যে উপহার দিল পাহাড়
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
কলকাতা থেকে পাট চুকিয়ে উত্তরবঙ্গে পাকাপাকি বসবাস শুরুর অভিজ্ঞতাটা প্রথমে পাহাড়েই ছিল, এ তথ্য আমার চেনা মহলের কেউ কেউ জানেন, অনেকেই হয়তো জানেন না। টানা দশ/এগারো মাস একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার মধ্য দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ পর্ব শুরু হলো বলা যায়। যদিও কার্যকারণে আবার শহরমুখী হতে হয়। আপাতত ঠিকানা শিলিগুড়ি। পাহাড়ের আস্তানাটিও অবশ্য আছে। সুযোগ পেলেই সেখানে পালাই। যাই হোক, এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। চুইখিম বলে সেই গ্রামটি শিলিগুড়ি শহর থেকে মাত্র দু ঘন্টার দূরত্বে। যদিও উন্নয়নের যাবতীয় প্রসাদ থেকে চূড়ান্ত বঞ্চিত। ২০১৫-র ডিসেম্বরে আমি সেখানে থাকতে আসার কয়েকমাসের মধ্যেই শুরু হলো এখানকার মানুষের পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন।
কালিম্পং জেলার অন্তর্ভুক্ত সেই ছোট্ট গ্রামটি এমনিতে একেবারে নিস্তরঙ্গ এক অঞ্চল। মানুষগুলি সরল ও বন্ধুভাবাপন্ন। আন্দোলনের সঙ্গে এদের সরাসরি তেমন যোগাযোগ নেই। প্রসঙ্গত, সামগ্রিকভাবেই এই আন্দোলনের মধ্যে কতটা রাজনীতি, কাদের রাজনীতি বা সত্যি পাহাড়ের মানুষ কি চায়, সেসব প্রশ্নে না যাওয়াই ভালো। আমি বরং সেই আন্দোলন চলাকালীন একটি দিনের গল্প বলি। তার আগে এখানকার জীবনযাপন নিয়ে কিছু তথ্য। পাহাড়ে খাদ্যভান্ডার মজুত রাখার একটা প্রক্রিয়া রাখতেই হয়। বিশেষত চুইখিমের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দোকানপাট নেই গ্রামে। সবই সমতল থেকে নিয়ে যেতে হয়। আর সমতলে নামা মানেই একঘন্টার গাড়ির পথ। কাছাকাছি বড় শহর ওদলাবাড়ি, যেতে হয় বাগরাকোট হয়ে। গাড়ি রিজার্ভ করে আসা-যাওয়ার খরচ তখন হাজার টাকা। বলা বাহুল্য, সেইজন্যই চেষ্টা থাকতো সমতলে নামলেই অন্তত মাসখানেকের রসদ মজুত করে নেওয়া।
যাই হোক, এইসব জীবনাভ্যাসে পরিণত হওয়ার মাঝেই শুরু হয়ে গেল আন্দোলন। মাস তিনেক ধরে চলেছিল সেই আন্দোলন জনিত বন্ধ। এদিকে মাসখানেক হিসেবের রসদ খতম। এবার কি ? গ্রামে একধরনের চাল পাওয়া যায়। খাওয়ার চেষ্টা করে দেখলাম হজম হচ্ছে না। যে গাড়িটা করে সব সময় ওদলাবাড়ি যাই, শেষে তার মালিক কাম ড্রাইভার কিরণকে ডেকে একদিন অনুরোধ করলাম ওদলাবাড়ি যাওয়ার জন্য। যাওয়াটা তারও প্রয়োজন। গ্রাম থেকে সওয়ারি, বাজারে বিকিকিনির নানা সরঞ্জাম আনানেওয়া করেই তারও সংসারের সিংহভাগ খরচ চলে। কিরণ জানায়, “থোড়া সাবধানি সে যানা হোগা ম্যাডাম।” কি সেই সাবধানতা ও-ই জানে। আপাতত কিরণের বোধবুদ্ধির ওপর ভরসা করেই আমারও চলা।
পরের দিন সকালে আমি পরিকল্পনা মতো গাড়িতে উঠে বসলাম। ততক্ষণে কিরণের পাশের সামনের সিটটুকু (আমার জন্য) ছেড়ে গাড়ি ভর্তি। এখানে এটা নতুন নয় । আমি রিজার্ভ করি আর গ্রামের এক বা একাধিক মানুষ নিজেদের নানা কাজে বাগরাকোট বা ওদলাবাড়ি যাওয়ার জন্য তাতে সানন্দে, স্বীয় অধিকারে লিফট নেয়। প্রথম প্রথম অবাক হলেও বিষয়টা ততদিনে অভ্যাস হয়ে গেছে। গাড়ির ভিতরে মানুষ। সিটের নিচে মুরগি। ওপরে ঝাড়ুর বান্ডিল, নানা জিনিসের বস্তা। সব মিলিয়ে মানুষ ও মালপত্রের সঙ্গে আমিও চলেছি।
ইঞ্জিনের আওয়াজ যতটা সম্ভব কম করে গাড়ি চালাতে চালাতে কিরণ বলে, “ম্যাম, কোই কুছ পুছে তো, আপ বোলনা আপ ডক্টর কে পাস যা রহি হো।” সে তো বলবো, কিন্তু বাকি লোক ? এই এত মালপত্র ? বুঝলাম ওদের নিজেদের মধ্যে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা আমাকে নিয়ে। আমি বহিরাগত এবং বাঙালি। ওদের মধ্যে যদিও কখনও বাঙালি বিদ্বেষ টের পাইনি। কিন্তু আন্দোলনকারীরা মনে করে, বাঙালি মানেই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের বিপক্ষে। আলোচনার সময় নয় এটা। চুপ করে থাকাই শ্রেয়। মনে মনে ভাবছি কিভাবে এক রোগীর চরিত্রে অভিনয় করবো।
গাড়ি মূল রাস্তায় নামার কিছুদূর পরেই আন্দোলনকারী একটি দলের মুখোমুখি হলাম। অচেনা মুখ সকলেরই। ওরা একবার আমার দিকে তাকিয়ে কিরণকে গাড়ি থেকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পার হয়ে যায়। কিরণ আর আসে না। গাড়ির অন্যদের মুখে তালা। আমি উসখুস করছি। নামবো কিনা ভাবছি। ঠিক তখনই কিরণসহ দলটা ফিরে এল। ওদের মধ্যেই মাতব্বর গোছের একজন এসে হাতজোড় করে নমস্কার করে কিছু বললো আমায় নেপালি ভাষায়, যার অর্থ আমি তেমন না বুঝলেও কিরণ গাড়ি স্টার্ট করায় বুঝলাম ফাঁড়া কেটেছে। তার আগেই প্রত্যুত্তরে নিজেও হাতজোড় করেছি।
গাড়ি চলতে শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর কিরণ যা জানায়, তার সারার্থ অনেকটা এইরকম। আমি বাঙালি হলেও ওদের এখানেই থাকি এখন। ট্যুরিস্টও নই, ব্যবসাও করতে আসিনি। আমার বাড়ি তৈরির সুবাদে গ্রামের অনেকেই কাজ পেয়েছে। গ্রামের একটাই স্কুল, সেটার উন্নতির জন্যও চেষ্টা করছি আমি। ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠক এটা ভাববেন না, নিজের কথা বলছি। এসবই ওদের কথা। ওই সংশয়ের মুহূর্তে ওরাই আমাকে উপলব্ধি করায় আস্থা, বিশ্বাস, আনুগত্য শব্দগুলো এখনও শুধুই অভিধানে থাকে না।
কিছুদূর আর কোনও সমস্যা নেই। গাড়ির বাকি লোকজন একটু সহজ হয়েছে ততক্ষণে। একজন প্রশ্ন করে,”কেয়া হোগা ম্যাম ? কব খতম হোগা ইয়ে সব। কামকাজ বন্ধ। ক্যাইসে চলেগা ঘর ?” কি বলবো ওদের ? ওরাও বোধহয় জানে এই প্রশ্নের কোনও জবাব নেই আমার কাছেও। পাহাড়ের এই মানুষগুলো চিরকাল বঞ্চিত। একদিকে সরকারি স্তরে অবহেলা, অন্যদিকে ওদের নেতাদের অসৎ কার্যকলাপ। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আজ অবধি কিছুই জোটেনি ওদের ভাগ্যে। আমরা পাহাড় থেকে সমতলে পৌঁছই। সামনে সেনা হেড কোয়ার্টার। কিরণের গাড়ি ওদলাবাড়ি যাবে না। গ্রামের গাড়িকে বাগরাকোটে দেখলে আন্দোলনকারীদের রোষের মুখে পড়তে হতে পারে। এখান থেকে অন্য গাড়ির ব্যবস্থা। নিজের গাড়িকে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে কিরণ আমাকে নিয়ে বাগরাকোটের গাড়িতে ওঠে।
ওদলাবাড়ির কাজ সেরে ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসি কিরণের গাড়ি যেখানে রাখা ছিল, সেই জঙ্গলের কাছে। সেখানে তখন ধুন্ধুমার কান্ড। প্রচুর গাড়ি। সবই ওই রুটের পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছে। নানা জিনিস তাতে। লোকজনের অবস্থা পাগলের মতো। এরা কেউই শহরে যেতে পারেনি। পথ আটকেছে আন্দোলনকারীরা। শহরের বাজারে যেতে না পারায় বিক্রি হয়নি । বেশির ভাগই শাকসবজি। জমির ফসল বিক্রি না হলে বিশাল ক্ষতি। কোল্ড স্টোরেজের কোনও ধারণাই নেই এখানে। ক্ষেতে ফসল ফলে, শনি-রবিবার শহরের বিক্রেতাদের দিয়ে পয়সা পায় ওরা। তাতেই সংসার চলে। খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড়, ছেলেমেয়েদের স্কুল, বইপত্র, ডাক্তার ইত্যাদি। এক-একজন নিজেদের লোড করা সবজির বস্তা ও ঝুড়ি থেকে খুঁজে বের করছে খারাপ হয়ে যাওয়া সবজি। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে আর গালি দিচ্ছে নেতাদের। অসহায় মানুষের নিষ্ফল সেই ক্রোধ দেখা যায় না চোখে।
একটু পরে একে একে কিরণের গাড়ির বাকি যাত্রীরা ফিরে আসে। অর্থাৎ, সকালের সহযাত্রীরা সকলেই হাজির। দিন প্রায় ফুরোবার মুখে। কিরণের গাড়ি ছাড়ে। বাকি গাড়িগুলিও সামনে পিছনে। এখন সবকটি গাড়ি চড়াইমুখী। ঘরে ফেরা পাখি, অস্তগামী সূর্যের আলো আর অসহায় লড়াকু পাহাড়ী মুখগুলি মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় ছবি তৈরি করে। জীবনের নীরব অথচ বাঙ্ময় সেই ছবি কোনওদিন ভুলতে পারিনি। পারবো না। এ ছবি পাহাড় থেকে পাওয়া আমার অনন্য এক উপহার।