Tuesday, May 13, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

চপল ঝর্নার দেশে কয়েকদিন

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পর্যটন আকর্ষণে অতুলনীয় ওড়িশার কেওনঝর নিয়ে লিখেছেন লিপি চক্রবর্তী। তিন পর্বে প্রকাশিতব্য এই ধারাবাহিক ভ্রমণ রচনার প্রথম পর্ব আজ।

‘চপল পায় কেবল ধাই/ কেবল গাই পরির গান/ পুলক মোর সকল গায়/ বিভোল মোর সকল প্রাণ’–কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘ঝর্নার গান’ সত্যি-সত্যিই যেন বইয়ের পাতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রাণ পেল, কেওনঝর দর্শনে। প্রায় কাকভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশে। নির্ধারিত সময় মেনে ছ’টা দশ নাগাদ ছাড়ল হাওড়া-বড়বিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। ঘণ্টা সাতেকের ট্রেনযাত্রা। ভর দুপুরে পৌঁছলাম বড়বিল। স্টেশনের পাশেই ভাড়া গাড়ির স্ট্যান্ড। আমাদের আগে থেকেই গাড়ি বলা ছিল। তাই দরাদরির ঝামেলায় আর যেতে হল না। 

গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্রই আমাদের রাজ্যের থেকে এখানকার আবহাওয়ার পরিবর্তন টের পেলাম। এখানে লোহার খনি থাকায় রাস্তার ধুলো একদম লাল টুকটুকে হয়ে আছে। আর বড়ো বড়ো মালবাহী গাড়ির মেলা, সেগুলোর গায়েও লেগেছে লালের ছোপ। গাড়ির চালক জানলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, রক্তিম ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে। আধঘণ্টা এই অস্বস্তিটুকু নিয়ে চলার পর আবার প্রকৃতির পরিবর্তন হল। সময়টা ছিল পুজোর মাসখানেক আগের। ওড়িশা রাজ্যে এমনিতেই কাশফুলের ছড়াছড়ি। চওড়া মসৃণ হাইওয়ের দু’পাশে আর ডিভাইডারের ওপর দুধসাদা কাশফুলের আহ্লাদে মাথা দোলানো দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। প্রায় পঁচাত্তর কিলোমিটার রাস্তা এক নিমেষে কেটে গেল। তারপর পেল্লায় উঁচুনিচু পাহাড়ের মতো রাস্তা বেয়ে আমরা এসে থামলাম পান্থনিবাসের দরজায়। আরও একবার মন ভালো হওয়ার পালা। 

এযাবৎকাল ওড়িশা পর্যটনের এই পান্থনিবাস ওড়িশার কোনও জায়গাতেই আমাদের নিরাশ করেনি। বাগানঘেরা এই সাময়িক আবাসের পিছনে সবুজ জঙ্গলভরা ছোট্ট পাহাড়। ঘরে জিনিসপত্র রেখে, আদিম প্রকৃতির একটু ছোঁয়া পেতে পায়ে পায়ে চলে গেলাম পান্থনিবাসের পিছনের রাস্তা ধরে। কিছুক্ষণ মগ্ন নির্জনতায় অবগাহন। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। ঝিঁঝির ডাক প্রকট হচ্ছে। অনেক ওপরে পাহাড়ি রাস্তায় দু’একটা গাড়ির হেড লাইটের ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। অচেনা জায়গা। তাই অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগে ফিরে এলাম পান্থনিবাসে।

এরপর চলল চা-পকোড়া আর তুমুল আড্ডার পালা। কবে, কোথায়, কীভাবে আমরা ঝর্নার গান শুনতে যাব–তার পরিকল্পনা কিছুটা কলকাতা থেকেই করে এসেছিলাম। বাকিটা এইখানে আলোচনা চলল আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে। ঐকমত্যে পৌঁছলে, রাতের খাওয়া শেষে নিদ্রাদেবীর ধ্যানে যে যার ঘরে চললাম। পরের দিন প্রথম দেখা হওয়ার কথা বিখ্যাত ভীম ফলসের সঙ্গে। সকালে উঠে দেখি টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে জলভরা মেঘ। এইরকম দিনে ঝর্নারা বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠে আনন্দে। আমরাও এসেছি, জলপ্রপাতের গুঞ্জন-গান শুনব আর ওদের নৃত্যের উচ্ছ্বাস দেখব বলেই। ব্রিটিশদের উচ্চারণে কেওনঝর। আসলে নাম ছিল কেন্দুঝর। কেন্দুবন ঘেরা ঝর্নাদের উপস্থিতি। কেন্দুঝরের প্রথম রাজা জ্যোতি সিংহ কেন্দুবন ঘেরা এক প্রস্রবণের পাশে নিজের অস্থায়ী রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন। সেখান থেকে এই জায়গার নাম কেন্দুঝর হয়ে, বর্তমানে কেওনঝর।

আমাদের বের হতে বেজে গেল প্রায় আটটা। কিছুটা রাস্তা শহরের মাঝখান দিয়ে চলে, তারপর পড়লাম এসে উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে। যখন গাড়ির চালক জানালেন যে আমরা ভীম ফলসের দরজায় এসে গিয়েছি, তখন প্রথম মনে হলো, আরে, এ তো একটি বিনোদন উদ্যান ! টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হলো। তখনও জানি না, কোন বিশালত্ব অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ! ‘ভয়ংকর সুন্দর’ শব্দবন্ধটি কেন সৃষ্টি হয়েছিল, বুঝতে হলে একবার এই ভীম ঝর্নার সামনে এসে দাঁড়াতে হবে ! 

সকলেই বাকরুদ্ধ ! জনমানবহীন উদার উন্মুক্ত এক বিশাল প্রান্তর জুড়ে গেরুয়া রঙের জল চারদিক থেকে ভীম গতিতে ছুটে এসে বয়ে চলেছে ঢালের দিকে। সেই জলের ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে থাকলে ভয় আর আনন্দ দু’টো অনুভূতি একসঙ্গে আঁকড়ে ধরে। এমনটি আগে কোনওদিন দেখিনি, মন বলে ওঠে। একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে এখানে। তার মাথায় তিনতলা পর্যন্ত ওঠা যায়। ওপরে উঠে ওই চারদিক খোলা পাথর বিছানো পাহাড়ি পরিবেশ আর তার ওপর দিয়ে ধেয়ে আসা লালচে জলের ধারা দেখতে দেখতে নিজের অস্তিত্ব ভুলে এক বিচিত্র অনুভূতির জন্ম হলো। (চলবে)

ছবি : লেখক