মন চলো হিমাচলে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। ডাকছে পাহাড়, ডাকছে নদী…! স্বর্গীয় সৌন্দর্যে অনাবিল হিমাচল প্রদেশের কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে লিখেছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়। ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব আজ।
হিমাচল প্রদেশ বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বরফে ঢাকা হিমালয়। মাঝে মাঝে হালকা তুষারপাত। পার্বতী নদীর উচ্ছল তরঙ্গ আর পাইন, ফারের জঙ্গলে ঘেরা এক অপূর্ব নিসর্গ ! শেষ পর্যন্ত এ বছরের মার্চ মাসে সেই ইচ্ছেপূরণ হল। মন চলো হিমাচল বলে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিমানেপথে চন্ডীগড়। সেখান থেকে হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা। পরিকল্পনা মতো সিমলায় হোটেল বুকিং করা ছিল আমাদের। প্রসঙ্গত, এই প্রথম ভিসতারা বিমানে চাপা। টিকিট করার পরেই অভিজ্ঞ এক পর্যটক জানালেন, এই বিমান তো খুব লেট করে। তাঁর কথায় পৌঁছনোর আগেই দুশ্চিন্তা শুরু। লেট হলে, সবদিক থেকেই মুশকিল।
বিমানবন্দরে পৌছনোর পরে সেই ব্যক্তির কথা সত্যি প্রমাণিত হলো। পৌঁছলাম আধ ঘন্টা লেটে। যাই হোক, বিমানবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ড্রাইভার হংসরাজ বর্মা। আমাদের পুরো সফরের সঙ্গী ছিলেন এই মিতভাষী, হাসিমুখের মাঝবয়সী ব্যক্তিটি। প্রায় ঘন্টা চারেক পর পৌঁছলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেল রয়্যাল রিজেন্সিতে। চণ্ডীগড়ে সে সময়ে বেশ গরম। আর সিমলায় আমরা যখন সাতটা নাগাদ হোটেলে ঢুকলাম, তখন বাইরের তাপমাত্রা সাত ডিগ্রি। হালকা পোশাক পরেছিলাম বলে একরকম কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে প্রবেশ।
হোটেলটা সমতল থেকে অনেকটা ওপরে। তিনটে পাকদন্ডী পেরিয়ে উঠতে হয়। আমাদের হোটেল নেওয়ার আগে সব সময় একটাই চাহিদা থাকে, সেটা হলো ভিউ রুম–সে পাহাড় হোক কিংবা সমুদ্র। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। হোটেলে ঢুকেই জানলায় চোখ রেখে দেখলাম রাতের তারাদের অপরূপ আলোয় ঝিকিমিকি পাহাড়। প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেললাম জায়গাটাকে। সিমলার জন্য আমাদের বরাদ্দ ছিল সাকূল্যে তিনটে দিন। প্রথম দিন তো রাত করে হোটেলে ঢোকার কারণে আর কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। দ্বিতীয়দিন আমাদের প্রোগ্রাম ছিল সিমলার আশপাশে ঘুরে দেখা। ব্রিটিশদের তৈরি বলে এই শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে তার ছাপ স্পষ্ট। সকালে বেরিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম গ্রিন ভ্যালি। পাইন, ফার, ওক, দেবদারু ছাড়াও কত নাম না জানা গাছের সমারোহ সেখানে। খানিকক্ষন থাকলেই বেশ কিছুদিনের অক্সিজেন, শরীর স্টোর করে নিতে পারে। আর ছবি তোলার জন্য তো একেবারে আদর্শ জায়গা।
এরপরের গন্তব্য সিমলা কালীবাড়ি। সিমলার সবচেয়ে পুরনো মন্দিরে। চড়াই পথে প্রায় আধ ঘন্টা পেরিয়ে পাহাড়ের ওপরের ওই কালীবাড়িতে গেলাম। আশপাশের মনোহর দৃশ্য দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ যাই, দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিই আর মনে মনে আওড়াই ‘আর কত দূর বলো মা’। রাস্তা থেকে মন্দিরের চুড়ো অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকি। বিধানসভা ভবনের কাছে বলেই সম্ভবত এই পথে সাধারণের গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। কাজেই যতই কষ্ট হোক, হাঁটা ছাড়া গতি নেই। তবে পর্যটক, বিশেষত বাঙালির কাছে এর আলাদা আকর্ষণ আছে। এখানে পূজিত দেবীমূর্তিকে আনা হয়েছে জয়পুর থেকে। আসনের ডানদিকে আছেন মঙ্গলচন্ডী আর বাঁদিকে শ্যামলা দেবী। কথিত, এই দেবীর নাম থেকেই শহরের নাম সিমলা।
মায়ের মন্দিরে প্রণাম সেরে প্রসাদ নিয়ে বের হলাম আর মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দুপুরে খানিকক্ষণের জন্য মন্দির বন্ধ থাকে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম, ঠিক সময়ে ওখানে পৌঁছতে পারার জন্য। নয়তো দেবীর দর্শন হতো না। এখানে থাকার ব্যবস্থাও আছে। যদিও সেক্ষেত্রে আগে থেকে বুক করে আসতে হয়। মন্দিরের ওপর থেকে পুরো সিমলা শহরটাকে দেখা যায়। সে সৌন্দর্যও অসাধারণ। এই কালীবাড়ি আরও যে কারণে বিখ্যাত তা হলো, এখানে প্রতিবছর ধূমধাম করে কালীপুজো হয়।
সিমলা শহরকে আরও ভালভাবে দেখার জন্য ড্রাইভার হংসরাজ নিয়ে গেলেন জাকু পাহাড়ে। সিমলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। জাকুর ওপরে আছে হনুমান মন্দির। বলা হয়, লঙ্কাকাণ্ডে আহত লক্ষণকে সুস্থ করে তোলার জন্য সঞ্জীবনীর সন্ধানে গন্ধমাদন বহন করে ক্লান্ত হনুমান এখানেই বিশ্রাম নিয়েছিল। পুরাণ-কাহিনি যাই বলুক, এখানে প্রচুর হনুমানের সন্ধান যে মিলবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই সাবধানে চলতে হবে।
এরপরে গেলাম তারাদেবীর মন্দিরে। কথিত আছে, বহু বছর আগে রাজা ভূপেন্দ্র সেন দেবীর নির্দেশে একটি কাঠের মূর্তি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে রাজা বলবীর সেন স্বপ্নে তারাদেবীর দর্শন পান এবং দেবী আদেশ করেন, তাঁকে পাহাড়ের ওপরে মন্দির তৈরি করার জন্য। তিনি তখন মন্দির তৈরি করে কাঠের মূর্তির বদলে অষ্টধাতুর মূর্তি স্থাপন করেন। এখানে একটি শিবমন্দিরও আছে।
এরপর সোজা চলে গেলাম শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যালে। এখানে আছে অ্যাংলো এশিয়ান ক্রাইষ্ট চার্চ। ভারতের অন্যতম প্রাচীন চার্চ বলা এটিকে। প্রায় ১৩ বছর ধরে নিও-গথিক শৈলিতে তৈরি এই চার্চ। নানা রঙের কাচের জানালা, মুরালে অপূর্ব। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলাম শিল্প ও ইতিহাসের এই অনন্য কীর্তি। তারপর এখানে সাজানো নানারকম দোকানের পসরা থেকে টুকটাক কেনাকাটা করলাম। আছে নানারকম খাবারের রেস্তোরাঁ। পর্যটন দপ্তরের অফিসও এখানেই। এদিন আর কোথাও না গিয়ে সোজা চলে এলাম হোটেলে।
তৃতীয় দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে চলে গেলাম কুফরি, যা সিমলা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কুফরি শব্দ এসেছে কুফ্র থেকে। কুফ্র’র অর্থ লেক। এই জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সত্যি অসম্ভব। এই কারণেই অনেকে ছুটি কাটাতে, নিরিবিলি দু চারদিন নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে এখানে আসেন। অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাকটিভিটি যাঁদের পছন্দ, তাঁদের জন্য রয়েছে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোরব্যবস্থা। আমরাও গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাই লোকজন ছেঁকে ধরে ঘোড়ায় চড়ার জন্য। আমাদের ঘোড়ার সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব নেই। অতএব প্রস্তাব বাতিল !
কুফরি’তে এছাড়াও আছে ছোটদের জন্য বিনোদনের নানা ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরলাম। ড্রাইভার বর্মাজি ইতিমধ্যেই স্মরণ করিয়েছেন, “কাল তো আপ কো কাসল জানা হ্যায়। জলদি নিকলেঙ্গে। কিউকি ইয়ে রাস্তা জানেকে লিয়ে লাগভাগ সাত ঘন্টা লাগ যায়েগা।” ওঁর পরামর্শ শিরোধার্য। এছাড়া, যেতে সময় লাগে ছাড়াও পথে কিছু সাইটসিয়িং আছে। কাজেই প্রায় সারাদিন বাইরে থাকতে হবে। পাহাড়ী পথের ধকল সামলানোর জন্য শরীর ফিট রাখা জরুরি। তাই একটু বিশ্রাম এবং পরের দিনের গোছগাছ করার জন্য বিকেলের মধ্যেই হোটেলে ফিরে এলাম। আগামিকাল যাব কাসল। পরের সপ্তাহে থাকবে, তাই নিয়েই গল্পগাথা। (চলবে)
***ছবি : লেখক