বাজার মাথায় বাজার হৃদয়ে
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
ইদানীং শিলিগুড়ি শহরকে ঘিরেই জীবন অতিবাহিত। কলকাতা মোটামুটি স্মৃতির শহরে পরিণত। অন্যদিকে অতিমারীর সৌজন্যে রাস্তাঘাটে চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার ফলে এ শহরকেও যে খুব ভালো চেনা হলো, তা নয়। যে পাড়ায় থাকি, সেটুকুই যা চেনা। কেনাকাটা অনলাইনেই বেশি। পুজোর অনুষঙ্গে বাজার নিয়ে লিখতে গিয়ে তাই কলকাতাকেই মনে পড়ে যায়। আজকাল কলকাতায় গেলে, ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। যেখানে যেখানে কাজ, সেই রুটেই যাতায়াত।
এরই মধ্যে একদিন একটু পুরোনো এক পাড়ায় গেছি । পুরোনো পাড়া মানেই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। আর সব অঞ্চলের মতোই এদিকটাও বদলেছে। ঝাঁ চকচকে মেট্রো শহরের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইছে। ফুটপাত ধরে চলতে চলতে সেই পরিবর্তনের হাওয়া গায়ে মেখে নিচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়লো বিবর্ণ চেহারার একটি দোকানের দিকে। সন্ধ্যা হয়েছে। অন্ধকার নামতে না নামতেই চারপাশ আলোয় ঝলমলে। শুধু এই দোকানটি যেন যুগের ওপার থেকে কেমন এক বিষণ্নতার ম্লান আলো মেখে দাঁড়িয়ে। জনা দুয়েক কর্মী বসে আছেন কাউন্টারের ওপারে। ক্রেতা একটিও নেই। ভিতরের সামগ্রীগুলিরও দৈন্য দশা। কারণটা স্বাভাবিক। বিকিকিনি না হলে, নতুন নতুন সামগ্রী আসবে কি করে ? একটু দূর থেকে লক্ষ্য করি সবটাই। কাছে যেতে দ্বিধা। আমার যে কিছুই কেনার নেই। অথচ বড় চেনা এই দোকান। শৈশবে বহুবার এসেছি মা-বাবার সঙ্গে। পুজোর বাজারের পুরোটাই প্রায় এখান থেকে হতো আমাদের।
যেটা বলার, যেটা সবকিছু বদলে দিয়েছে, বিকিকিনির ধরণ পর্যন্ত, সে আমাদের যাপন সংস্কৃতি। অর্থাৎ লাইফ স্টাইল। আগে আমরা বাজারে যেতাম। এখন বাজার আমাদের ঘরে আসে। একটা সময় বছরে একবার স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল হতো, পয়লা বৈশাখের আগে–চৈত্র সেল ! তাতে মধ্যবিত্তের খরিদ্দারিতে উৎসাহের জোয়ার লাগতো। আমাদের তো সেই অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল না যে, সেলের বাজারে হামলে পড়ে কিনবো। মাকে দেখেছি সারা বছর একটু একটু করে পুজো বা পয়লা বৈশাখের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করছেন। শুধু পরিবার তো নয়, কিছু দেওয়াথোওয়া পর্বও থাকতো। হ্যাঁ, অভাবের সংসারেও এই রেওয়াজ ছিল তখন।
একটা কথা উল্লেখ জরুরি–কেনাকাটার ব্যাপারটা সেসময় ছিল পুরোপুরি এলাকাভিত্তিক। আমার দক্ষিণ কলকাতায় বেড়ে ওঠা। শুরুতে গড়িয়া, বাঘাযতীন বা যাদবপুর। এরপর আমাদের দক্ষিণ কলকাতার মানুষের দৌড় বড় জোর ঢাকুরিয়ার দক্ষিণাপন বা গড়িয়াহাট মার্কেট। উত্তর কলকাতাবাসীর জন্য হাতিবাগান মার্কেট। কেউ কেউ মধ্য কলকাতায় ধর্মতলায় আসতেন। হাওড়ায় মংলা হাট। বড়বাজারে মূলত পাইকারি বেচাকেনা। সেই বড়বাজারেরও চেহারা বদলালো সময়ের সঙ্গে। ফ্যাশনেবল লোকজন নিউ মার্কেটে ব্যাপক হারে আসাযাওয়া শুরু করলো, সেও তো কত পরে। দোকান নয়, শো-রুম কনসেপ্টও একটু একটু করে বিকিকিনির জগতে প্রবেশ করছে তখন।
এত কিছু সত্ত্বেও নিম্নবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্ত মানুষও চট করে গন্ডির বাইরে যেত না। বলা উচিত ভয় পেত। পারিবারিক বা সামাজিক উৎসবে কেনাকাটার উদ্দেশে লক্ষ্যে থাকতো চেনা দোকান ও দোকানী, যেখানে কর্মচারীরাও অতি পরিচিত। কার পকেটের কেমন অবস্থা জানতেন ওঁরা। সেই হিসেবেই বিক্রির চেষ্টা করতেন। বড় জোর খুব পছন্দের কিছু নিতে না পারলে, বলতেন ‘নিয়ে নিন, পরে সুবিধামতো দিয়ে দেবেন’। আমার স্কুলমাস্টার বাবা-মা এই সুবিধাটুকু নিতেও অবশ্য রীতিমতো সংশয়ে থাকতেন। ভয় ছিল, পরে দেওয়া মানে সেও তো এক বোঝা।
যুগ পালটেছে। এলাকাভিত্তিক দোকানগুলির বেশির ভাগেরই এখন ঝাঁপ বন্ধ। শহর বা শহরতলীর বড় মার্কেট, সেও সংখ্যায় কমেছে। বড় মার্কেটের ভিতর কিছু দোকান অবশিষ্ট আছে। যতদূর জানি নামী দোকান ছাড়া পরিস্থিতি সেখানেও সুবিধার নয়। একালের ক্রেতার হৃদয় জুড়ে আছে শপিং মল। এক্কেবারে ঝাঁ চকচকে। প্রচুর শো রুম। সবই নামী দামি ব্র্যান্ড। আর কি সুন্দর সব ছেলেমেয়ে, স্মার্ট, সুবেশ, মিষ্টভাষী। কেনাকাটার ইচ্ছেটা তীব্র হয়, এমন মধুর আমন্ত্রণ শো-রুমের শরীর জুড়ে। আমন্ত্রণ না ফাঁদ ! সে হোক, ফাঁদে পড়ার লোকের অভাব নেই।
মাল্টিপ্লেক্স থেকে নামী ব্র্যান্ডের চেইন শপ, এরা সারাক্ষণ টিভিতে, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে মাথায় হাতুড়ি মেরে জানান দিতে থাকে। রঙিন ও লোভনীয় অফারগুলি স্বপ্নের মতো উড়তে থাকে সামনে। সে প্রলোভন এড়ায়, সাধ্য কার ! অনেকেই শুনেছি কেনাকাটার কিছু না থাকলেও শপিং মলে যেতে বেশ পছন্দ করে। শপিং মলের মাল্টিপ্লেক্স রূপান্তর তো এদের জন্যই। এখানে শুধুই নানা পণ্যের শো-রুম নয়, আছে রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার এবং আরও কত কি ! কিছু না হোক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরাম তো মিলবে রে বাবা ! মোদ্দা কথা লোকজন এখন টাইম পাসের জন্যও শপিং মলে ছোটে।
নাহ, এখানেই বাজার যুগান্তের গতি স্তব্ধ নয়। শপিং মল মাল্টিপ্লেক্স হলো। এরপর আর এক ধাপ অগ্রগতি। মানুষের কেনাকাটার দিগন্তে আরও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা । বিকিকিনির ক্ষেত্রে শপিং মল এখন আর মুখ্য আকর্ষণ নয় ! কোন দুঃখেই বা থাকবে ? এত এত অন লাইন ব্যবস্থা থাকতে ? আরে বাবা ঘরে এসে দিয়ে যাবে, যা চাই। ৩৬৫ দিন, ২৪ ঘন্টা যখন যা চাই, না চাইলেও বাজার আমাদের সামনে। সেখানে সব মেলে। সব ! সব ! শুধু জিনিস ? তা ছাড়াও নানা অফার ? উঃ , এ সুযোগ ছাড়া যায় ? বাজার আমাদের সামনে নয়, মাথায়। বাজার হৃদয়ে। জীবন এখন বাজারময়। অন লাইন শপিং ব্যাবস্থায় অ্যাপ আছে। স্মার্টফোনের শরীর জুড়ে আছে তারা। কেনাকাটার প্রয়োজন থাক না থাক, টাইম পাসের জন্য উঁকি মারতে দোষ কি ? উঁকি মারতে গিয়ে যদি ফাঁদে পড়ি, তাতেই বা দোষ কি ? নাহ, কোনও দোষ নেই। আমরা না কিনলে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলিই বা ব্যাবসা করবে কি করবে ?
কিন্তু সেই সব ছোট ছোট দোকান ? অনুজ্জ্বল কক্ষের উজ্জ্বল আন্তরিক মুখের দোকানী, তারা সব কোথায় যাবে ? বা কোথায় গেল ? পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে কিভাবে বেঁচে আছেন তাঁরা ? আর কোথায় হারিয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতার সেই অনাবিল সম্পর্কের রং ? যে সম্পর্ক রচিত হয়েছিল পুরুষানুক্রমে ! তাঁদের কথা ভাবতে বয়েই গেছে আমাদের। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেওয়ার যুগ শেষ। এখন বিশ্বজনীন হওয়ার প্রতিযোগিতা। আমারই ভুল ! কোথায় এক পাড়ার দোকান দেখে স্মৃতিভারে আক্রান্ত হলাম। ঠিক নয় এই পিছন পথে হাঁটা। আমরা উন্নতির রথে উঠেছি। দ্রুত চলেছি সামনে। যেখানে সব রঙিন, ঝকঝকে। মলিন স্মৃতির দিন উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে লাভ নেই।
শপিং জিন্দাবাদ !!!