শিল্পরসিক দর্শকের নজর কেড়ে নিল ‘পরমা ২০২৩’
কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকার নিকটবর্তী ‘শ্রী অরবিন্দ ইনস্টিটিউট অব কালচার’-এর প্রাঙ্গণে ‘গ্যালারি লা মেয়ার’-এর প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত জয়া মিত্র। পণ্ডিচেরি আশ্রমে গিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে শ্রীমা-র আশীর্বাদধন্যা হন এবং শ্রীমা ও ফ্রান্সের নাগরিক (পরবর্তীতে ভারতেরও নাগরিক) র্যাচেল মীরা আলফাসার শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গড়ে তোলেন ‘গ্যালারি লা মেয়ার’। গর্বের কথা, সারা বিশ্ব যেখানে তাঁর জন্য আসন পেতে রেখেছে, সেক্ষেত্রে তিনি একমাত্র এই একটি জায়গাকেই বলেছেন ‘মাই হোম’!
গ্যালারির মূল কর্ণধার শ্রীলেখা মজুমদারের দায়িত্বে বছরে চারটি প্রদর্শনী হয় নিয়মিতভাবে, বিভিন্ন নামকরণে। গত ১২ মে থেকে ১১ জুন ২৭জন মহিলা শিল্পীকে নিয়ে ‘পরমা ২০২৩’ শিরোনামে এক অভিনব প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল–যথাক্রমে ৩ নং রিজেন্ট পার্কের লক্ষীভবন এবং বারুইপুরের ‘অমর্ত্য’ নিবাসের প্রশস্ত কক্ষে। এই প্রদর্শনীতে ছিল, শিল্পজগতে সুপরিচিত বিশিষ্ট মহিলা শিল্পীদের বিবিধ শিল্পকর্ম। গ্যালারির গর্ভগৃহে আমন্ত্রিত অতিথি এবং দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। খুব বিস্তৃত আকারে আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। তাই শিল্পীদের কাজের নমুনা থেকে বাছাই কয়েকটির বিষয়ে কথা বলব আজ।
গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজের ভারতীয় ঘরানার স্নাতক শিল্পী স্তুতি লাহার ছবির নাম,’সংকীর্তন’। তাঁর অধ্যয়নের পরিধিতে ছিল ফ্রেস্কো, রাজস্থানী শৈলি ও মিনিয়েচার ভিত্তিক বিভিন্ন আদিবাসীর রূপ। তবে ওয়াশ পেইণ্টিং-এর বেঙ্গল স্টাইলের ( অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, ক্ষিতিশচন্দ্র মজুমদার সৃষ্ট) প্রতি শিল্পী আকৃষ্ট হয়ে কিছু পরিবর্তন করেন, যাতে রচনার শেষ টান দেবার পরও ভারতীয় রাগের মতো স্থায়ী রেশ রেখে যাতে পারেন। ছন্দা সিং একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। যদিও এই কথাটায় ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি আছে। কারণ কোনও না কোনও মাস্টার মাথার ওপর থাকেনই কমবেশি, সেটাও কম পাওয়া নয়। তাঁর বা তাঁদের নামের উল্লেখ করা অবশ্য কর্তব্য। যাই হোক, ফিরে আসি শিল্পী ছন্দার ‘রিদম অব নেচার’ নিয়ে। শিল্পী বিশ্বাস করেন, নিজের বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টায় শিল্পের কোনও নিশ্চিতকরণের প্রয়োজন নেই। তিনি স্বাধীনভাবে বস্তুজগতকে নিজস্ব ছন্দে নিয়ে গেছেন।
জোড়াসাঁকো রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী পিয়ালী গাঙ্গুলির নিবেদনে ছিল ‘পার্সেপশান অব রিয়্যালিটি’। মাধ্যম, ক্যানভাসের ওপর অ্যাক্রিলিক। বর্তমান সমাজের খুন-খারাপির ভয়াবহ অবস্থায় আতংকিত এক বৃদ্ধা নারী। যদিও সুখ-দুঃখে মেশানো তাঁর ফেলে আসা জীবনে এই আতংক ছিল না। অসহনীয় মানসিক অবস্থার শিকার তিনি আজ। মেলাতে পারেন না। সেই অভিব্যক্তি নিয়েই শিল্পীর কাজ, অনেকটা স্কেচি স্টাইলে। কলাভবনের প্রাক্তনী সুতপা খানের কাজ ‘পন্ডি’ সিরিজে, বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চকিত রঙের অবাধ গতি মন্দ লাগে না।
আর্ট কলেজের প্রচলিত দক্ষতা আয়ত্ত করে, শিল্পী হিসেবে রূপা রাজবংশীর যাত্রা শুরু হলেও, জীবনের রূঢ় বাস্তব শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে পিছিয়ে দেয়। বর্তমানে স্বীয় অস্তিত্বকে নির্ণয় করার জেদে রূপা পুনরায় ছবি আঁকার তাগিদ অনুভব করেন। ছবির শিরোনাম, ‘জার্নি’, মাধ্যম ফেব্রিক কোলাজ। টেক্সটাইল এবং পুরনো রঙিন কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে সীমাহীন বিশ্ব তৈরিতে নিজেকে নিযুক্ত করেন। আজকের ভঙ্গুরতার মধ্যেও একটি নতুন পদক্ষেপের প্রচেষ্টায় উঠে এসেছে জ্যামিতিক ছকের ইমারতের পরিকাঠামো। আকাশের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার ছটায় সাহস মিলেছে রঙিন পাখির আসা-যাওয়া। শিল্পীর কোলাজটি বাস্তবিকই অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
শিল্পী পপি ব্যানার্জির (গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজ) রচনা-বৈশিষ্ট্যর মূল হাতিয়ার মাটির শিকড়ের অন্তর্নিহিত ভাষাকে, মানবসত্তার বিভিন্ন প্রকাশে ফুটিয়ে তোলা। শিল্পীর ‘অ্যাফেকশন’ ছবিতে, ক্যানভাসের পশ্চাৎ পটভূমি রচিত হয়েছে শিকড়ের আবছা আলংকারিক ইশারায়। শিকড়-প্রকৃতির ফর্ম ও বর্ণের সৌন্দর্য ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে প্রেমীযুগলের মিলনের মূর্ছনায়। মৌলিক উদ্ভিদজাত প্রাণবিন্দু নিয়ে এরকম ব্যতিক্রমী কাজ সচরাচর দেখা যায় না। ‘সিরিন’ ছবিতে ড্রাই প্যাস্টেলের নির্মল পরিসরের নজির রাখলেন শিল্পী পম্পা দাস। একফালি আকাশের নিচে সাদা, গোলাপি জাতীয় ফুলের প্রতিস্থাপনের মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে চলেছে সবুজ-হলুদের নিশ্চিত আরাম।
জোড়াসাঁকো রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত তমালী দাশগুপ্তর রচনা-প্রকরণ গভীর বোধের সাহারায় ঊর্ধ্বগামী হয়। মিশ্র মাধ্যমে করা ‘দ্য কনগ্রিগেশন’ বা জনসমবায়, গড্ডালিকা প্রবাহে চলার ছবি। সমমনস্ক হয়ে যে সবাই জমায়েত বা চলা-বসা শুরু করেছে, তা নয়। একটি অভ্যাসের ছবি। তমালী দাশগুপ্তর প্রায় মনোক্রমিক রঙে রিসাইকল কম্পোজিশনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফর্মে অজস্র মানুষের একত্রীকরণ করেছেন। মাঝে রিলিফের মতো এসেছে সাদার ব্যবহার, যা অনেকটা ইতিবাচক দিশা দেখায়। ভালো লাগে অনীতা দত্তর (ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ) আজকের সমাজের চালচিত্র ‘দ্য রাইজিং সান’।
অর্পিতা বসুর ‘লিলি পণ্ড’ বেশ মনোরম। কৃষ্ণা ব্যানার্জির ছবিতে ফুটে ওঠে চিচিংগা প্যাঁচের মতো অবরুদ্ধ জীবন। ব্রোঞ্জের ওপর ‘নেচার ২’-এ রিয়া ঘোষের ভাবনায় গাছের আকার ধরা পড়লেও, পঙ্কিল জীবনের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। রূপালী রায়ের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য ‘স্কার’-এ একটি মানুষের দু পায়ের দুরকম ভাষ্য থেকে বেরিয়ে আসে–মোহ, মায়া, অর্থবহ জীবন। যা অনিবার্যভাবে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। স্বনামধন্য ভাস্কর বনশ্রী খানের ব্রোঞ্জ নির্মিত ‘ফেজ’ একটি লড়াইয়ের গল্প।
গ্যালারির অন্যতম যে ভালো লাগার সৃষ্টির দিকে বারবার চোখ চলে যায়, এবং দর্শকের ভিড়ও বাড়তে থাকে, সেটি হলো অনবদ্য আলংকারিক পরিবেশের রচয়িতা সর্বাণী গাঙ্গুলির সাম্প্রতিক ছবি পরমা’! সোহিনি ধরের ‘হুইসপারিং’ মনোক্রমের স্মার্ট ব্রাশের পরিচায়ক। কৌতূহল বাড়ায় পাঁপড়ি ঘোষের মিশ্র-মাধ্যমে বিষয়-বৈভব নিয়ে তৈরি ‘ইনটিরিওর’ ছবিটি। ঊনবিংশ শতাব্দীর নগর অট্টালিকার আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ে কম্পোজিশনে। অতীত থেকে শিল্পী বেরিয়ে যেতে চান না। তখন ঘরের মধ্যেই ছিল নিবিড় আলাপনের সহবাস। সেই জায়গা ভরেও তুলেছেন অ্যান্টিক ফার্নিচারের ড্রইং দিয়ে। এককথায় বলা চলে শিল্পী পাঁপড়ি ঘোষের ‘ড্রিম হাউস’।
প্রদর্শনীতে বর্ণালী রায়ের প্রিন্ট মেকিং-এর এচিং গুলি ছিল (১,২,৩,৪) নিপুণ অধ্যয়নের পরাকাষ্ঠা। শিল্পীর কথায় ছবির মধ্যে সৃষ্টিই হচ্ছে সার কথা। সেটি উপলব্ধি করা যায় কতটা পরিশ্রম ও যত্ন নিলে এরকম ‘ক্রিয়েশন’ হতে পারে! তিনটি স্তরে বিভাজিত ক্রিয়েশন–বিশেষত ১ এবং ৪, ব্যাঙের ছাতার প্রতীকের ব্রিলিয়ান্ট উপস্থাপন। ফলত, শিল্পী বর্ণালী রায়ের ছাপাই কাজ দেখার আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।