অতুলনীয় ও অপরিহার্য এক অভিনেতা
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। মাসে একবার। আজকের পর্বে বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেতা কমল মিত্র কে নিয়ে লিখেছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক, তখনও বাংলা সিনেমায় কোনও স্টিরিওটাইপ ভিলেনের আগমন ঘটেনি, যার আগমন ঘটেছিল তিনি হলেন একজন রাগী, অভিজাত ও দাম্ভিক বাবা। আর সেই বাবার কথা বললেই যাঁর নাম আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি হলেন কমল মিত্র। এত সুন্দরভাবে সেই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতেন তিনি, যে দর্শকের মনে হতো এই চরিত্রটি তাঁর জন্যই সৃষ্ট। চেহারার গাম্ভীর্য থেকে গমগমে গলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে ডায়ালগ বলা–নিজের এক পৃথক ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বাংলা ছবির অভিজাত ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রগুলিতে নিজেকে অপরিহার্য করে তোলেন কমল মিত্র। নব্বইটির বেশি ছবিতে অভিনয় ক’রে, তিনি সবার মন জয় করে নেন। যদিও যখন তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে, সে সময়েই অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিংবদন্তি অভিনেতা কমল মিত্র ১৯১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী এবং বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। রাজ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ থেকে লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেন কমল মিত্র। আবৃত্তি এবং অসাধারণ উচ্চারণের দক্ষতা দেখে অনেকেই তাঁকে অভিনয় করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। নিজেরও সেই ইচ্ছে ছিল। স্থানীয় বিভিন্ন শৌখিন নাটকের দলে অভিনয়ও করতেন। বেশ নামও হয়েছিল। যদিও তখনকার দিনে অভিনয় করে অর্থ উপার্জনের কথা খুব কম লোকই ভাবতে পারতেন। পড়াশোনা শেষ করার পরেই পারিবারিক কারণে তাঁকে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবতে হয়। তাই কাউকে না জানিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নাম লেখান। যদিও তাঁর বাবার অমতের কারণে তাতে আর যোগ দেওয়া হয়নি। এরপর সরকারি কালেকটরেটে চাকরি নেন। বহুদিন সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবত এই কাজের অভিজ্ঞতাই তাঁকে পরবর্তীকালে ভাবগম্ভীর অভিনয় করতে সাহায্য করেছিল।
মঞ্চে বা পর্দায় অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য অনেক কম বয়স থেকেই কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেন কমল মিত্র। উত্তর কলকাতায় এলে তিনি তাঁর দিদির বাড়িতে থাকতেন। দিদির বাড়ির খুব কাছাকাছি থাকতেন প্রখ্যাত অভিনেতা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কমল মিত্রর জামাইবাবুর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। জামাইবাবুর মাধ্যমেই ওই নামী অভিনেতার সঙ্গে আলাপ হয় কমল মিত্রের। সেই সময়েই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিটিও মুক্তি পায়। কমল মিত্র অভিনয় করতে চান শুনে তিনি বলেছিলেন, অভিনয় কোনও ভদ্রসন্তানের জন্য নয়। লেখাপড়া শিখে অন্য কাজ করো, সম্মান পাবে। আমার নেহাত ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই বলে পড়ে আছি।
কমল মিত্র অবশ্য এতে হাল ছাড়েননি বা হতাশ হয়ে পড়েননি। কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ না নিলেও নিজের মতো করে অভিনয়ের অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন, অভিনয় দেখতেন আর ঘন্টার পর ঘন্টা তা চর্চা করতেন। কাজের প্রতি এই ভালবাসাই তাঁকে একদিন জনপ্রিয়তার শিখরে পৌছতে সাহায্য করেছিল। এরপর কমল মিত্রর সহকর্মী কবি কণক মুখোপাধ্যায় তাঁকে চিত্র পরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাতেও তখন কাজের কাজ কিছু হলো না। পরিস্থিতি অনুকূল হলো পরিচালক দেবকীকুমার বসুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর। তিনি কমল মিত্রকে আশ্বস্ত করেন, অভিনয়ে সুযোগ দেবেন বলে। তবে এও বলেন, তক্ষুনি চাকরি ছাড়ার দরকার নেই। প্রয়োজনমতো তাঁকে ডাকা হবে।
কমল মিত্রের প্রথম অভিনীত ছবি ‘নীলাঙ্গুরীয়’। গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এই ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। যদিও খুবই স্বল্প সময়ের চরিত্র ছিল সেটি। আর একটি মাত্র ডায়লগ। এরপর তিনি দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় হিন্দি ছবি ‘শ্রী রামানুজ’-এ একজন সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবিতেই প্রথম পারিশ্রমিক পান তিনি। ১৯৪৩ সালে মুক্তি পায় এই ছবি। বলা যায়, এখান থেকেই কমল মিত্রের একরকম পাকাপাকিভাবে অভিনয়-যাত্রা শুরু। এরপর ১৯৪৫ সালে দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় হিন্দি ছবি ‘স্বর্গ সে সুন্দর দেশ হামারা’-য় অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত পরবর্তী ছবিও ছিল হিন্দি। নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত সেই ছবির নাম ‘বনফুল’।
যদিও হিন্দি ভাষা সেভাবে না জানার কারণে প্রথমদিকে সমস্যায় পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি একেবারেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাই হিন্দির পাশাপাশি উর্দু শেখার জন্য শিক্ষক রেখে তিনি ভাষার চর্চা করতেন। সে সময়ের নামী পরিচালকদের মধ্যে দেবকীকুমার বসু, নীরেন লাহিড়ী ছাড়াও অপূর্ব কুমার মিত্রর ‘তুমি আর আমি’, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সংগ্রাম’, হেমেন গুপ্তর ‘অভিযাত্রী’, অগ্রদূতের পরিচালনায় ‘সমাপিকা’ ও ‘সব্যসাচী’-তে অভিনয় করেন কমল মিত্র। পর্দায় অভিনয় করার সময়েই ১৯৪৪ সালে যোগ দেন স্টার থিয়েটারে। মহেন্দ্র গুপ্তর লেখা ও পরিচালনায় ‘টিপু সুলতান’ নাটকে ব্রেথওয়েটের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকের মাধ্যমেই তাঁর কলকাতার মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে অবশ্য তিনি ওই নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নাটক চলেছিল একটানা ১১৯ রজনী।
এরপরে আর অভিনয়ের জন্য তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কালেকটরেটের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেন। বর্ধমান ছেড়ে উত্তর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। প্রথমদিকে খুবই আর্থিক অনটনের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তাই পরবর্তীকালে যখন আর্থিক সচ্ছলতা আসে, তখনও তিনি কোনওরকম বিলাসিতা করতেন না। ১৯৪৯ সালে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী শ্রীরঙ্গম, যা পরে বিশ্বরূপা নামে পরিচিত হয়, সেখানে ‘পরিচয়’ নাটকের জন্য ডেকে নেন কমল মিত্রকে। এরপর ছবি বিশ্বাস তাঁকে মিনার্ভার দায়িত্ব দেন। সেখানে ‘জীবনটাই নাটক’-এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপরেও ‘রিজিয়া’, ‘সীতা’, আলমগীর’, ‘ঝিন্দের বন্দি’র মতো বেশ কিছু নাটক করার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। স্টার থিয়েটারে নীহাররঞ্জন রায়ের ‘তাপসী’ নাটকে তাঁর অভিনয় ভূয়সী প্রশংসা পায়। এই নাটকেই সহ অভিনেতা হিসেবে প্রথম তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
কমল মিত্র অভিনীত বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে যে নামগুলি করতেই হয়, তা হলো, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘সব্যসাচী’, ‘দেয়ানেয়া’, ‘লৌহকপাট’, ‘সবার ওপরে’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘পিতাপুত্র’, ‘আনন্দমঠ’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন ভুবনের পাড়ে’, ‘বর্ণালী’ ইত্যাদি। নানারকম চরিত্রে অভিনয় করলেও বেশিরভাগই ছিল ধর্মীয় কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্র। ‘মহিষাসুর বধ’-এ তিনি মহিষাসুরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নায়কের ভূমিকায় তাঁকে না পাওয়া গেলেও পার্শ্বচরিত্রেই তিনি সবার মন জয় করে নেন। তাঁর কন্ঠস্বর, ব্যক্তিত্ব এবং অভিব্যক্তি যে কোনও চরিত্রকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘দেয়ানেয়া’ ছবিতে উত্তমকুমারের বাবার চরিত্র হোক কিংবা ‘বর্ণালী’তে সৌমিত্রর কাকা, সব কিছুতেই তাঁর উপস্থিতি দর্শক প্রভূত উপভোগ করেছেন।
পরিচালকদের মধ্যে দেবকীকুমার বসু, অগ্রদূত, তরূণ মজুমদার, অজয় কর, তপন সিনহা এমনকী সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু যখন তাঁকে সেরা অভিনেতা বলে দর্শক মানতে শুরু করল, তখনই তিনি অভিনয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে খ্যাতি এবং অর্থের প্রতি তাঁর সামান্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। তাঁর দুর্লভ ও মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহ ছিল। পরে নিজেই সেসব বই নন্দনে দান করে দিয়েছিলেন, যাতে সবাই সেই বই পড়ার সুযোগ পায়। পরবর্তীকালে আত্মজীবনী লেখেন। বইয়ের নাম ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট তিনি চিরতরে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন।