আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমারকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ সপ্তম ও অন্তিম পর্ব।
লতাজি, আশাজি থেকে মহম্মদ রফি, মান্না দে, মুকেশ, মহেন্দ্র কাপুর, গীতা দত্ত প্রমুখের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন কিশোরকুমার। আশাজির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ডুয়েট গেয়েছেন তিনি। আর ডি বর্মণের কম্পোজিশন এবং কিশোর-আশা ডুয়েট মানেই বৈচিত্রের পসরা। অন্যদিকে সেরা রোমান্টিক, মেলোডি-প্রধান ক্লাসিক নাম্বারগুলি আছে লতাজি-কিশোর জুটিতে। এই জুটির গান ছাড়া সেই সময় হিন্দি রোমান্টিক ছবি ভাবাই যেত না। কিশোরকুমার ‘অমর-আকবর-অ্যান্টনি’ ছবির একটি গানে জুটি বাঁধেন লতাজি, মহম্মদ রফি ও মুকেশের সঙ্গে। এ এক রেকর্ড। অন্যদিকে বাম্পার হিট মান্না দে’র সঙ্গে কিশোরের ‘পড়োশন’ ছবির ‘এক চতুর নার’ গানটি। এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মান্না দে এই প্রতিবেদককে একটি অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছিলেন। কিশোরের প্রতিভা মূল্যায়নে এত সুন্দর বক্তব্য আর হয় না। ওঁর কথায়, “আমরা দিবারাত্র রেওয়াজ করে যে পারফরম্যান্স করি, কিশোরকুমার অবলীলায় কোনও কালোয়াতি চর্চা না করেই সেটা করে দিতে পারে। এই গানটির রেকর্ডিংয়ে সেটার প্রমাণ পাই আমি। এমন আর একজন হবে না। সংগীতের ঈশ্বর স্বয়ং ওঁর কণ্ঠে বাস করেন।”
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কিশোরকুমার। অভিনয়টা ভালো জানতেন বলে গানে নাটকীয় অনুপান একেবারে সঠিকমাত্রায় যোগ করতে পারতেন। বেসিক বাংলা গানেও তাঁর অভিব্যক্তিতে সেই ব্যাপারটা উঠে আসতো। গান লিখেছেন, সুর তৈরি করেছেন। করেছেন সংগীত পরিচালনা। সিনেমা প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। চিত্রনাট্যও লিখতেন। স্বভাবজাত কৌতুকপ্রিয় মানুষটি যতদিন বেঁচেছিলেন, থাকতেন ফুর্তির মেজাজে। যদিও কিশোরের ঘনিষ্ঠ জনেদের অনেকেই বলেন, তাঁর ভিতরে কোথাও একটা অসহায়, অবুঝ, আবেগপ্রবণ মানুষের কান্না লুকোনো ছিল। হবে, হয়তো। কিছু গোপন দীর্ঘশ্বাস বোধহয় প্রকৃত সৃজনশীল মানুষের চিরন্তন সঙ্গী। প্রথম স্ত্রী রুমার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী মধুবালার সঙ্গে ঘর বাঁধেন তিনি। রুমার সঙ্গে বরাবরই এক শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্ক বজায় ছিল। মধুবালার কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়া ও চলে যাওয়া কিশোর বহুদিন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি, এমনটা বলেন অনেকেই। তাঁর তৃতীয় বিয়েটা নিয়ে আর কিছু লিখতে চাই না। শেষ স্ত্রী লীনা চন্দ্রভারকরকে নিয়ে ভালোই ছিলেন, এমনই জানি আমরা। তবু, সুখ সইলো না কিশোরের কপালে। আকস্মিক হৃদযন্ত্রের বৈকল্য। হৃদযন্ত্র না হৃদয়ের ! যেটা বলার, জীবনের আনন্দ-দুঃখ, যন্ত্রনা-উপশম সবই গানেই উজার করে পেয়েছেন ও দিয়েছেন আমাদের।
শেষ করবো সেই অনুভবী জীবনদর্শনের মহৎ উপলব্ধির কথায়। তাঁর কৈশোরের গৌরীকুঞ্জের দেওয়ালে ঝোলানো ছিল রবীন্দ্রনাথের ছবি। প্রবল ভক্ত ছিলেন রবি ঠাকুরের গানের। কিশোরের উদাত্ত কণ্ঠের বাধনহারা রবীন্দ্রসংগীত শোনা একেবারে অন্য এক অনুভব দেয় শ্রোতাকে। তাঁকে দিয়ে প্রথম বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ‘মায়াবন বিহারিণী হরিণী’ গাওয়ালেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,’লুকোচুরি’ ছবিতে। এটিও ছিল রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে ডুয়েট। এরপর তো সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে বারবার ওঁকে দিয়ে গাইয়েছেন সেই অপার্থিব অভিব্যক্তিটি পাওয়ার জন্যই। মাফ করবেন পাঠক, এ একান্তই আমার ভাবনা। সবাই সহমত না-ও হতে পারেন। অপার্থিব কথাটাও ভেবেই বললাম। প্রতিভা নিয়ে অনেকেই আসেন পৃথিবীতে। কিন্তু এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়েই শ্রোতাকে অপার্থিব আনন্দের স্বর্গে পৌঁছে দিতে যিনি সক্ষম হয়েছেন, তিনি কিশোরকুমার।
আমি বহুবার আলোচনা প্রেক্ষিতে পর প্রজন্মের শিল্পীদের কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত শুনতে বলি। অনেকে অবাকও হয়। আমি প্রথাগতভাবে, তথাকথিত রাবীন্দ্রিক বিশুদ্ধতা মেনেই রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি। এই নিয়ে আমার মনে কোনও দোলাচল নেই। কিন্তু রবীন্দ্রদর্শনে জীবনচর্চার গভীরে ডুব দেওয়া, একান্তের বলয়ে অভিযাত্রার পাশাপাশি খোলা আকাশে মুক্তির যে ইঙ্গিত মেলে, তা শুধু ব্যাকরণ মেনে গান গাওয়ার মধ্যে সম্ভব নয়। আরও কিছু বাড়তি উপকরণ যোগ করতে হয়, সেটা কিশোরকুমারের মতো আর কারও গাওয়ার মধ্যে পাইনি আমি। আমার বাকি অগ্রজ শিল্পীদের পরিবেশনে আমি হয়তো অন্যান্য অনেক মহার্ঘ বস্তু লাভ করেছি। কিন্তু…! তিনি যখন বলেন, বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে…আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে…তখন কোথাও একটা হাহাকার ধ্বনিত হয় শ্রোতারও অন্তরে। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে হাসতে হাসতে চলে যাওয়া–আমাদের চিরকালের মতো কাঁদিয়ে। তাঁকে ভোলা যে অসম্ভব !