Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

গড়ে-জঙ্গলে ইতিহাস-পুরাণে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। কলকাতার কাছেই জঙ্গলের মাঝে পল্লবিত ইতিহাস পুরাণের গল্প। পড়ুন লিপি চক্রবর্তীর কলমে। দুটি পর্বে প্রকাশিতব্য এই রচনার প্রথম পর্ব আজ।

অনেক দূরের দেশ নয়, কাছেই পশ্চিম বর্ধমানের গৌরাঙ্গপুর। ঘন জঙ্গল, বাংলার এক ‘রেখ দেউল’ ঘিরে জমে ওঠা গল্প এবং ইতিহাস, পুরাণ কথার চিহ্নস্বরূপ এক মুনির আশ্রম, মন্দির ইত্যাদির হাতছানি ক্রমশ দুহাত বাড়িয়ে যেন ডাকছিল আমাদের। যেতে হলে হাতে চারটে দিন দরকার। আর সঙ্গে যদি থাকে নিজস্ব বাহন, তবে তো সোনায় সোহাগা ! ভোর চারটেয় ঘুম ভাঙতেই তোড়জোড় করে বেরিয়ে পড়লাম যখন, সূর্যদেব তখনও আধো ঘুম আধো জাগরণে। সেই আলো ফুটি ফুটি ভোরে পেরিয়ে গেলাম দ্বিতীয় হুগলি সেতু, দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে শক্তিগড়। সেখানে কিছু জলযোগ সেরে এবার একটানা দৌড় দুর্গাপুরের দিকে। মুচিপাড়ার ব্রিজে না উঠে ব্রিজের নিচে দিয়ে ঘুরে গেলাম ডান দিকে। গুগল ম্যাপের সাহায্যে এঁকেবেঁকে কখনও পিচরাস্তা, আবার, কখনও লালমাটির রাস্তা ধরে সোজা পৌঁছে গেলাম দেউল পার্ক রিসর্টে। আর ভিতরে ঢুকতেই দু’চোখ জুড়িয়ে গেল। শুনেছিলাম এখানকার পরিবেশ সুন্দর। কিন্তু এত মনকাড়া সুন্দর কল্পনা করিনি।

Img 20230613 Wa0025
গড়ে-জঙ্গলে ইতিহাস-পুরাণে 11

পশ্চিম বর্ধমানের গৌরাঙ্গপুর জঙ্গলের শিবপুর বিট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এই দেউল পার্ক অঞ্চল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে দেখা যাচ্ছিল দেউলের উপরিভাগের খানিক আভাস। ইচ্ছাই ঘোষের দেউল। মধ্য যুগে চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলের মাঝে পড়ে ধর্মমঙ্গল তত জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু রাঢ়বঙ্গের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ভূপ্রকৃতি জানতে হলে ধর্মমঙ্গল কাব্যের আশ্রয় নিতেই হবে। স্বর্গের নর্তকী জাম্ববতী কোনও কারণে শাপগ্রস্ত হয়ে বমতি নগরে বেনুরায়ের মেয়ে রঞ্জাবতী হয়ে জন্মান। রঞ্জাবতীর দিদি ছিলেন গৌড়েশ্বরের রানি। আর দাদা মহামদ ছিলেন গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী। গৌড়ের রাজার দুই সামন্ত ছিলেন বিদ্রোহী ইচ্ছাই ঘোষ এবং ঢেকুরগড়ের কর্ণসেন।

Img 20230613 Wa0027
গড়ে-জঙ্গলে ইতিহাস-পুরাণে 12

এই দুই সামন্ত নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কর্ণসেন পরাজিত হলে গৌড়েশ্বর তাঁকে সান্ত্বনা হিসেবে নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বিয়ে দেন। বুড়ো কর্ণসেনের সঙ্গে বোনের বিয়ে হওয়ায় খুব রেগে যান মহামদ। এক্ষেত্রে তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ে কর্ণসেনের ওপর। তাঁকে মহামদ বারবার ‘পুত্রহীন’ বলে অপবাদ দিতে থাকেন। রঞ্জাবতী ধর্ম ঠাকুরের কাছে বহু প্রার্থনা করে একটি পুত্রসন্তান পান, তার নাম রাখেন লাউসেন। মহামদের রাগ কিন্তু কমে না। সে লাউসেনকে অপহরণ করে। ধর্মঠাকুরের নির্দেশে হনুমান তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এইভাবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যের প্রবল পরাক্রান্ত রাজাদের সঙ্গে লাউসেনকে মহামদ যুদ্ধ করতে পাঠান এবং লাউসেনও বিজয়ী হয়ে ফেরেন। এই মহামদেরই চক্রান্তে ইচ্ছাই ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের যুদ্ধ হয় এবং ইচ্ছাই ঘোষ পরাজিত ও নিহত হন।

দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রোদ একটু পড়তেই আধা কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথে পৌঁছে গেলাম দেউলে। ইচ্ছাই ঘোষের স্মরণে তাঁর বংশধররা এই দেউল নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিস্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এই দেউল নির্মিত হয়েছিল। কুড়ি ফুট ব্যাসার্ধের বিশাল উঁচু এই দেউলের মাথার দিকটা খিলানের মতো বেঁকে গিয়েছে। দেউলের ভিতরে রয়েছে শিব মন্দির। দেউলের গায়ে পোড়ামাটির কারুকাজ। সরকারি ভাবে অধিগৃহীত পাঁচিল ঘেরা পুরো চত্বর পরিচ্ছন্ন। সন্ধে গড়াতেই ফিরে এলাম রিসর্টে। সত্যি কথা বলতে কী, শুধু এই জায়গাটিতে থাকলেই নিশ্ছিদ্র বেড়ানোর আমেজ পাওয়া যায়। কত রকমের ফল-ফুলের গাছ, পুকুর, নার্সারি, টয় ট্রেনের লাইন আর থমকে থাকা রঙিন বগি, সুন্দর করে ছাঁটা ঘাস–সব মিলিয়ে ভারি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। আর সান্ধ্য চায়ের আড্ডার জায়গাটি তো এক কথায় অপূর্ব।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে বারান্দায় আসতেই একরাশ খুশি জড়িয়ে ধরল আমায়। ছোট ছোট পাম গাছের পাতায় মাকড়শার জালের ওপর ভোরের শিশির অপূর্ব আলপনা এঁকে রেখেছে। টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দও শোনা যায় কান পাতলে। নেমে এলাম সবুজের মাঝে। আগের দিন যে গেট দিয়ে রিসর্টে ঢুকেছি, ঠিক তার উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম আর একটি গেট। গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখি ওখানে দুটো চায়ের দোকান। একটিতে উনুনে আঁচ দিয়েছে সবে। আমায় খুব আদর করে ডেকে একটি চেয়ার এগিয়ে দিলেন এক দিদি। একজন বয়স্ক মানুষ চায়ের জল চাপালেন উনুনে। একটি ছোট্ট বাচ্চা হাঁসের সঙ্গে ছুটোছুটি করে খেলছে। একটা খুব অল্প বয়সের বউ সেই দিদিকে কাজে সাহায্য করছে।

Img 20230613 Wa0040
গড়ে-জঙ্গলে ইতিহাস-পুরাণে 13

এইসব বড় আপনকরা ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ নজর গেল উল্টোদিকের আর একটি গেটের দিকে। এখানে এসে অবধি খেয়ালই করিনি। গেটের পিছনেই বেশ ঘন জঙ্গলের ইশারা। দোকানের দিদিকে জিগ্যেস করে জানলাম জঙ্গলে ঢুকতে পাশ লাগে। তবে, প্রবেশ এইদিক দিয়ে নয়। বড় লোহার গেটটির পিছনে আর একটি সূক্ষ্ম তারের জাল আছে বুঝতে পারলাম। কারণ, একটু পরেই তিনটে ময়ূর এসে সেই জাল খানিকটা ঠুকরে নিয়ে তারপর পাশে রাখা একটি গাছের ডালে বসল। এবার শুরু হল তাদের খাওয়া। কখন, কে যে ওদের খাবার রেখেছে, সেটা অবশ্য দেখতে পেলাম না।

পরপর দু’কাপ চা খেয়ে ফিরে এলাম নিজের আপাত বাসস্থানে। আমরা গড় জঙ্গল দেখতে বের হবো আজ। এই জায়গার ইতিহাস লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের সঙ্গে জড়িত। রিসর্টের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বললেন, গাড়ি না নিয়ে একটি অটো ভাড়া করে গড় জঙ্গল দেখতে যাওয়া সুবিধাজনক। রাস্তা বেশ খারাপ, পাথরে ভর্তি। স্বাভাবিক, কারণ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা। ওঁরাই একটি অটো ডেকে আনলেন। আমাদের চলার শুরুই হল ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এত গভীর যে অনেক জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছয় না বলে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম দেবী শ্যামারূপা মন্দিরের দরজায়।

প্রসঙ্গত, শ্যামারূপা মায়ের আরতি না হলে নাকি সূর্যদেব উদিত হন না। পুরোহিত বলছিলেন, কেন মায়ের নাম শ্যামারূপা। সময়টা বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন বা দেবী চৌধুরানীর সময়। তখন এখানে নরবলি প্রথা ছিল। কৃষ্ণনাম জপ করা কবি জয়দেব নরবলি পছন্দ করতেন না। একদিন রাজা তাঁকে বলেন, যে জয়দেব তো কৃষ্ণ ভক্ত। সব কিছুতেই তিনি কৃষ্ণকে খুঁজে পান। দেবী দুর্গার মধ্যে তিনি কৃষ্ণকে দেখাতে পারবেন কি? জয়দেব তখন বলেন, যদি তিনি পারেন তবে নরবলি বন্ধ করে দিতে হবে। রাজা রাজি হন। কবি দেবীর মূর্তিতে শ্যাম ও শ্যামার রূপ দর্শন করান রাজাকে। নরবলি প্রথা বন্ধ হয়। তাই দেবী শ্যামারূপা।

দুর্গাপূজার সময় বহু মানুষের সমাগম হয় এখানে। অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষণে ওই বিশাল সংখ্যক মানুষ কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। কোথা থেকে যেন ভেসে আসে তোপধ্বনি। কেউ এই রহস্য আজও আবিষ্কার করতে পারেনি, কোথা থেকে আসে। একটি বিশাল লোহার কড়াই আছে নাট মন্দিরে। নবমীর ভোগ হয়। বহু মানুষ প্রসাদ পান এখানে। একটি জায়গা আছে মন্দিরের মতো, কিন্তু, ছোট্ট। এখানেই নাকি নরবলি হতো। এখন অবশ্য পুজোয় ছাগবলি হয়। মন্দিরের উল্টোদিকে আছে শ্যাওলাধরা প্রাচীন সিঁড়ি। ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে অজয় নদের দিকে। দু’দিকে ঘন জঙ্গল। কৌতূহল টেনে নিয়ে গেল সেদিকে। কিন্তু বেশ কিছুটা নামার পর এত গাছ আর জলকাদা যে অজয় পর্যন্ত পৌঁছনো গেল না। এই সিঁড়ি লক্ষ্মণ সেনের সিঁড়ি নামে পরিচিত।                (চলবে)

ছবি : লেখক