Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

গড়ে-জঙ্গলে ইতিহাস-পুরাণে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। কলকাতার কাছেই জঙ্গলের মাঝে পল্লবিত ইতিহাস-পুরাণের গল্প। পড়ছেন লিপি চক্রবর্তীর কলমে। প্রকাশিত হলো রচনার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

গত সপ্তাহে দেবী শ্যামারূপা মন্দিরের কথা বলেছি। ইতিহাস ও পুরাণের সেই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার পর আমরা গেলাম মেধস আশ্রমে। মেধস মুনির এই আশ্রমে রাজা সুরথ মিলিত হন বৈশ্য সমাধির সঙ্গে। রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি এইখানে মেধস মুনির কাছে দেবী মাহাত্ম্য শিখেছিলেন। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে রাজা সুরথ বসন্তকালে এখানে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে এটিই বিশ্বের প্রথম দুর্গাপুজো। এটি শক্তিপীঠ। আগে এখানে ষোলটি মন্দির ছিল। এখন সব ক’টির অস্তিত্ব আর নেই। বিশাল আশ্রম চত্বর। মহালক্ষ্মী, মহা সরস্বতী এবং মহাকালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা সুরথ স্বয়ং। একটি দুর্গা মন্দির ও একটি মহা কালভৈরবীর মন্দির আছে। আর আছে এগারো মাথাওলা মাকালীর মন্দির। একটি তেঁতুল গাছ আছে, তার বয়স হবে নাকি চারশো বছর। আশ্রমে ধুনি জ্বলছে সারাক্ষণ। এই ধুনি নাকি সেই মেধস মুনির সময় থেকে কখনও নেভেনি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…!

এখানকার মাটি খুঁড়ে অনেক কিছু পাওয়া গিয়েছে। তার কিছু নমুনা মন্দির চত্বরেই আছে সাজানো। বেশিরভাগই পোড়া মাটির জিনিস। চারদিকের ঘোরতর জঙ্গলের মধ্যে এই শতাব্দী প্রাচীন আশ্রমে দাঁড়িয়ে আমরাও যেন বহু শতাব্দী পিছিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকটা পথ হাঁটলাম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কোথাও আর কেউ নেই আমরা ক’জন ছাড়া। এক বৃদ্ধ বটগাছ ভেদ করে মায়ের যে মন্দির গড়ে উঠেছে, সেখানে শুরু হলো দুপুরের ভোগ আরতি। ক্রমশ পিছিয়ে গেলাম যেন রাজা সুরথের সময়ে। শাঁখ, ঘণ্টাধ্বনি, মন্ত্র উচ্চারণ, মন্দিরের অবস্থান, সব মিলিয়ে মন কেমন যেন অবশ হয়ে গেল ওই ভর দুপুরে।

রিসর্টে ফিরে বিকেলবেলায় সেই অমোঘ টান চায়ের দোকানে। আজ জঙ্গলের গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেক ময়ূর। তারা খাবার খুঁটছে আর এদিক ওদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। গোটা তিনেক বেশ অবাধ্য প্রকৃতির। তারা অল্প উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাহারাদার জালের ওপর। চায়ের দোকানের ভদ্রলোক বললেন, ‘জাল দিয়েছে মাস দুয়েক হল। নয়তো ওরা বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তায় ঘুরতে থাকতো। বদমাশ লোকের তো অভাব নেই…’। গড় জঙ্গলের বাড়তি আকর্ষণ অবশ্যই এই চায়ের দোকান আর দোকানির পরিবার। যেন কত আপন, কত দিনের চেনা !

পরদিন আমাদের রিসর্টের ভিতরেই থাকা আর বিশ্রাম নেওয়ার কথা ছিল। ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়ে কামরাঙা পেড়ে খেয়েছি। অদ্ভুত মিষ্টি। কামরাঙাও যে মিষ্টি হতে পারে জানতামই না। তেঁতুল পেড়েও খেয়েছি, কাঁচা। সেই যেন ছোটবেলা ফিরে এসেছিল। প্ল্যান অবশ্য বদলে যায় একটু পরেই। সেই অটো চালক হাজির সক্কাল সক্কাল। এসেই বলল, “ওপারেই জয়দেবের কেঁদুলি। চলুন ঘুরে আসি। আপনাদের ভালো লাগবে। দুপুরে খাওয়ার আগেই ফিরে আসব।” অতএব…! এবার রাস্তা আরও মজার। অজয় নদের ওপর ভাসা ব্রিজে পার হলাম। ওপারে গিয়ে প্রথমেই গেলাম কবি জয়দেবের মন্দিরে। যেখানে এসে দেবতা নিজেই কবির ভার লঘু করে নিজের হাতে লিখেছিলেন মহাকাব্যের সেই অমোঘ পংক্তি ক’টি–’স্মরগরল খণ্ডনং/ মম শিরসি মণ্ডলম/ দেহি পদপল্লম মুদারম’। এরপর কবি জয়দেবের আরাধ্য দেবতার মন্দিরে পৌঁছলাম। এই মন্দির প্রাঙ্গণ ঘিরেই প্রতি বছর বিখ্যাত জয়দেবের মেলা বসে। ভক্তিরসে নিমজ্জিত হওয়া বা না হওয়া ব্যক্তিগত ভাবনার কথা, যেটা পৃথক হতেই পারে। তবে, আমরা মনে এক অনাবিল আনন্দের অনুভব নিয়ে ফিরে এলাম দেউল পার্ক রিসর্টে।

◾এবার কিছু জরুরি তথ্য–

কাছাকাছি রেলস্টেশন দুর্গাপুর। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে অথবা বাসে মুচিপাড়া এসে, ওখান থেকে অটো বা ট্রেকারে পৌঁছনো যায় গড় জঙ্গলের দেউল পার্ক রিসর্ট। গাড়িতে সরাসরি আসাও সম্ভব। কলকাতা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা মতো সময় লাগে। থাকার জায়গাটি বুকিং করতে সরাসরি ইন্টারনেটে সাহায্য নেওয়া যায়। বিস্তারিত দেওয়া আছে। থাকা ও খাওয়ার খরচ একদম সাধ্যের মধ্যে।