মগ্ন নির্জন নেতারহাট
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। এই সপ্তাহে নেতারহাট নিয়ে লিখেছেন মৌসুমী ঘোষ।
যশোবন্ত শুধালো, এটা কি গাছ?
বললাম, জানি না।
অর্জুন গাছ। এ জঙ্গলে অর্জুন আর শিশু প্রচুর আছে। তাছাড়া আছে শাল। সবচেয়ে বেশি। শালকে এখানকার লোকেরা বলে শাকুয়া। তাছাড়া আরও অনেক গাছ আছে। কেঁদ, পিয়ার, আসন, পন্নান, পুঁইমার, গমহার, সাগুয়ান এবং নানারকমের বাঁশ। ঝোপের মধ্যে পুটুস, কুল, কেলাউন্দা এবং অন্যান্য কাঁটা গাছ। ফুলের মধ্যে আছে ফুলদাওয়াই, জীরহুল, মনরঙ্গোলি, পিলাবিবি, করোঞ্জ, সফেদিয়া আরও কত কি ! আর কী মিষ্টি মিষ্টি রঙ, আর তাদের যে কী গন্ধ ! এ জঙ্গলে হরবখত যে হাওয়া বয়, তা হামেশা খুশবুতে ভারী হয়ে থাকে…!
না না এ আমার বর্ণনা নয়। স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহ তার ‘কোয়েলের কাছে’ বইতে লিখে গেছেন। আর আক্ষরিক অর্থেই কোয়েলের কাছে এসে চরম রোমান্টিক বুদ্ধদেব গুহকে স্মরণ করবো না, তা কী হয় ? এই যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জঙ্গলকে জানা-চেনা-অনুভব করা, এ তো যশোবন্তের কথা নয়, এ স্বয়ং লেখকের কথা। এমন গভীরভাবে জঙ্গলকে জানার জ্ঞান কোনও ভূগোল বইই দিতে পারবে না। একজন অনুভবী সাহিত্যিকই পারেন এমন গহনে ডুব দিতে!
ঘর ছেড়ে পথে পা রাখার সুযোগ পেলে, সবচেয়ে বেশি যা টানে, সে হলো পরমা প্রকৃতি। আর প্রকৃতিপ্রেমী মাত্রই জানেন, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড হলো প্রকৃতির রূপ-রস-রঙের অপরূপ এক ক্যানভাস। এবারে যাত্রা সেই দিকেই–গন্তব্য নেতারহাট। দার্জিলিঙ যেমন সমস্ত পাহাড়ের রানি, তেমনই ছোটনাগপুরের রানি হলো নেতারহাট। অবস্থান ঝাড়খন্ডের লাটেহার জেলায়। ঘন জঙ্গল–একদিকে চার মাইল অন্যদিকে আড়াই মাইল। এমনই অপার্থিব এর সৌন্দর্য যে না গেলে ক্ষতি পর্যটকের ! নেতারহাটের উচ্চতা প্রায় কালিম্পঙের মতো। তাই মেঘ-মেঘ, ঠান্ডা-ঠান্ডা আমেজ পেতে এটা আদর্শ জায়গা। সরু পাকদন্ডী রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হতে পারে বুঝি উত্তরবঙ্গের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছেন।
তবে, এখানে তিস্তা নেই, আছে কোয়েল। বুদ্ধদেব গুহর হাত ধরে বাঙালির কোয়েল নদী-রোমান্স, যার উল্লেখ শুরুতেই করেছি। এই কোয়েল ধরে গেলেই পৌঁছে যাবেন পালামৌ টাইগার রিজার্ভ প্রোজেক্ট। সেই জঙ্গলের অংশই নেতারহাট। মন ভরিয়ে দেবে, চোখ জুড়িয়ে দেবে এর রাস্তাঘাট আর নিশ্চুপ জঙ্গল। তার মানে এই নয় জন্তু-জানোয়ার নেই। ঢের আছে। তাই তো সন্ধের পড় বেরোনো বারণ। নেতারহাটে সকাল বিকেল দুই মনোরম। তাই সানরাইজ পয়েন্ট আছে, আছে সানসেট পয়েন্টও।
ঠিক নেতারহাট ঢোকার মুখেই পাবেন কোয়েলের দেখা। ছোট্ট একটা ব্রিজ আছে। দাঁড়িয়ে দেখুন বা নেমে পড়ুন নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে একেবারে কোয়েলের বুকে। এই সুযোগটা কিন্তু অন্য কোথাও পাবেন না। যদি বর্ষায় যান, একটু আধটু অসুবিধা হলেও সবুজের যা রূপ দেখবেন, সঙ্গে ঝর্নার উচ্ছলতা, তা অন্য সময় পাবেন না। আর শীতকালে এলে পাবেন বাগান ভরা ন্যাসপাতি। জানিয়ে রাখি, এসব দেখতে হলে দুটো দিন অন্তত হাতে নিয়ে আসতেই হবে।
ভোর-ভোর সূর্যোদয় দেখে নিন। থাকার জায়গাগুলো এর আশেপাশেই। এরপর ঘন জঙ্গলের সুবাস নিতে নিতে চলে যান কোয়েল ভিউ পয়েন্ট। পাইন গাছের সারিতে রোদ্দুর আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে হারিয়ে যেতে পারেন। এটা বেশ উঁচু একটা জায়গা। এখান থেকে কোয়েলের আকাবাঁকা চলন দেখার অভিজ্ঞতা বেশ অন্যরকম। অনেকটা দূর পর্যন্ত সারি সারি পাহাড়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোয়েল চলে গেছে পালামৌ-এর দিকে। এরপর ন্যাসপাতি বাগান দেখে চলে যান ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্টে। সূর্যদেব এখানে বেশ সময় নিয়ে অস্তাচলে যান। তাই সময় নিয়ে দেখুন আকাশ রাঙানো সূর্যের অস্তাচল যাত্রা।
নেতারহাট এলে সবাই আপার ঘাগরি, লোয়ার ঘাগরি দেখতে যান। এগুলো ঘন জঙ্গলের মধ্যে থাকা ঝর্না। আপার ঘাগরি দর্শনীয় হলেও, লোয়ার ঘাগরি না গেলেও চলে। বরং একটু কষ্ট করে চলে যান লোধ ওয়াটার ফলস দেখতে। ৬০ কিলোমিটার যেতে হলেও, যা দেখবেন, মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে চিরদিন। বেশ গা ছমছমে একটা পরিবেশ। ৪৬৮ ফুট ওপর থেকে নেমে আসছে উত্তাল জলরাশি। দুদিক বললে ভুল হবে, যেন চারপাশ থেকে নেমে আসছে স্বচ্ছ জলের ধারা। যেন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঝাড়খণ্ডের সবথেকে উচু জলপ্রপাত এই লোধ।
আসলে নেতারহাটে কি দেখলেন, কি দেখলেন না সেটা বড় কথা নয়। পুরো অঞ্চলটাই দেখার মতো। যে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে হাঁটবেন বা গাড়িতে ঘুরবেন পুরোটাই দেখার, উপভোগ করার। যেমন নির্জন আর মগ্ন এক পরিবেশ, তেমনই রোমান্টিক ! ট্যুরিস্ট স্পট হলেও, খুব বেশি ভিড় হয় না। লোকজন কম, তাই হইচইও নেই তত। আর এই কোলাহল না থাকাটাই যেন নেতারহাটকে সুন্দরী করেছে। খুব গরম বাদ দিলে, নেতারহাট সবসময়ই সুন্দর। শীতে জঙ্গলে পাতাঝরার খেলা। বসন্তে নতুন পাতার জন্ম। বর্ষার সবুজের সমারোহ নিয়ে তো আগেই বলেছি। তবে, নেতারহাটে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলো অসাধারণ। বর্ষা পাবেন, মেঘ পাবেন আর গরমও কম থাকবে।
এবার আসি যাতায়াত প্রসঙ্গে। কলকাতা থেকে ট্রেন বা প্লেন যেভাবেই যান, প্রথমে রাঁচি পৌঁছতে হবে। ওখান থেকে সরকারি-বেসরকারি বাসে নেতারহাট। এছাড়া গাড়ি ভাড়াও করতে পারেন। হাওড়া থেকে শতাব্দী এক্সপ্রেস, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস-এ যেতে পারেন রাঁচি। রাঁচি থেকে নেতারহাট ১৫০ কিমি। গাড়িতে গেলে ঘন্টা চারেক লাগবে। বাসে সামান্য একটু বেশি। ট্রেন ও প্লেন ভাড়া তো ইন্টারনেট সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। বাস এবং গাড়িভাড়া সংক্রান্ত জানকারির জন্য থাকার বুকিং যেখানে করবেন, সেখানেই খোঁজ করলে লেটেস্ট তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা।
থাকার জন্য নেতারহাটে কিন্তু বাছাবাছির সুযোগ কম। হাতে গোনা বেসরকারি হোটেল আর আছে সরকারি ‘প্রভাত বিহার’। এখানে টেন্টও আছে। আর ঘরও আছে নানারকম। তবে, বুকিং সব অনলাইনে এবং সেটা আগাম করে নেওয়াই ভালো। নেতারহাট লেকের কাছে আছে লেক ভিউ রিসর্ট। বেশ বড় মাপের হোটেল। অনেকটা জায়গা নিয়ে, বেশ ছড়ানো ছেটানো। আছে রবি এন্ড শশী লজ, পুলিশ স্টেশন রোডে। সানরাইজ পয়েন্টের কাছে আছে রয়েল রেসিডেন্সি। সবই অনলাইন বুকিং। এছাড়া আছে নেতারহাট ডাকবাংলো। মাত্র দুটো ঘর। তাই মূলত সরকারি অফিসাররাই বুকিং পান। ডাকবাংলোয় থাকার জায়গা না পেলেও একবার দেখে আসতে পারেন। পাহাড়ের ওপরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ব্রিটিশ আমলের ডাকবাংলোর হাতায় বসে যদি এককাপ চা-ও খেতে পারেন, তাই বা কম কি!
- যোগাযোগ
Lake View Resort–Lake Road, Near Van Atithi Sadan. এদের Website-এ গিয়ে বুকিং করতে হবে।
Ph : 09693512065
Ravi and Shashi Lodge–Police Station Road,
Ph : 09934769927
Royal Residency–New Durga Chowk. J W S F Main Road, Ph : 09470938399
Pravat Bihar–Near Bus Stand,
Ph : 09102403883