গোলাপী শহরের অপরূপ স্থাপত্য স্মৃতিতে থেকে যায়
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। রাজস্থান ডায়েরি লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ তৃতীয় পর্ব।
অম্বর ফোর্টের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিলাম গত সপ্তাহে। আগেই বলেছি, এটা ছিল আমাদের ট্রিপের প্রথমদিন। প্রথমদিনেই বিস্ময়াবিষ্ট হই রাজস্থানের এই বিখ্যাত দুর্গপ্রাসাদ দেখে। এর কাছেই অবস্থিত আরাবল্লী রেঞ্জের ‘চিল কা টিলা’-র ওপরে অম্বর ফোর্টের ধাঁচেই রাজা জয় সিং নির্মাণ করেছিলেন জয়গড় ফোর্ট। জানা যায় এই ফোর্ট তৈরির উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুপক্ষের গতিবিধির ওপরে নজর রাখা। জয়গড় ফোর্টের ওয়াচ-টাওয়ার থেকে চতুর্দিকের বিশাল এলাকা নজরে আসে। এখানে একটি বিখ্যাত কামান আছে–জয়ভানা কামান। কার্যকারিতা এবং আকার-আয়তনে বিশাল চাকা লাগানো জয়ভানা কামান সেইসময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কামানের মর্যাদা লাভ করেছিল। যদিও এই কামান একবারও ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি।
প্রসঙ্গত, এখানেই ছিল রাজার কোষাগার, জলাধার, অস্ত্র-কারখানা ইত্যাদি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–অম্বর ফোর্টের সঙ্গে জয়গড় ফোর্টের একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল, বিপদে-আপদে রাজপ্রাসাদের আবাসিকদের নিরাপদ নিষ্ক্রমণের জন্য। ইতিহাসের অঙ্গনে ঘুরতে ঘুরতে সময়ের খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতেই দেখলাম সূর্য প্রায় অস্তাচলে। সাড়ে পাঁচটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। অন্যান্য পর্যটকরাও একে একে নামতে শুরু করেছে। সারা আকাশ তখন অস্তরাগে রাঙা। সূর্যাস্ত দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। এক অবিস্মরণীয় মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম। যখন নিচে নেমে এলাম, দুপুরে দেখা জমজমাট চত্বর তখন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। ভাবতে ভালো লাগছিল উপযুক্ত কারণেই অম্বর ফোর্ট ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর মর্যাদা পেয়েছে। লজে ফিরতে ফিরতে আমাদের সন্ধে সাতটা বেজে গেছিল। ততক্ষণে আলোর মালায় সেজে উঠেছে পিঙ্ক সিটি জয়পুর। আটটা নাগাদ আর্লি ডিনার করে বিছানায় চলে গেলাম সবাই। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমও এসে গেল।
- ২য় দিন
আজ আমাদের পুরোটাই সিটি ট্যুর। সিটি প্যালেস, যন্তর-মন্তর, হাওয়া মহল দেখে জলমহল দেখতে যাবার কথা। ন’টার মধ্যে স্নান ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম জয়পুর সিটি প্যালেসের সামনে। জয়পুর শহরের সাত ভাগের একভাগ এলাকা জুড়ে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিশাল সিটি প্যালেস চত্বর,একটা বিলাসবহুল ছোটোখাটো শহর বললে অত্যুক্তি হয় না। মহারাজা সওয়াই জয় সিং সিটি প্যালেস তৈরি করেন। পরে ওই চত্বরে পরবর্তী রাজারা আরও অনেক প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। পুরনো রাজপ্রাসাদের মুবারক মহলে রয়েছে সমৃদ্ধ এক মিউজিয়াম। এছাড়াও কয়েকটি প্রাসাদকে পাঁচতারা হোটেলে পরিণত করা হয়েছে।
মিউজিয়ামের বিভিন্ন গ্যালারিতে মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট, রাজ-পরিবারের ব্যবহৃত পোশাক-আশাক, জুয়েলারি, বাসন-কোসন, অস্ত্র-শস্ত্র, রাজস্থানী হস্তশিল্প সযত্নে সংরক্ষিত আছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যেটা দেখলাম, আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ-মহাভারত এবং ভাগবত গীতা ইত্যাদি পুঁথিগুলি মিনিয়েচার ফরম্যাটে রাখা হয়েছে–সম্ভবত মুঘলদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আরও একটি অসাধারণ দ্রষ্টব্য–মুবারক মহলে রাখা দুটি বিশাল মাপের সিলভার জার! পৃথিবীর বৃহত্তম ওই জারদুটি গিনেস বুক অফ ওয়ারল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে। মুঘল ও রাজস্থানী স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি অনবদ্য কারুকার্য খচিত রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখতে দেখতে ইতিহাস যেন সামনে এসে দাঁড়ায়।
জমকালো জেনানা মহল, সাজঘর, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস ইত্যাদি সবকিছুই অবশ্য দর্শনীয়। এরপরে আমরা চলে গেলাম হাওয়া মহলের দিকে । হাওয়া মহল নাম হলেও এটা আসলে সিটি প্যালেসের ব্যালকনি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাঁচতলা এই হাওয়া মহল নির্মিত হয় রাজা সওয়াই প্রতাপ সিংহের আমলে। ৯৫৩টি জাফরি-কাটা উজ্জ্বল বর্ণময় ছোট ছোট জানলা দিয়ে রাজ-পরিবারের মহিলারা বাইরের দৃশ্য দেখতেন। হাওয়া মহলের সামনের রাস্তা সবসময় ব্যস্ত থাকে, কারণ ওই এলাকাতেই জমজমাট বাজার। এই বাজারে সবকিছুই পাওয়া যায়। পছন্দমতো খাবার-দাবার, রাজস্থানি ট্রাডিশনাল পোশাক, জয়পুরী চটি, জুয়েলারি ইত্যাদি। হাওয়া মহলের মৌচাকের মতো নজরকাড়া আর্কিটেকচার, একবার দেখলে চিরকাল স্মৃতিতে থেকে যায়।
অদূরেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজা সওয়াই জয় সিংয়ের প্রতিষ্ঠিত যন্তর-মন্তর বা মানমন্দির। ভারতের পাঁচটি মানমন্দির তৈরি হয়েছে তাঁর হাতে–জয়পুর, দিল্লী, বেনারস, উজ্জয়িনী এবং মথুরায়। জয় সিং শুধু সুযোগ্য রাজা ছিলেন তা নয়, তিনি একাধারে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলার যেমন কদর করতেন, তেমনি তীক্ষমেধা ও দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় নির্মিত বিশ্বের বৃহত্তম মানমন্দিরটি জয়পুরে। সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম মানমন্দিরের সান-ডায়াল অর্থাৎ সূর্যঘড়িটিও। সংগত কারণেই গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে জয়পুরের যন্তর-মন্তর। ১৭২৮-১৭৩৪ সালে নির্মিত মানমন্দিরে এখনও স্থানীয় সময়, সূর্যের অবস্থান, ধ্রুবতারা, উপগ্রহের গতিপথ, গ্রহণের সময় ইত্যাদি নিখুঁতভাবে দেখা যায়।
যন্তর-মন্তর দেখে আমরা চলে গেলাম অ্যালবার্ট হল মিউজিয়ামে। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অ্যালবার্টের জয়পুর সফরের আগে তাঁকে বিশেষভাবে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পুরো জয়পুর শহরের সব বাড়ি গোলাপী রঙে রঞ্জিত করা হয়। সেই থেকে জয়পুর পিঙ্ক সিটি নামে পরিচিতি লাভ করে। শুধু তাই নয়, প্রিন্স অ্যালবার্টের জয়পুর ভ্রমণের স্মৃতিতে অসাধারণ স্থাপত্যশৈলিতে বেলেপাথর ও শ্বেতপাথর সহযোগে নির্মাণ করা হলো এক অসাধারণ মিউজিয়াম, যার নাম অ্যালবার্ট হল মিউজিয়াম। এখানেও সংরক্ষিত আছে নানান চিত্রকলা, বসন-ভূষণ, মহারাজদের তৈলচিত্র, হস্তশিল্প ইত্যাদি। বিশেষভাবে নজর কেড়ে নেয়, মিশরের কায়রো থেকে প্রাপ্ত একটি উপহার–’টুটু মমি’, যা সংরক্ষিত রয়েছে এই মিউজিয়ামে। জয়পুর ছাড়া ভারতের আরও চারটি মিউজিয়ামে মিশরের মমি আছে। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর তার অন্যতম।
অ্যালবার্ট হল মিউজিয়াম দেখে বেরিয়ে এসে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম। বেশ উপাদেয় লাগলো রাজস্থানী থালি। এর পরের গন্তব্য জলমহল। শহর থেকে ৭ কিমি দূরে মানসাগর সরোবরের মাঝখানে রাজা সওয়াই প্রতাপ সিং তৈরি করেন পাঁচতলা প্রাসাদ ‘জল মহল’–রাজার গ্রীষ্মকালীন আবাস। বর্তমানে জলমহলকে প্যালেস হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সেই কারণে জল মহলের ভেতরে যাবার সুযোগ নেই। আরাবল্লি রেঞ্জের প্রেক্ষাপটে নির্মিত জলমহলের দৃশ্যপট এককথায় অনবদ্য। সরোবরের ধার বরাবর চমৎকার বাগান দিয়ে ঘেরা। লেকের মনোরম মিষ্টি হাওয়ায় পড়ন্ত বেলায় সুন্দর পরিবেশে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে সন্ধের আগেই আমরা লজে ফিরে এলাম। রাতে ডিনার সেরে বিশ্রামে যাওয়া। তার আগে পরের দিনের প্রস্তুতিপর্ব। পরদিন সকালে পিঙ্ক সিটি জয়পুরকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেব লেক সিটি উদয়পুরের উদ্দেশে। (চলবে)
ছবি : লেখক