতছানি। ফোর্টের বাইরেও রয়েছে জমজমাট বাজার।

ফোর্ট থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ সেরে আমরা মরুভূমির বুকে মরুদ্যান গদিসাগর লেক দেখতে গেলাম। সুন্দর কারুকার্য খচিত প্রবেশ-তোরণ পেরিয়ে লেকের কাছে পৌঁছলাম। ঘাটের পর ঘাট, লেকের মাঝে ছত্তিশ এবং লেকের চারপাশ ঘিরে মন্দির অপূর্ব দৃশ্যপট তৈরি করেছে। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। পরের গন্তব্য শহর ছাড়িয়ে থর মরুভূমির সোনালি-হলুদ বালুকারাশির মাঝখানে। পিঠে সওয়ারি নিয়ে মরুভূমির বালিয়াড়ি ভেঙে ধীরগতিতে সারি দিয়ে উট চলেছে –যা এতদিন সিনেমায় এবং বইয়ের ছবিতে দেখেছি। চোখের সামনে সেই দৃশ্যপট অদ্ভুত ভালোলাগায় আপ্লুত করে দিল।

শুধু উটের পিঠে নয়, ‘ডেজার্ট সাফারি’ এখন আরও অনেক উন্নতমানের। জিপ জাতীয় শক্তপোক্ত গাড়িতে স্যান্ড ডিউনস ভেঙে সাফারিতে মজাই আলাদা। বাড়তি প্রাপ্তি সাফারির পরে ডেজার্ট ক্যাম্পে বিপুল বিনোদনের আয়োজনে অংশগ্রহণ। একরাত কাটাতে চাইলে ক্যাম্পে থাকার চমৎকার বন্দোবস্ত রয়েছে। সাফারির পরে ক্যাম্পে ওয়েলকাম স্ন্যাকস এবং ঢালাও চা-কফির আয়োজন। তারপর শুরু হয় বন-ফায়ার এবং রাজস্থানী শিল্পীদের আকর্ষণীয় লোকসঙ্গীত এবং  লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান। এরই মধ্যে চলতে থাকে রকমারি পদের ডিনার। এককথায় ‘ডেজার্ট সাফারি’ এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আরও এক অনন্য অভিজ্ঞতা মরুভূমির সূর্যাস্ত। অনির্বচনীয় সে দৃশ্য ! সূর্যাস্তের পরেই সমাপ্ত হলো আমাদের জয়সলমীর ভ্রমণ। বৈচিত্র আর বর্ণময়তায় বিশ্ব-দরবারে ঠাঁই করে নিয়েছে রাজস্থান। দারিদ্র আছে, সমস্যা আছে, কুসংস্কার আছে, অশিক্ষা আছে। তবু রাজস্থানের সহজ সরল সাধারণ মানুষগুলো খুব আনন্দপ্ৰিয়। তাই এত রঙ ছড়িয়ে আছে রাজস্থানের আকাশে বাতাসে।