অপরূপ রিশপ
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। উত্তরবঙ্গের ছোট্ট গ্রাম, ছবির মতো সুন্দর রিশপ নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই বুঝলাম, আজ কপালে দুঃখ আছে। ধূসর আর কালো রঙে মেশানো মেঘের বিষাদমাখা এক আস্তরণে ঢেকে গেছে আকাশ। মনে পড়ছিল, অফিসের সহকর্মীদের সাবধানবাণী, এই বর্ষায় পাহাড়ে চললে ? যদিও তাঁরা সকলেই জানেন, বর্ষার ভয় দেখিয়ে আমার পাহাড়ে যাওয়া আটকানো যায় না। ক্যালেন্ডারে ছুটির তারিখ নজরে এলেই আমার মন উড়ু উড়ু। পায়ের গতি উত্তরবঙ্গগামী। অতএব, এবারও…! এবারের গন্তব্য রিশপ। কালিম্পং জেলার ছোট্ট এই গ্রাম এখন অবশ্য পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আমি যখন যাই, তখনও অত ভিড় হতো না সেখানে। নিরালা, নির্জন পাহাড়ী সৌন্দর্য দু চোখ ভরে দেখেছিলাম বর্ষার ক্যানভাসে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছি, বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে। মাঝে পথের ধারের দোকানে কফি আর মোমো ভক্ষণ সেরেছি। কালিম্পং শহর ছাড়িয়ে লাভার রাস্তা ধরেছে আমাদের গাড়ি। বৃষ্টি নেমেছে মহা সমারোহে। বাদলা হাওয়া ঝাপটা মারছে গাড়ির কাঁচে। রিশপ পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে গেল। একে তো বৃষ্টির জন্য গাড়ির গতি ছিল ধীর। তারমধ্যে লাভা থেকে রিশপের রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম। যে কারণে, লাভায় গাড়ি পাল্টাতে হলো। বড় বড় বোল্ডারে তৈরি রাস্তার পুরোটাই ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে হয়। অবশেষে পৌঁছলাম যেখানে আমার থাকার কথা, সেই হোমস্টে-তে। সামান্য ছড়ানো ছোট্ট নীল টিনের বাড়িটা দেখে মন ভালো হয়ে গেল আমার। চারপাশের উঁচু-নিচু পাহাড় ও সবুজ জঙ্গলের মাঝে দ্বীপের মতো যেন ভেসে আছে বাড়িটি।
হোমস্টে-তে কর্মরত একটি তরুণ এসে আমার ব্যাগ ইত্যাদি নির্ধারিত ঘরে পৌঁছে দিয়ে জানাল, এক্ষুনি গরম জল দিয়ে যাচ্ছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। লাঞ্চ রেডি। ততক্ষণে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। কোনও রকমে স্নান সেরে বেশ একপ্রস্থ গরম পোশাক জড়িয়ে পাশের ডাইনিং রুমে গেলাম। কিচেন গায়ে লাগোয়া। গরম গরম খাবার তৈরি হয়ে টেবিলে চলে আসছে। খিদের মুখে সাদামাটা ডাল-ভাত, অমলেট, আলুভাজা, সবজি, আঁচার সহযোগে অমৃত মনে হলো। উত্তরবঙ্গের পাহাড় এলাকায় খাবারদাবারের ক্ষেত্রে খুব বেশি বৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব হয় না, বরাবর দেখেছি। কিন্তু যেটা খুব বেশিমাত্রায় ভালো লাগে, আয়োজন যেটাই হোক, তা ফ্রেশ এবং গরম গরম পরিবেশন করেন এখানকার মানুষ। পরিচ্ছন্ন ও আন্তরিকতা ঢেকে দেয় সব অভাব।
ক্লান্তির ঘুম নামছিল চোখে। হিমেল বাতাস কাঁপন ধরাচ্ছিল। অতএব কম্বলের আশ্রয় এবং এই অবকাশেই কিছু তথ্য জানানো যাক পাঠককে। কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পাহাড়ী এই গ্রাম এককথায় পটে আঁকা এক ছবি যেন ! সব ঋতুতেই নয়ন-মনোহর সে। পাইনের ঘেরাটোপে রডোডেনড্রনের অপূর্ব মায়ায় এবং বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার অহংকারী উদ্ভাসে রিশপ অতুলনীয়। প্রসঙ্গত, রিশপ নামের সঙ্গে জড়িয়ে যে প্রাচীন তত্ত্ব, সেটি হলো, ‘রি’ অর্থ পর্বতশৃঙ্গের চূড়া, ‘শপ’ হলো দশকের পর দশক দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন বৃক্ষরাজি।
কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তৃত এক ভিউ মেলে এখানে, যা নিঃসন্দেহে পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রে। রিশপের টিফিনদারা ভিউ পয়েন্ট থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। টিফিনদারা থেকেই মেলে নাথুলা ও জেলেপ লা-র অনির্বচনীয় সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতা। এছাড়াও রিশপ থেকে দেখা যায় আরও কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ–খড়্গ, কোকথাং, রাথুং, কাবরু, তালুং, পান্ডিম, সিম্বো, নার্সিং ও সিনলোচু। বলা বাহুল্য, এই সবটাই সম্ভব, ভাগ্য সহায়, থুড়ি, আকাশ পরিষ্কার থাকলে–যেটা কিনা আমার ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে না বললেই চলে। রিশপেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন হলো না। এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে হোমস্টে-র সীমানার এক প্রান্তে তৈরি ভারি মনোরম একটি ভিউ পয়েন্টে। আমি আসার আগে থেকেই একটি ট্যুরিস্ট পরিবার এখানে ছিল। তাঁদেরই একজন, একটু বয়স্ক একজন মহিলা জানালেন, ওঁরা যেদিন এলেন, সেদিনই নাকি এই ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অভূতপূর্ব দর্শন পেয়েছেন। কথায় কথায় জমে উঠল আলাপ।
গতকাল রাতে হাতে গড়া রুটি আর চিকেনের দুর্দান্ত একটা প্রিপারেশন দিয়ে ডিনার সেরেছি। সঙ্গে ছিল স্যালাড। আজ ব্রেকফাস্টে আমার অনুরোধে হোমস্টে-র তরুণ কর্মীদের একজন ওয়াই-ওয়াই বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে ওয়াই-ওয়াইয়ের বিকল্প নেই। দুপুরে লাঞ্চ করলাম ওই পরিবারটির সঙ্গেই। আজ নিরামিষ। তাতে কী, আয়োজনে ত্রুটি ছিল না। স্কোয়াশের সুস্বাদু একটি তরকারি চেটেপুটে খেলাম সকলেই। লাঞ্চ টেবিলেই জানতে পারলাম, ওঁরা কালই বিদায় নেবেন। তাহলে কী কাল থেকে আমি একা ? ভুল ভাঙিয়ে হোমস্টে কর্মী জানায়, সাত আটজন পুরুষের একটি বড় দল আসবে। এরা বিভিন্ন বয়সের, বন্ধু নয়, অফিসকর্মী।
লাঞ্চের পর নিজেকে বললাম, আজ আর ঘুম নয়। ভিউ পয়েন্টের ছোট্ট বসার জায়গাটা টানছিল। আজ আবহাওয়া তুলনায় ভালো। চারদিক মোটামুটি চুপচাপ। মাঝে মাঝে নির্জনতা ভঙ্গ করছিল পাখিদের কিচিরমিচির। শুনেছিলাম, পক্ষীপ্রেমীরা সুযোগ পেলেই চলে আসেন এখানে। এছাড়াও ট্রেকিংয়ে আগ্রহী মানুষজনের জন্যও দারুণ উপযোগী রিশপ। গ্রামের ভিতরে চলাচলের রাস্তা এমন, ঘুরে বেড়াতে চাইলেও, সেটা ট্রেকিংয়ের মাধ্যমেই সম্ভব। প্রাচীন গাছের দল মায়াবী শাখা-প্রশাখা মেলে খাড়া দাঁড়িয়ে। ফুল ও অর্কিডের শোভাও চোখ টেনে নেয়। অন্যদিকে রয়েছে পাহাড়-জঙ্গল-ঝর্না-নদী। সব মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে চূড়ান্ত বৈভবময়।
রিশপের উচ্চতা ৮৫০০ ফুট। শান্ত, নির্জন পরিবেশ। গ্রামের জীবন মূলত কৃষিনির্ভর। কাছাকাছি যাওয়ার মধ্যে রয়েছে লাভা, লোলেগাঁও, পেডং ও ঋষিখোলা (নদী)। একটা সময় রিশপ ছিল লেপচা গ্রাম। এখন অন্যান্য উপজাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করেন। কালিম্পং শহর থেকে এর দূরত্ব ৩২ কিমি, লাভা অবস্থিত ৯ কিমি দুরত্বে। আপার, মিডল ও লোয়ার–এই তিন ভাগে বিন্যস্ত গ্রামটি। দূরে দূরে ছোট ছোট বাড়িগুলি যেন প্রকৃতির নান্দনিক মায়ায় লুকোনো। সামান্য চলাচলের মাধ্যমে আমিও সেই রূপসুধা পান করলাম কিছুক্ষণ। সূর্য ডুবছে। সন্ধ্যা নামছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। সেই অপূর্ব নৈসর্গিক ছবি চোখে নিয়ে ঘরে ফিরি। অতঃপর কিছুক্ষণ বই পড়া, তারপর ডিনার ও ঘুম।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করি পুরি ও সবজি সহযোগে। পাশের ঘরের পরিবারটিও ছিল। শুনলাম একটু পরেই ওরা রওনা দেবেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন অভিমুখে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসময় চলে যায় পরিবারটি। চারদিক সুনসান। আমি একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। বর্ষাপ্রকৃতি কী অপরূপ মায়া বিস্তার করেছে হোমস্টে-র সর্বত্র ! মগ্ন হয়ে যাই তার মাঝে। এরই মধ্যে ছেলেদের দলটি প্রবেশ করে। বয়সের রেঞ্জ ২৫-৪৫ ! গাড়ি থেকে পেটি পেটি মদের বোতল নামার বহর দেখেই বুঝলাম, শান্ত, নির্জন রিশপ ছন্দ হারাবে, যতক্ষণ এই দলটি থাকবে। হলোও তাই। নিজেদের থাকার ঘর তো বটেই, পুরো উঠোন, ডাইনিং রুম দখল করে নিল ওরা। গালিগালাজ, মাতলামি চরমে উঠল। শেষে হোমস্টে কর্মীদের একজন এসে বলল, ম্যাডাম আপনার ডিনার ঘরেই দিয়ে যাচ্ছি। আপনি প্লিজ বাইরে বের হবেন না। পাহাড়ে এর আগেও একবার এহেন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। চেষ্টা করেছি, সেসব ভুলে, প্রকৃতির অনির্বচনীয়তাকে স্মৃতির ঝুলিতে পুরেই ঘরে ফেরার। এবারও সেভাবেই…!
একসময় সেই ফেরার পালা এসে যায়। ভুলব না এখানকার অনাবিল প্রকৃতি আর হোমস্টে-র তরুণ কর্মীদুটির আন্তরিক আতিথেয়তা। যেতে যেতে কিছু জরুরি তথ্য। যে হোমস্টে-তে আমি ছিলাম, এই প্রতিবেদন লেখার আগে, তার কর্ণধার অনুপমকে সাম্প্রতিক তথ্যাদি জানার জন্য ফোন করতেই তিনি জানান, সেই পুরোনো বাড়িটি এখন আর নেই, রেনোভেশনের কাজ চলছে। একটু মন খারাপ হলো। ফোনের ওপারে অনুপম সম্ভবত আমার ভাবনা বুঝেই বলে ওঠেন, আপার রিশপে আমাদের নতুন হোমস্টে লাভলি হোমস্টে। পর্যটকরা এসে এখন এখানেই থাকছেন। আপনিও আসুন একবার। চারপাশের ভিউ খুবই সুন্দর। জানা গেল, এখানে রয়েছে মোট ৬ খানা ঘর। ঘরগুলি হলো–২টি ডাবল, ২টি ট্রিপল ও ২টি ফোর বেডরুম। থাকার খরচ–ডাবল বেড ১৩০০ টাকা, ট্রিপল বেড ১৬০০ টাকা, ফোর বেড ১৮০০/২০০০ টাকা। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার–দিন প্রতি জন প্রতি ৬৫০ টাকা। ভাত, রুটি, পুরি, ডাল, সবজি, ভাজি, ডিম, চিকেন ইত্যাদি আইটেম পাওয়া যায়।
হোমস্টে-র সীমানার মধ্যেই ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। বন ফায়ারের বন্দোবস্তও করে দেন ওঁরা। এছাড়া সাইট সিয়িং ও জঙ্গলে ঘোরার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় এখানে। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল, যে কোনও সময় যেতে পারেন রিশপ। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ সবচেয়ে ভালো পাবেন অক্টোবর থেকে জানুয়ারি। আমি কালিম্পং ও লাভা হয়ে গেছিলাম। এঁরা গরুবাথান হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন, তাতে সময় কম লাগে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রিশপ পৌঁছতে এই পথে লাগে ঘণ্টা চারেক। গাড়িভাড়া–ছোট গাড়ি ৪০০০ টাকা ও বড় গাড়ি ৪৫০০ টাকা। সাইট সিইংয়ের খরচ আলাদা। যোগাযোগ : 98360 87652