Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। বাংলায় বৈশাখ আসে তাঁর জন্মদিনের বার্তা নিয়ে। প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে বিশেষ রচনা লিখেছেন অদিতি চক্রবর্তী

তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বাধুনিক পুরুষ। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। শুধু কবি-সাহিত্যিক-সঙ্গীতস্রষ্টা-নাট্যকার‌ই তো ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। একজন আদ্যন্ত সমাজ সচেতন, মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ এক মহামানব। আমাদের, সারা বিশ্বের প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তিনি যখন ২২ বছরের যুবক, বিবাহ করলেন যে নারীকে, সে তখন ৯ বছরের এক বালিকা ! হ্যাঁ, নিতান্তই পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে হয়ে যেত তখন মেয়েদের। যদিও, সেই সময়ে দাঁড়িয়েই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আধুনিকতার স্ফূরণ ঘটিয়েছিল অন্দরমহলে। তা সত্বেও বাল্যবিবাহ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি তাঁরা। আসলে প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতা তো শুধু ব্যক্তিগতভাবে আসে না। আসে সমষ্টিগতভাবে।

Images 27
নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি 7

ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটলে, জানতে পারা যায় এক চমকপ্রদ তথ্য। একদা স্থানীয় এক মুসলমান শাসকের চক্রান্তে রবীন্দ্রনাথের আদি পরিবারের একটি অংশ মুসলমান হয়ে যান, বাকিরা তারই ফলশ্রুতিতে পিরালী ব্রাহ্মণ রূপে পরিগণিত হন। নিজের পরিবারের ‘পিরালী’ পরিচয় এবং ‘ব্রাহ্মধর্ম’–রবীন্দ্রনাথের পক্ষে  এর থেকে দূরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে, ঠাকুর পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা এই পতিত ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে পাত্রপাত্রী সংগ্রহ করতে হতো। তরুণ রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। অন্যত্র পাত্রীর অভাব হওয়ায়, তাঁকে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের নায়েব বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর পাণি গ্রহণ করতে হয়।

220Px Rabindranath Tagore Mrinalini Devi 1883
নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি 8

সেদিন স্বেচ্ছায় না হোক, পরিবারের বিরুদ্ধে যাননি রবীন্দ্রনাথ। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছায় কলকাতায় জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে ব্রাহ্মমতে বিয়ে করেন রবীন্দ্রনাথ ভবতারিণীকে। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র তিনি নিজে হাতেই লিখেছিলেন। পত্রের উপরে লিখেছিলেন মধুসূদন দত্তের কাব্যের একটি পংক্তি–আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায় ! বিয়ের পর তিনি ভবতারিণীর নামকরণ করেন মৃণালিনী। বিয়ের পর নাম পরিবর্তনের একটা ধারা অবশ্য এমনিতেই প্রচলিত ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। 

শোনা যায়, বাসরঘরে দরাজ গলায় মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে গান ধরেন রবীন্দ্রনাথ–আ মরি লাবণ্যময়ী/কে ও স্থির সৌদামিনী/পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/মার্জিত বদনখানি!/নেহারিয়া রূপ হায় /আঁখি নাহি ফিরিতে চায়/অপ্সরা কি বিদ্যাধারী/কে রূপসী নাহি জানি…! মহর্ষি খুব স্নেহ করতেন তাঁর এই পুত্রবধূটিকে। বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ী দেবী ক্ষীণতনু মৃণালিনীর শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের উন্নতির ভার নিলেন। মৃণালিনীকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মহর্ষি তাঁকে ভর্তি করলেন কলকাতার লরেটো হাউসে। কিনে দিলেন স্লেট, বইপত্র। তৈরি হলো মৃণালিনীর স্কুলে যাবার পোশাক।

Images 24
নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি 9

মৃণালিনী ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠছিলেন। তবে, কিছু অনুবাদ আর পত্র-পত্রিকায় কিছু লেখা ছাড়া তেমন ভাবে তিনি কিছুই লেখেননি। কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী মৃণালিনীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেছিলেন, যাঁর স্বামী বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখক তাঁর আর নিজের লেখার কী প্রয়োজন! তাঁর এ বক্তব্যের মাঝেই ফুটে ওঠে স্বামীর লেখালেখির প্রতি কতটা সমর্থন ছিল মৃণালিনীর ! বিয়ের পর নির্দিষ্ট কোথাও স্থিতু হতে পারেননি মৃণালিনী–কলকাতা, শিলাইদহ, সোলাপুর আর শান্তিনিকেতনে বারবার বাসাবদল করেছেন। যদিও এই বিষয়ে তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল বলে শোনা যায় না। আর দশটা বাঙালীবধূর মতোই মৃণালিনীও স্বামী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনকে রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন ভোজন রসিক, মৃণালিনী তেমনই ছিলেন রান্নাপটু। মৃণালিনীকে নিয়ে যে কয়েকটা স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, তার মধ্যে বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে মৃণালিনীর রান্নার গল্প। স্ত্রীকে নিত্যনতুন রান্নার ফরমায়েশ করতেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী যে সেই ফরমায়েশ খুশি মনেই গ্রহণ করতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Images 25
নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি 10

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর দুই পুত্র এবং তিন কন্যাসহ সন্তান ছিলেন পাঁচ জন–মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)। একবার, বিয়ের তিন মাস পর, কলকাতা জাদুঘরের প্রথম প্রদর্শনী দেখতে অন্যদের সঙ্গে যাবেন মৃণালিনী। পরেছেন বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের উপর জরির কাজ করা পাড় বসানো একটা শাড়ি। হাতে একটা পাত্রে মিষ্টি খেতে খেতে হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথ। সুন্দর সাজে মৃণালিনীকে দেখে চড়া সুরে গেয়ে উঠলেন, ‘হৃদয়কাননে ফুল ফোটাও/ আধো নয়নে সখি, চাও চাও’! রবীন্দ্রনাথ নানা নামে সম্মোধন করতেন মৃণালিনীকে–কখনও ডাকতেন ভাইছুটি, কখনও ছুটকি বা ছোট ব‌উ বলে।

ধীরে ধীরে মৃণালিনী হয়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথের যোগ্য সহধর্মিনী। স্বল্পভাষী প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী মৃণালিনী কিন্তু বেশ অভিমানীও ছিলেন। তাঁর প্রেমের প্রকাশও ছিল খুব অন্তর্মুখী। রবীন্দ্রনাথের লেখা ৩৬টি পত্রের উত্তরে মৃণালিনীর লেখা কোনও চিঠি সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে, কবির পাঠানো চিঠিগুলো তিনি সযত্নে রেখে দিতেন। শান্তিনিকেতনে আশ্রম সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কবি বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন মৃণালিনী দেবীর ওপর। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটতে শুরু করল একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা।

Images 26
নিজেকে রবির আলোতেই আলোকিত করেছেন তিনি 11

একেই তো তিনি দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই ছিলেন প্রবল সমস্যায় জর্জরিত। একেবারে অপাত্রে দান করেছিলেন তাঁর কন্যাদের। এই বিয়েতে মত ছিল না মৃণালিনী দেবীর। কিন্তু তিনি বিরোধিতাও করেননি। ১৯০২-এর মাঝামাঝি এতই অসুস্থ হয়ে উঠলেন মৃণালিনী যে ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে নিয়ে যেতে হল কলকাতায়। এই অসুস্থতা নিয়ে তখন বেশ কিছু কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকে বলেন, সেই সময় মৃণালিনী দেবী অন্তঃসত্তা ছিলেন। শান্তিনিকেতনে ওই অবস্থায় তিনি পিছল পথে আছাড় খেয়ে পড়ে যান এবং ওঁর অসুস্থতার সূত্রপাত এখানেই।

প্রায় দুই মাস নিরলস মৃণালিনীর সেবা করলেন রবীন্দ্রনাথ। অসুখ ধরা না পড়ায়, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হলো। যদিও, শেষরক্ষা হল না তাতে। লালবাড়ির এক কোণে, মৃণালিনীর ঘরে নেমে এলো অন্ধকার। কোলের ছেলেটিকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইছিকেন না এক অসহায় মা! কিন্তু বিধি বাম, তাই,  মাত্র তিরিশ বছর বয়সেই ইহলোকের মায়া ছাড়িয়ে পাড়ি দিলেন তিনি পরলোকে। রেখে গেলেন তাঁর প্রাণাধিকেষু কবিবর আর পাঁচটি সন্তানকে। না, কবির মতো সন্তান হারোনোর শোক তাঁকে পেতে হয়নি।

সারা পৃথিবীর মানুষ যাঁর সৃষ্টির সম্ভারে মুগ্ধ, বিস্মিত, বিনম্র শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় যাঁকে ঈশ্বরের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই বাঙালির প্রাণের ঠাকুর বিশ্বের কবি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল জীবনের পাশাপাশি  নীরবে বয়ে চলেছিল সংসার জীবন! সেখানেও অনির্বচনীয় তিনি। ব্যাক্তিগত শোক, দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণাকে মুক্ত বিহঙ্গ করে ছেড়ে দেন তিনি সৃষ্টির আকাশে। আমরা সেই সৃষ্টির ঝর্ণাধারায় প্লাবিত হই বারবার।

তথ্য সূত্র–

  • ‘চিঠিপত্র’ প্রথম খন্ড
  • ‘রবীন্দ্রজীবনী’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
  • ‘প্রথম আলো’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
  • কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত