গহীন অরণ্যের সেই দৃশ্য মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে কাজিরাঙার বর্ণময় কাহিনি। আজ দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন মণিদীপা কর।
ট্যুর প্ল্যান করার সময় মোটেই ভাবিনি ফেব্রুয়ারির শেষে এমন রাঙা মেঘও দেখতে হবে। লাগেজ গোছানোর আগে গুগল-এ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখতে গিয়েই মন খারাপের শুরু। আশঙ্কা, বসন্তে অকাল বৃষ্টির মুখে পড়ব না তো ? যদিও অন্য জঙ্গলপ্রেমীরা আশা জুগিয়েছিল, এক পশলা বৃষ্টির পর সাইটিং ভাল হবে। কিন্তু এক পশলা বৃষ্টির বদলে আড়াই দিন আকাশের মুখ ভার হয়ে রইল। তৃতীয়দিন তো বৃষ্টির মধ্যেই দুটো সাফারি করলাম। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ রেখেই রওনা হলাম দ্বিতীয় সাফারিতে। গন্তব্য বুড়াপাহাড়।

যাওয়ার পথে হঠাৎ প্রফুল্লদা গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে দিল। পথের ধারে উঁচু গাছের মগডালে আঙুল তুলে দেখাল ব্ল্যাক জায়েন্ট স্কুইরাল। ছবি তুলতে ক্যামেরা তাক করেই বুঝলাম, এই স্বল্প আলোয় আমার ক্যামেরা ও দক্ষতার মেলবন্ধনে ছবি তোলা সম্ভব নয়। তাই খালি চোখে দেখাই শ্রেয়। ঠিক এই সময়ই প্রফুল্লদার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ জানান দিল, একটু ভিতরের গাছেই দোল খাচ্ছে হুলক গিবন। ইতিমধ্যেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে তকিবও। দুজন মিলে একের পর এক স্পট করে চলেছে পুরুষ গিবন, স্ত্রী গিবন, বাচ্চা কোলে দোদ্দুল্যমান মা গিবন, ফল সংগ্রহে ব্যস্ত গিবন দম্পতি। আমরা আপ্রাণ প্রচেষ্টায় শাটার মারছি। ক্যামেরার এক্সপোজার বাড়িয়ে, শাটার স্পিড কমিয়ে, কিছুতেই পাতে দেওয়ার যোগ্য ছবি মিলছে না।


ঠিক সেই সময় আমাদের কিছুটা দূর দিয়ে চা বাগানের মধ্যের মাটির রাস্তার এক পাশ থেকে অন্যপাশে চলে গেল তিনটি কালিজ ফিজ্যান্ট। মাটির উপর বসে যখন সেই ছবি তোলার চেষ্টা করছি, তখনই তকিব সবাইকে থামিয়ে কিছু একটা শব্দ শোনার এবং সেই সঙ্গে তার দেখা পাওয়ার চেষ্টা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে তকিবের নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস অনুসরণ করে দেখলাম চা বাগানের এক ‘শেড ট্রি’র দু’টো ডালের ফাঁকে খেলা করছে দুই ইয়োলো থ্রোটেড মারটিন। তকিব ও প্রফুল্লদার উচ্ছ্বসিত স্বগোতক্তি–কাজিরাঙার ইতিহাসে এমন দর্শন এই প্রথম। P900 ক্যামেরায় ভিডিও করতে করতে তকিব বলল, “সব টাইগার সাইটিং আজ ম্লান হয়ে যাবে মারটিনের কাছে।” কাজিরাঙার সাইটিং ইতিহাসের কয়েকটা পাতা ওল্টালেও সবটা আমাদের পড়া ছিল না। কিন্তু বিরলতম সাইটিং-এর অংশীদার যে হয়েছি, তা বুঝলাম তকিবের ফেসবুক পোস্টে বিশিষ্ট ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফারদের বিস্ময় ও অভিনন্দনের বন্যা দেখে। ছোট্ট দুই প্রাণীর চপল, চঞ্চলতার কিছু মুহূর্ত লেন্সবন্দি করে আমরা বুড়াপাহাড়ের দিকে চললাম। পথে ধাবায় কিছু ‘নাস্তা’ সেরে নেওয়া হলো।

নামে বৃদ্ধ হলেও বসন্তের পূর্ণ যৌবনা অরণ্য আমাদের স্বাগত জানাল। এদিন এখানে আমাদের দুটো গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি ঢোকেনি। তাই আমাদের সঙ্গে একজন গান-ম্যানও এসেছেন। শুরু থেকেই গাছের মগডালে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা অসংখ্য শাখামৃগ, ডিফলুর জলে খেলা করা চখাচখি, ঘাস খাওয়া থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এশিয়াটিক ওয়াটার বাফেলো-দ্বয়, গন্ডার–সবাই যেন আমাদের আরণ্যক সত্ত্বাকে যত্নে লালন করছে। এরই মধ্যে এক জায়গায় বেশ কিছু শকুন উড়তে দেখে প্রফুল্লদার সন্ধানী চোখ কিছু খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও গেল। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত এক প্রকান্ড গন্ডারের শেষকৃত্যে ভোজের আমন্ত্রণ পেয়েছে এই পক্ষীকূল। সঙ্গে কিছু কাক এবং দাঁড়কাকও আছে। যেন, মরা খাওয়ার ফাঁকে শিমুলের ডালে বসে জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যুর উর্ধ্বে নিজেদের উন্নীত করে নিচ্ছে। গহীন অরণ্যের সেই দৃশ্য মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।


ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে খেয়াল হল, সকালের সাফারির সময় প্রায় শেষ। গাড়ি ছুটল জঙ্গলের এগজিট গেটের দিকে। পথে আরও কিছু পাখি, বুনো মহিষ, শম্বর, হগ ডিয়ারের ছবি ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ ঘটলেও ভারাক্রান্ত মন বেশ কিছুক্ষণ জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-লয়ের আবর্তে ঘুরতে থাকল। জঙ্গল পেরিয়ে গাড়ি হাইওয়েতে উঠতে ফের বিষয়ী মন বলে উঠল, বিকেলের সেন্ট্রাল জোন সাফারিতে গোল্ডেন টাইগারের দেখা পাব তো! প্রত্যাশা পূর্ণ হলো কিনা, সেই গল্প তোলা থাক পরের সপ্তাহের জন্য। (চলবে)
ছবি : লেখক