জানালা খুললেই কাঞ্চনজঙ্ঘা
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। এই সপ্তাহে পূর্ব সিকিমের ছোট্ট গ্রাম লাংচোক নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমের চেনা ট্যুরিস্ট স্পটগুলির তুলনায় অখ্যাত এই গ্রামে এখনও গিয়ে উঠতে পারিনি আমি। বলতে পারেন, পাহাড় নিয়ে আমার যে পাগলামি, সেই আবেগ ও উৎসাহের কেন্দ্রে দাঁড়িয়েই লাংচোক নিয়ে কলম ধরেছি আজ। প্রথমে ফেসবুকের সৌজন্যে আলাপ এখানকার তরুণ হোমস্টে মালিক নিম দাওয়া শেরপার সঙ্গে। আমার পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসার কথা জেনেই সমমনস্ক মানুষজন আমায় বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠায়। বেশ কিছু পর্যটন গ্রুপও থাকে, যারা আমাকে নিজেদের সঙ্গে রাখতে চায়, ওই একই কারণে। ঠিক এভাবেই নিম দাওয়া শেরপার সঙ্গে আমার ফেসবুক বন্ধুত্ব রচিত হয়। স্বভাবতই তাঁর দেওয়ালে ছবিসহ কিছু পোস্ট দেখে খুব আকর্ষণ অনুভব করি। তাঁর কাছেই জানতে পারি লাংচোক সম্পর্কে। পূর্ব সিকিমের এই গ্রামটির নান্দনিক সৌন্দর্য ছবিতে দেখে যা বুঝেছি, অনির্বচনীয়।
প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমের কয়েকটি জায়গায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে বহুশ্রুত পেলিং, তারপর একেবারে অফবিট ওখরে, শেষে রাবাংলা। প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যতিক্রমী। তবে, সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই পাহাড়ী রাজ্যটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। মানুষজন ভদ্র, সভ্য, বন্ধুবৎসল। রাস্তা বেশিরভাগ অঞ্চলে ভালো হওয়ায় পরিবহন ব্যবস্থাও ঠিকঠাক। সবথেকে উল্লেখযোগ্য এখানকার প্রশাসন। কড়া হাতে প্লাস্টিক বর্জন ও রাস্তাঘাটে ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে সিকিম সরকার। প্রশাসনিক তৎপরতার কারণেই পর্যটকরা খুব বেশিমাত্রায় নিরাপদ বোধ করে এখানে এলে।
সবকিছুর ওপরে রয়েছে অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী, বিশাল উঁচু উঁচু প্রাচীন বৃক্ষরাজি, পাইনের স্বর্গীয় রূপ, ফুল, অর্কিড, চা বাগান, দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম। প্রসঙ্গত, সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবিটাও বড়ই বৈচিত্রপূর্ণ। যেমন,পূর্ব সিকিম তার রূপের নরম আঁচল বিছিয়েছে পর্যটকদের জন্য। পশ্চিম ঠিক বিপরীত, তুলনায় রুক্ষ। তবে, তার রুখু সৌন্দর্যেও পসরা কিছু কম নেই। তারও রয়েছে এক অমোঘ টান। আমি নিজে পেলিং, রাবাংলা ও ওখরে গিয়ে লক্ষ্য করেছি এই বৈচিত্র্য। পেলিং ও ওখরে পশ্চিম সিকিমে, একই উচ্চতায় অবস্থান। রাবাংলা দক্ষিণ সিকিমে। এর উচ্চতা অনেকটা বেশি। এই তিনটি জায়গায় যাওয়ার সুবাদে সিকিম সম্পর্কে যতটুকু আন্দাজ হয়েছে, সেই নিরিখেই লাংচোককে অনুভব করার চেষ্টা করব।
লাংচোক যেতে হয় পূর্ব সিকিমের ছুযাচেন রোড ধরে। জেলা গ্যাংটক। রংপো বাজার ও রংলি বাজার পড়ে পথে। আদতে রংলি বাজার থেকে একঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত লাংচোক। উচ্চতা মোটামুটি ৬৭০০ ফুট। অফবিট লাংচোকের শরীর জুড়ে আজও খেলা করে অপূর্ব নির্জনতা। নিম দাওয়া শেরপার হোমস্টে-র নাম লাংচোক টপ নেচার ভিউ হোমস্টে। নামটি কতখানি সংগতিপূর্ণ, তা নিমের পাঠানো ছবিগুলি দেখেই বুঝতে পারছিলাম। লাংচোকের মুখ্য আকর্ষণ অবশ্যই কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিম জানালেন, এককথায় মন্ত্রমুগ্ধ করে দেওয়ার মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মেলে হোমস্টে-র ঘরের জানালা দিয়েই। আর হোমস্টে-র ছাদে উঠলেই তাকে দেখতে পাবেন একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখাও এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা, জানান নিম।
হোমস্টে-র ঘরগুলি পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত। গিজারের সুবিধা থাকায় ঠান্ডা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। রয়েছে ৪ বেড (৭টি) ও ৩ বেড (২টি) যুক্ত মোট ৯টি ঘর। অর্থাৎ পরিবার বা বন্ধুবান্ধব সহ যেতে কোনও অসুবিধা নেই। সামনে অনেকটা ছড়ানো সবুজ ঘাসের লন। আছে বাচ্চাদের ছুটোছুটি করার প্রশস্ত আয়োজন। হোমস্টে-র বাগানে অর্গানিক পদ্ধতিতে ফলে শাকসবজি। পুরো গ্রামেই কৃষিক্ষেত্রে ওঁরা রাসায়নিক সার বর্জন করেছেন বহু আগেই। অতএব, সেইসব তাজা ফসলই চলে আসে অতিথির খাওয়ার টেবিলে। ওঁদের স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যপূর্ণ রন্ধনপ্রণালীতে যা হয়ে ওঠে দারুন সুস্বাদু। নিম দাওয়া শেরপার হোমস্টে-তে নেপালি, সিকিমিজ ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় চেনা পদও যথাসম্ভব প্রস্তুতের চেষ্টা করা হয়। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চল, বাজারহাটও দূরে। অতএব পর্যটকদেরও সেটা মাথায় রেখেই যেতে হয় এইসব অঞ্চলে। চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে রাখতে হয় সমঝোতার মনোভাব।
ছোট্ট এই গ্রামে মোটামুটি কুড়ি ঘর পরিবারের বাস। এলাচ ক্ষেতে চাষবাসই মূল জীবিকা। আর সকলেরই আছে কিছু কিছু কৃষিজমি বা মুরগির পোলট্রি। সেখানকার শাকসবজি ও ফলমূল, ডিম ও মাংস দিয়েই নিজেদের পেটপুজো অথবা সামান্য বিক্রিবাটার মাধ্যমে আয়। লাংচোকে বাস করেন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ। বছরে একবার বড় করে দুর্গা পূজা ও কালি পূজার আয়োজন করা হয় নিকটবর্তী ওল্ড রক দেবী মন্দির ও কালী মন্দিরে। ধুমধাম করে পালিত হয় বৌদ্ধজয়ন্তী ও সাগা দাওয়া–কাছের অগমলোক গুম্ফায়। সব উৎসবই মিলেমিশে রঙিন করে তোলেন গ্রামবাসী, আন্তরিক আবেগকে রসদ করে।
দূর দূর পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালা ঘিরে রেখেছে অঞ্চলটিকে। ঘন সবুজ জঙ্গল, সেখানে নানাজাতের গাছগাছালি আর এলাচের ক্ষেত। সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত পরিবেশ। পক্ষীপ্রেমীরা এখানে এসে বিশেষ আনন্দ পাবেন নিঃসন্দেহে। ট্রেকিংয়ের ক্ষেত্রেও বেশ আকর্ষণীয় এই গ্রাম। এই রাজ্যের সব অঞ্চলেই রয়েছে নানাজাতের পাখি। আমার মনে আছে ভার্সে ও হিলে যাওয়ার পথে পক্ষীপ্রেমী ও ট্রেকার পাগল পর্যটকগণ ওখরেতেই ক্ষণিক বিশ্রাম, ফ্রেশ হওয়া বা লাঞ্চ ইত্যাদি সারতেন। লাংচোকে সাইট সিয়িং থেকে শুরু করে রাইডিং, সে হানিমুন কাপলই হোক বা পুরো পরিবার, ব্যবস্থা করা হয় হোমস্টে থেকেই। দেখার মধ্যে রয়েছে সিল্ক রুট, জুলুক, কুপুপ বাবা মন্দির, পৃথিবী বিখ্যাত ছাঙ্গু লেক, পদমচেন, মামখিম, থাম্বি ভিউ পয়েন্ট, আরিটার লেক, রোলেপ বুদ্ধ ফলস, হ্যাঙ্গিং ব্রিজ ইত্যাদি ও বরফে ঢাকা নাথাং উপত্যকা।
নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে লাংচোক পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘণ্টা মতো। গাড়ি ভাড়া ৪০০০/৪৫০০। গ্যাংটক পর্যন্ত শেয়ারে গিয়ে, সেখান থেকে রিজার্ভ গাড়িতে লাংচোক যেতে পারেন। পাক্যং গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট থেকে হোমস্টে পৌঁছতে লাগে ২ ঘণ্টা। গাড়ি ভাড়া ২৫০০/৩০০০ টাকা পিক আপ ও ড্রপ। থাকা-খাওয়ার খরচ দিন-প্রতি, জন-প্রতি ১১০০ টাকা। বর্ষাকাল ছাড়া যে কোনও সময়েই যেতে পারেন। শীতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। সেই মতো শীত পোশাক নিয়ে যাওয়া জরুরি। সঙ্গে রাখুন টর্চ, মোমবাতি-দেশলাই, ফার্স্ট এড বক্স ও জরুরি ওষুধ এবং কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফি প্যাকেট এবং ফ্লাক্স। বুকিং ও অন্যান্য তথ্য জানতে যোগাযোগ করুন
97333 25972, 8016294972 নম্বরে।
ছবি : নিম দাওয়া শেরপা