পুজোর ছুটিতে হরির দুয়ারে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। আজ হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেরাদুন, মুসৌরি দর্শনের না ভোলা অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
তখন প্রতিবছর পুজোর ছুটিতে দিন সাতেকের ছুটিতে বেড়াতে যেতাম আত্মীয়বন্ধু মিলে। সেবার আমাদের গন্তব্য ছিল হরিদ্বার। হরিদ্বার হলো গঙ্গার সমতলে অবতরণস্থল। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর পুণ্যার্থীর ভিড় থাকে সারা বছর। এখান থেকেই চারধাম যাত্রাও শুরু হয়। বলা বাহুল্য, পুজোর ছুটিতে ভিড়টা মারাত্মক আকার ধারণ করে। একই সঙ্গে পুজোর সময় ট্রেনের টিকিটেরও প্রায় হাহাকার অবস্থা দাঁড়ায়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা অমৃতসর মেলের টিকিট পেলাম। এটা জানাই ছিল, এই ট্রেন অনেকটা সময় নেবে নাজিবাবাদ পর্যন্ত পৌঁছতে। সেখান থেকে আবার বাসে করে হরিদ্বার। কিন্তু যাওয়া যখন ঠিক করেছি, তখন আর অন্য কিছু ভাববার অবকাশ ছিল না।
হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু। ট্রেন নাজিবাবাদ পৌছল রাত দেড়টার সময়। ট্রেন থেকে নেমেই বেশ ঠান্ডা অনুভূত হলো। কিছু হালকা খাবার খেয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে হরিদ্বার যাওয়ার বাসে উঠে বসলাম। ভারত সেবাশ্রমে থাকার জন্য এখানকার স্বামীজি স্বামী বিশ্মাত্মানন্দ চিঠি করে দিয়েছিলেন, ফোনে বলেও দিয়েছিলেন। ভারত সেবাশ্রম সংঘের কাছে যখন বাস থেকে নামলাম, তখন রাত সাড়ে তিনটে। রিসেপশনে আমাদের বুকিংয়ের কথা জানানো হলেও, সেখানকার কর্মীরা আমাদের নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অগত্যা ওখানকার দায়িত্বে থাকা স্বামী অভয়ানন্দকে ফোন করলাম। অত রাত হওয়া সত্বেও ফোন পেয়েই স্বামীজি চলে এলেন এবং আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ঘরটি পছন্দ না হওয়ায় আমরা পরদিন ভোর হলে অন্য হোটেল খোঁজার পরিকল্পনা করেছি জানতে পেরে, স্বামীজি আবার উদ্যোগী হয়ে আমাদের জন্য অন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। এবার বেশ পছন্দ হলো ঘরটি। এই আন্তরিক পরিষেবা সত্যিই কুর্নিশযোগ্য। কেন ভারত সেবাশ্রম সংঘ এত বছর ধরে মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধায় বসবাস করে, বুঝলাম।
দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার ধকলের জন্য সবাই ভোর হওয়ার আগেই স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ভারত সেবাশ্রম সংঘের বাইরেই ছিল একটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবারের দোকান। সেখানে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা প্রথমেই গেলাম ‘হর কী পৌরী’র ঘাটে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের থেকে ‘হর কী পৌরী’র ঘাট একটু দূরে। তাই টাঙায় করে যেতে হলো। রাস্তার দু ধারে সারি সারি দোকান। ভেসে আসছে শিবস্তুতির গান। পরিবেশটাই মন ভালো করে দেয়। যেতে যেতে দেখলাম প্রবল স্রোতস্বিনী গঙ্গাকে। স্রোতে ভেসে যাওয়ার ভয়ে অনেকে শিকল ধরে গঙ্গায় ডুব দিচ্ছিলেন।
ঘাটে পৌঁছে আমরা দিনের বেলাতেই গঙ্গায় প্রদীপ ভাসালাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে আশ্রমে ফিরলাম। দুপুরে বিশ্রামের পর আরতি দেখার জন্য সন্ধ্যার আগে আবার গেলাম ‘হর কী পৌরী’র ঘাটে। আমরা যাওয়ার আগেই সেখানে আরতি দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। আমরা কোনওরকমে ঘাটের সিঁড়িতে একটা জায়গা করে বসলাম। ঠিক ছ’টার সময় মা গঙ্গার মূর্তি ঘাটের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো চতুর্দোলায় করে। মাইকে ‘গঙ্গা মাইয়া কী জয়’ বলে জয়ধ্বনি দিয়ে শুরু হল ‘ওম জয় গঙ্গে মাতা’ গান। হাজার কণ্ঠ সেই সুরে সুর মেলাতে লাগল। সঙ্গে কাসর, ঘণ্টা বাজনার সঙ্গে বড় বড় প্রদীপ নিয়ে পুরোহিতরা আরতি শুরু করলেন। সত্যিই এক স্বর্গীয় পরিবেশ। দেখলাম, অনেকেই গঙ্গায় প্রদীপ ভাসাচ্ছেন।
আরতি দেখার পর আশপাশের সব কিছু ভালো করে দেখে, আমরা আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানে ফিরলাম। রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাইরের হোটেলে খেয়ে এলাম। অতঃপর ঘুমের দেশে। পরদিন সকালে একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলাম কাছাকাছি জায়গাগুলি দেখার জন্য। প্রথমেই মা আনন্দময়ীর আশ্রম–নিরিবিলি শান্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মন আপনা থেকেই শান্ত হয়ে যায়। সেখানে রুদ্রাক্ষ গাছ থেকে পড়া রুদ্রাক্ষও পেলাম একটা। মন্দিরে প্রণাম সেরে গেলাম কংখল। সেখানে আছে দক্ষেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের বাঁধানো চত্বরে আছে পিঁপুল ও অশ্বত্থ গাছে। চারপাশে বেদি করা। আর মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এই পরিবেশও বেশ শান্ত ও সমাহিত।
এরপরের গন্তব্য ছিল সপ্তর্ষি আশ্রম। হরিদ্বারের বিখ্যাত আশ্রম এটি। এখানকার পরিবেশ প্রাণায়ামের জন্য একেবারে আদর্শ। পুরাণ মতে কাশ্যপ, বশিষ্ঠ, অত্রি, বিশ্বামিত্র, যমদাগ্নি, ভরদ্বাজ এবং গৌতম এই সাতজন ঋষির যাতে জলের শব্দে ধ্যান করতে অসুবিধা না হয়, তাই দেবী গঙ্গা সাতভাগে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হন এখানে। এই কারণে একে সপ্ত সরোবর বা সপ্ত ঋষিকুন্ড নামেও ডাকা হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে গেলাম পতঞ্জলি। এটি হলো বাবা রামদেবের আশ্রম। বিরাট জায়গা জুড়ে এক কর্মযজ্ঞ বলা যায়। এক জায়গায় চলছিল যোগাসনের প্রশিক্ষণ। বহু মানুষ একসঙ্গে বসে যোগচর্চা করছিলেন। একটি স্টলে বিক্রি হচ্ছিল এখানকার তৈরি আয়ুর্বেদিক সাবান, শ্যাম্পু, মোরব্বা ও নানা কিছু। আমরাও কিছু কিছু জিনিস কিনলাম। এরপর আশ্রমে ফিরলাম।
পরদিন সকালে ফের গেলাম ‘হর কী পৌরী’ ঘাটের কাছে। দোকান থেকে গঙ্গা-আরতির দু-চারটে সিডি ও টুকটাক জিনিস কিনলাম। কিন্তু গঙ্গার এ কী রূপ! জল যে একেবারে তলানিতে। দুর্গা নবমীতে যে জল দেখে রীতিমতো ভয় লাগছিল, এদিন সেই তুলনায় নামমাত্র জল। কারণ জানালেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। তিনি জানালেন, প্রতি বছর হরিদ্বারের ঘাটগুলো এবং জল পরিষ্কার করার জন্য বিজয়া দশমী থেকে দীপাবলির আগের দিন পর্যন্ত গঙ্গার জল বন্ধ রাখা হয়। ওই সময়ে তীর্থযাত্রীরা যে কয়েন বা অন্যান্য সামগ্রী গঙ্গায় উৎসর্গ করেন, গরীব লোকজন সেসব সংগ্রহ করে নিজেদের কিছু অর্থের সংস্থান করেন। এরপর আমরা রোপওয়ের টিকিট কেটে চণ্ডী ও মনসা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অনেকেই ওই পথ ট্রেক করে যান। কিন্তু আমাদের সঙ্গে বয়স্ক ব্যক্তি থাকার জন্য রোপওয়ে করেই গেলাম। ওপর থেকে হরিদ্বার ও গঙ্গাকে অপূর্ব দেখতে লাগছিল। মনসা মন্দিরে আমরা পুজো দিলাম। চণ্ডী পাহাড়ের উচ্চতা তুলনায় কম। তবে মন্দির চত্বরটা খুব সুন্দর। সেদিনের মতো বাইরে ঘোরাঘুরির ইতি। সন্ধ্যাবেলা ভারত সেবাশ্রমের আরতি দেখে কেটে গেল।
হরিদ্বার গিয়ে হৃষিকেশ না গেলে যে অনেক কিছু না দেখা থেকে যাবে। তাই একদিন গেলাম পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই শহর দেখতে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ বলা যায় লক্ষণঝুলা ও রামঝুলা। গঙ্গার থেকে ৭০ ফিট ওপরে ৪৫০ মিটার লম্বা ঝুলন্ত সেতু। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময় এই সেতু নড়তে থাকে। এখানে দেখলাম তের মঞ্জিল মন্দির বা ত্রম্বকেশ্বর মন্দির, ভারত মন্দির, নীলকন্ঠ মহাদেব মন্দির সহ নানা মন্দির। দেখতে দেখতে কমে আসছে ছুটির দিন। তাই পরের দিনই গেলাম দেরাদুন। উত্তরাখন্ডের রাজধানী শহর শুধু ধানের গবেষণাগারের জন্য নয়, দুন স্কুলের জন্যও বিখ্যাত। দেরাদুনের কাছেই বিষ্ণু মন্দির দেখে চললাম পাহাড়ের রানি মুসৌরি দর্শনের জন্য।
হিমালয়ের শিবালিক রেঞ্জ এবং দুন উপত্যকার মাঝে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ী শহর মুসৌরি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০০ ফুট ওপরে মুসৌরির মূল আকর্ষণ হলো কেম্পটি ফলস। তাকে দেখার তীব্র আগ্রহ নিয়ে আমরা পাকদণ্ডী বেয়ে চলেছি তো চলেছি! মাঝে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চা খেলাম। স্থানীয় লোকেরা ওখানকার পোশাক পরিয়ে ছবিও তুলল। বেশ ভালই লাগছিল। এরপর পৌঁছলাম কেম্পটি ফলসের কাছে। ১০০ ফুট উচ্চতা থেকে প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসছে জলধারা। কী তার গর্জন–তেমনই ভয়ঙ্কর রূপ ! একরাশ ভালো লাগা নিয়ে ফিরলাম সেখান থেকে।
পরদিন ছিল লক্ষ্মী পুজো। আমরা সেদিন আর বাইরে কোথাও যাইনি। ‘হর কী পৌরী’র কাছের দোকান থেকে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য কিছু শীতের পোশাক ও দেবী গঙ্গার মূর্তি কিনলাম। ঘরে ফিরে গোছগাছ করে নিলাম। পরদিন ফেরার পালা। সেদিনই রাতে আশ্রমের মহারাজ জানিয়ে গেলেন, আমরা যেন সকালে ওখান থেকে খালি মুখে না বের হই। রান্নাঘরে খাবার থাকবে, নিজেরা নিয়ে খেয়ে নিই। আমরাও সকালে রান্নাঘর থেকে নিজেদের মতো করে ভাত, ডাল আর তরকারি নিয়ে খেলাম। আশ্রমের গুরু মহারাজকে প্রণাম করে হরিদ্বারের সুন্দর স্মৃতি আর আবার যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হলাম।
◾কীভাবে যাবেন–
হাওড়া থেকে উপাসনা, কুম্ভ কিংবা দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার পৌছনো যায়। এছাড়া অমৃতসর মেল কিংবা অমৃতসর এক্সপ্রেসে নাজিবাবাদ পৌঁছে উত্তরাখন্ড সরকারের বাসে যেতে পারেন হরিদ্বার। হরিদ্বারে কোনও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেই। তাই বিমানে গেলে দিল্লি হয়ে দেরাদুনের ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টের বিমানে যেতে হবে।
◾কোথায় থাকবেন–
থাকার জন্য ভারত সেবাশ্রম, গণেশ ভবন, লোকনাথ আশ্রম, ভোলাগিরি আশ্রম ছাড়াও বহু হোটেল, লজ এমনকী হলিডে হোমও আছে।
◾কী খাবেন–
হরিদ্বারের সব জায়গায় নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। আমিষ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। মাছ, মাংস ডিম কোনওটাই পাবেন না। যদিও সেইসব নিরামিষ পদ খাওয়ার স্মৃতি জিভে লেগে থাকার মতো। আর যেখানেই খান না কেন, প্রথমে গরম ভাতে সুগন্ধী ও সুস্বাদু ঘি থাকবেই।
***ছবি ঋণ ইন্টারনেট