একজন গুণী অভিনেতা ও এক মরমি মানুষ
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। সদ্য প্রয়াত অভিনেতা প্রদীপ মুখার্জিকে নিয়ে লিখেছেন সুচেতনা বন্দোপাধ্যায়।
শুনেছিলাম দু’বার কোভিড হয়ে গেছে। স্বভাবতই শরীর খুবই অসুস্থ। তাই কতটা কথা বলতে পারবেন, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম ! প্রথমদিকে প্রশ্নের উত্তর সংক্ষিপ্তভাবে দিলেও, যেই মুহুর্তে সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গ এল, তখন গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করলেন। দেখলাম ৭৬ বছর বয়সেও স্মৃতিতে এতটুকু মরচে ধরেনি, কোনও কিছু ভেবে উত্তর দিতে হচ্ছে না। ফোনের ওপারে আমার সেই ছোটবেলার পছন্দের নায়ক ‘জন অরণ্যে’র সোমনাথ। বলে যাচ্ছেন তাঁর মানিকদার সঙ্গে আলাপের কথা।
সদ্য প্রয়াত এই মানুষটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনে মনে ফিরে গেলাম ওঁর সঙ্গে কথোপকথনের সেই না ভোলা দিনটিতে। কোভিড পরিস্থিতিতে সামনে গিয়ে বসে কথা বলার উপায় নেই। অতএব ভরসা দূরভাষ। সেই দূরভাষ মাধ্যমেই শুনছি প্রদীপবাবুর অনাবিল উচ্চারণ। বলছেন, আমি মাঝে মধ্যে মানিকদার বাড়িতে যেতাম। সবাই যেমন যেত অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য, তেমনই যেতাম। তখন ‘নক্ষত্র’ নামে একটা গ্রুপ থিয়েটারে ‘লম্বকর্ণ পালা’-য় অভিনয় করছিলাম। নাটকের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একটা সময় এমন হলো, অনেকদিন ওঁর বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। মানিকদা সেসময় আমাকে দেখেছিলেন একটা নাটকে। এরপর একদিন শুনতে পেলাম, মানিকদা আমার খোঁজ করছেন।
সেটা ছিল ১৯৭৪ সাল। এমন খবর পাওয়ার পর আর দেরি না করে আমি সেদিনই ওঁকে ফোন করলাম। উনি আমাকে পরদিনই দেখা করতে বললেন। আমি যথারীতি পরদিন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে হাজির। উনি আমাকে বললেন, আমি তো তোমার নাম জানতাম না। তোমার ঠিকানাও রাখা হয়নি। যদিও লিখে রাখা উচিত ছিল। তাই তোমার চেহারার বর্ণনা দিয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেনি। মানিকদার সঙ্গে এভাবেই প্রথম যোগাযোগ। পরদিন আবার গেলাম, সেদিন সিনেমা নিয়ে কথাবার্তা হলো। বেরনোর সময় বললেন, শঙ্করের ‘জন অরণ্য’ উপন্যাসটা পড়ে ফেলো। ওখানে নায়ক সোমনাথ চরিত্রের জন্য তোমাকে ভেবেছি। আমি যখন মানিকদার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন একজন মহিলা ওখানে আসেন। পরিচয়ে বুঝতে পারলাম উনিই মানিকদার স্ত্রী বিজয়া রায়। কথাবার্তায় একদম মায়ের মতো। কী সুন্দর ব্যবহার তাঁর। উনি আমাকে বললেন, মানিক তো তোমাকে খুঁজছিল ! অবশ্য, শেষ পর্যন্ত তুমি যে আজ আসবে, সেকথা কাল রাতে জানিয়েওছিল।
এই পর্যন্ত শুনে প্রদীপবাবুকে প্রশ্ন করি, অত নামী পরিচালকের সঙ্গে বোঝাপড়া গড়ে উঠতে আপনার সমস্যা হয়নি ? উত্তরে হেসে জানান, মানিকদা ভীষণ ফ্লেক্সিবল ছিলেন। সবার কথা শুনতেন। যেটা বুঝতে পারতেন না, সেটা জেনে নিতেন। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো করে নয়, একটি চরিত্রের মানসিকতা কেমন হতে পারে, তিনি নিজের মতো করেই গভীরভাবে সেটা বুঝতে পারতেন। অভিনেতাকে ভাল করে পরখ করে নিতেন। তাঁর হাঁটাচলা, ইচ্ছে, রুচি সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতেন। সোমনাথের চরিত্র করানোর আগে আমার প্রতিটা আচরণ, আমার পোশাক পরার ধরন, চলাফেরা সব লক্ষ্য করতেন। এমনকী যে পোশাক পরে মানিকদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, শুটিংয়ে সেই পোশাকই ব্যবহার করেছেন। এত খুঁটিয়ে কাজ করতেন বলেই তিনি এখনও সারা দেশের পরিচালকদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন।
প্রথম ছবিতেই নায়কের ভুমিকায় অভিনয়, তায় আবার অত বড় মাপের পরিচালকের হাতে। এটা তাঁর বিরাট পাওনা বলে মনে করতেন প্রদীপবাবু। আজও সোমনাথের চরিত্র প্রায় প্রতিটি বাঙালি সিনেমা দর্শক মনে রাখলেও, নিজের কৃতিত্বের কথা একবারও বললেন না। সবটাই পরিচালকের গুণে হয়েছে বলেই জানান তিনি–এমনই নিরহংকারী ছিলেন। ‘জন অরণ্য’ ছবির প্রায় ১৬ বছর পর সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘শাখাপ্রশাখা’য় অভিনয় করেন তিনি। দ্বিতীয় ছবিতে কেন এত পরে ডাক পেলেন ? এর জবাবে হেসে জানান, আমার সঙ্গে মানানসই চরিত্র হবে, তবে তো আমাকে নেবেন ! আর আমি বরাবর একটু মুখচোরা ধরনের। নিজে থেকে কখনও কোনও পরিচালককে বলতে পারিনি, তাঁর ছবিতে আমাকে নেওয়ার জন্য। তবে, এ নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই।
মনে পড়ছে, সেদিন ফোনে ৪৭ মিনিট ২৮ সেকেন্ড কথা বলার মাঝেও কারও বিরুদ্ধে একটাও শব্দ উচ্চারণ করেননি প্রদীপবাবু। বরং প্রশংসা করতে ভোলেননি প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের। এই পরিচালকের একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। জানালেন, আমি ঋতুর মধ্যে মানিকদার একটা ধারা দেখতে পেতাম। অভিনয় থেকে ক্যামেরা সামলানো–সব বিষয়ে সমান দক্ষতা ছিল। আর সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতো। স্পট বয় থেকে নায়ক-নায়িকা–সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশতো। একজন টিম ডিরেক্টরের যা যা গুণ দরকার, সব ছিল ঋতুপর্ণর মধ্যে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘দূরত্ব’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হিরের আংটি’, ‘উৎসব’, ‘দহন’, সন্দীপ রায়ের ‘বাক্স রহস্য’, ‘বাদশাহী আংটি’, অপর্ণা সেনের ‘গয়নার বাক্স’, ইন্দ্রাশিস আচার্যের ‘পিউপা’, ‘বিলু রাক্ষস’, এবং সুজয় ঘোষের ‘কাহানি ২’ সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। যদিও যতটা সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল, তাঁকে যতটা কাজে লাগালে বাংলা চলচ্চিত্র জগত আরও সমৃদ্ধ হতো, তা যে করা হয়নি, একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু তাঁর মুখে এ নিয়ে কোনও অভিযোগ শোনা গেল না। বরং কোনও আফসোস আছে কিনা জানতে চাইলে, তাঁর উত্তরে বললেন, আমি অতি সাধারণ মানুষ। যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট। কাজেই কোনও কিছু নিয়ে কোনও আফসোস নেই। আফসোস আমাদের থাকবে। বাংলা সিনেমা জগৎ হারালো একজন প্রকৃত সজ্জন, ভদ্র ও শিক্ষিত বিরল মাত্রার অভিনেতাকে। চলে গেলেন একজন মরমি অভিনেতা তাঁর দেয় অনেককিছু না দিয়েই। এ ক্ষতি আমাদের, যাঁরা ইদানিং বাংলা ছবির পর্দায় স্বাভাবিক ও শিক্ষিত অভিনয় দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি।