দশ ফুট দূরত্বে বাঘ, সেরা প্রাপ্তি
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পড়ছেন কাজিরাঙার বর্ণময় কাহিনি। আজ পঞ্চম ও শেষ পর্ব। লিখছেন মণিদীপা কর।
কাজিরাঙার শেষ দিন সকাল থেকে আকাশ ঝকঝকে। ফলে মন বলছে, বিকেলের সাফারিতে সেন্ট্রাল জোনে বাঘ দর্শনের চান্স প্রবল। ছেলের ইচ্ছায় আজ আমরা তকিবের জিপসিতে। গাড়ি কোহরা জোনে ঢোকার সময় পথের ধারে হরিণ, গণ্ডার দেখেও গাড়ি থামাতে বারণ করলাম। কারণ, এবার ক্যামেরায় শুধুই বাঘের ছবি তুলতে চাই। কিছুদূর গিয়েই তকিবের মোবাইলে মেসেজ ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন ঝড়ের চেয়ে বেশি স্পিডে গাড়ি ছুটতে শুরু করল তার। তকিবকে প্রশ্ন করে কারণ জানলাম–ডাফলং যাওয়ার পথে এক পুরুষ ও স্ত্রী বাঘকে রাস্তা জুড়ে বসে থাকতে দেখেছে পর্যটকদের একটা জিপসি। তাদের দেখেই বাঘ দম্পতি ঘাসের বনে ঢুকে গিয়েছে।
ডাফলং-এর কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি থামাল তকিব। ফোন করে জেনে নিল, কোথায় যেতে হবে। তারপর আবার গাড়ি থামাল ডাফলং ওয়াচ টাওয়ারের সামনে গিয়ে। নিচে বেশ কিছু ফটোগ্রাফারকে পথের দিকে ‘কামান’ থুড়ি ক্যামেরা তাক করতে দেখে আমরাও নিচে থাকব কিনা জিজ্ঞাসা করায় ও আমাদের কঠোরভাবে উপরে ওঠার নির্দেশ দিল। উপরে উঠতে উঠতেই একটা উত্তেজনা মিশ্রিত ফিসফিসানি শুনে বুঝলাম বাঘের দেখা মিলেছে। একছুটে উপরে উঠে কোনও ক্রমে একটা জায়গা করে নিয়ে অন্যদের ক্যামেরার অভিমুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, কোথায় বাঘ। দেখলাম, ডাফলং বিলের ধারে কিছুটা ফাঁকা অংশে হেঁটে চলেছেন হলদে-কালো পোশাকের মহারাজ। মুখ আমাদেরই দিকে। কয়েকটা কয়েকটা খিচিক করলাম। তারপরই তিনি ঘাস বনে ঢুকে পড়লেন।
এবার তার অভিমুখ বিচার করে সকলেরই ধারণা, সে নিশ্চয়ই সামনের রাস্তা পেরোবে। আবার আমরা নিচে নেমে রাস্তার কাছে যেতে চাইলাম। এবারও তকিবের নির্দেশ, উপরেই থাকুন। ইতিমধ্যেই আমাদের ফোন পেয়ে আমাদের দ্বিতীয় গাড়ি এসে গেছে। যদিও ওরা অন্য জিপসির মতো রাস্তাতেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সকলের নজর ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে। ক্যামেরা তাক করা সামনের পথের উপর। অল্প কয়েকজন ওয়াচ টাওয়ারের পিছনের দিকে দেখছে। এক এক করে মুহূর্ত কাটছে। হিসাব বলছে, বাঘ যে স্পিডে হাঁটছিল তাতে এতক্ষণে রাস্তা টপকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়ার কথা। তবে কি বাঘ এত গাড়ি দেখে বের হবে না ? ঘাসবনেই বসে পড়ল ?
মাথার ভিতর এমন অসংখ্য হিসেব ঘুরছে। ঠিক তখনই পিছনের দিক থেকে শুনতে পেলাম, ‘বাঘ বাঘ’। এক মুহূর্তে ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে সামনের রাস্তা দেখে বুঝে গেলাম, বাঘ সামনে নয়, পিছনে। দৌড়ে পিছনে গিয়ে দেখলাম, ফুট দশেক দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মহারাজ, থুড়ি মহারানি। তার উজ্জ্বল কমলা-কালো শরীরে সূর্যের পড়ন্ত আলো পিছলে পড়ছে। ডান দিক থেকে বাঁদিকে যাওয়ার পথে একবার মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দেখে নিল। ঠিক যেন রাজপ্রাসাদের ব্যালকনি থেকে অপেক্ষারত প্রজাদের এক ঝলক দেখা দিলেন রাজমহিষী। উত্তেজনা মিশ্রিত মু্গ্ধতায় ক্যামেরায় শাটার টিপতে ভুলে গেলাম। চারপাশে শাটারের শব্দে সম্বিত ফিরল। আমিও কয়েকবার শাটারে চাপ দিলাম। ক্যামেরায় কী ছবি উঠল জানি না, তবে মন ক্যামেরায় যে ছবিটা উঠল, তা সারা জীবন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
এখানে কাজিরাঙার অরণ্য ও বাঘের প্রকৃতি সম্পর্কে দু-চার কথা বলা জরুরি। কাজিরাঙা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য। তাই বছরের সব সময়ই এতে থাকে গাছপালার গভীরতা (density/ঘনত্ব)। ভারতবর্ষের অন্যান্য পর্ণমোচী অরণ্যের মতো বাঘের পায়ের ছাপ দেখে টাইগার ট্র্যাকিং এখানে অসম্ভব। একই সঙ্গে এই জঙ্গলে বাঘের নিজের জন্য শিকারের কোনও অভাব নেই। বরং বলা যায়, সংখ্যা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে হরিণ, বুনো মহিষ, বুনো শুয়োরের উপস্থিতি এখানে চোখে পড়ার মতো। জঙ্গলের গভীরে জলাশয়ও রয়েছে। ফলে, জঙ্গলের ফাঁকা অংশে বাঘের বের হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। জলাশয়ের ধারে বা রাস্তা পেরনোর সময় ভাগ্যের জোরে বাঘ দর্শন হলেও, তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। আমাদের এদিনের সাইটিংও বাঘের এই চরিত্রের প্রমাণ। এত মানুষের সমাগম দেখে বাঘ সোজা পথে রাস্তা না টপকে ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটল। মধ্যে দেখা দিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তবে, তার দর্শনকাল যতই অল্প হোক, মনে একটা তৃপ্তি নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
এই মুহূর্তে অস্তগামী সূর্যের আলো মাখামাখি অরণ্যের শরীর জুড়ে। হঠাৎ মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল। এই মন খারাপটা চেনা। প্রতি সফরের শেষেই এমন মন খারাপটা আমাদের সঙ্গী। না, কাজিরাঙায় আর সূর্য দেখা আমাদের হল না। পরদিন ভোর চারটেয় হোটেল ছেড়ে রওনা হলাম শিলঘাটের দিকে। সেখান থেকে ভোর ছটার ডেমু চেপে গুয়াহাটি। ১২.২০-এর সরাইঘাট এক্সপ্রেস চেপে অসমকে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম কাজের শহর কলকাতায়।
ফেরার পথে কিছু জরুরি তথ্য জানিয়ে যাই।
◾কীভাবে যাবেন ?
যে কোনও ট্রেনে বা প্লেনে গুয়াহাটি গিয়ে, সেখান থেকে গাড়িতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথে পৌঁছে যাওয়া যায় কাজিরাঙা। এছাড়াও সপ্তাহে একদিন (প্রতি সোমবার ) কলকাতা স্টেশন থেকে কাজিরাঙা এক্সপ্রেস ছাড়ে। তাতে চেপে পৌঁছবেন জকলাবন্ধা বা শিলঘাট স্টেশনে। কাজিরাঙার সবচেয়ে কাছের স্টেশন জকলাবন্ধা। কিন্তু এখানে ট্রেন থামে মাত্র দুমিনিট। প্লাটফর্মও খুব নিচু। তাই বাচ্চা বা বয়স্কদের নিয়ে গেলে এই স্টেশনে না নামাই ভাল। ১০-১৫ মিনিটের দূরত্বে অন্তিম স্টেশন শিলঘাটে নামাই শ্রেয়। এই দুই স্টেশন থেকেই সেন্ট্রাল জোনের (এটাই পর্যটকদের থাকার মূল কেন্দ্র) গাড়ির ভাড়া এক।
ফোর সিটারের ভাড়া ২২০০ টাকা। সেভেন সিটারের ভাড়া ৩৫০০ টাকা।
◾সাফারির খরচ–
জন পিছু জঙ্গলের এন্ট্রি ট্যাক্স ১১৫ টাকা।
জিপসি পিছু রোড ট্যাক্স ৩০০ টাকা।
জিপসি পিছু ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি বাবদ খরচ ১০০ টাকা।
স্টিল ক্যামেরার জন্য ১০০ টাকা
মুভি ক্যামেরার জন্য ১০০০ টাকা।
***এই অঙ্কের টাকা প্রত্যেক জোনের এন্ট্রি পয়েন্টে বন দফতরকে অন লাইনে পেমেন্ট করতে হয়। এই সবই দেশি পর্যটকদের জন্য। বিদেশি পর্যটকদের জন্য পৃথক রেট।
◾জিপসির ভাড়া–
সেন্ট্রাল রেঞ্জ ২২০০ টাকা
ওয়েস্টার্ন রেঞ্জ ২৩০০ টাকা
ইস্টার্ন রেঞ্জ ২৭০০ টাকা
বুড়াপাহাড় রেঞ্জ ৩২০০ টাকা
পানবাড়ি রেঞ্জ ১৫০০ টাকা।
***এছাড়াও বোটে ও হাতির পিঠে সাফারির সুযোগ রয়েছে।
◾থাকার জায়গা–
মূলত কোহরা রেঞ্জকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের থাকার জায়গা তৈরি হয়েছে। হোম স্টে, বেসরকারি হোটেলের পাশাপাশি অসম বন দফতরের ‘বনানী’, ‘বনশ্রী’ ও অসম উন্নয়ন নিগমের ‘অরণ্য’ লজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা ছিলাম ‘অরণ্য’-তে। এখানে স্ট্যান্ডার্ড ডাবল বেডরুমের প্রতিদিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা। ডিলাক্স রুমের প্রতিদিনের ভাড়া ১৮০০ টাকা। কটেজের একটি ঘরের একদিনের ভাড়া ২১০০ টাকা। এখানে সবগুলোই এসি রুম। এখানকার খাবারের মানও বেশ ভাল।
◾গাইড কাম ড্রাইভার–
প্রফুল্ল দুয়ারা 8453747343
তকিব আলি 9854900548
এঁদের ছাড়া জঙ্গল সাফারি অসম্ভব ! আর আগাম বুকিং ছাড়া এঁদের পাওয়া কঠিন। তাই সাফারির স্বপ্ন সফল করতে যোগাযোগ আগেই করে রাখুন।
◾ টুকিটাকি–
টুপি, সানগ্লাস, ছাতা সঙ্গে রাখবেন। সূর্য না উঠলেও ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে সানগ্লাস জরুরি। ভোরের সাফারিতে বেরনোর আগে চা-কফি খেতে হলে, তার ব্যবস্থাও রাখবেন। কারণ, অত সকালে হোটেলে চা-কফি পাবেন না। সানস্ক্রিন লোশন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখাও অত্যন্ত জরুরি। (শেষ)
ছবি : লেখক